ছিল ইভটিজিংয়ের অভিযোগ, কনস্টেবল যেভাবে হয়ে উঠলেন ‘ভোলে বাবা’

পদধূলি নিতে গিয়ে পদদলিত, মৃত্যু বেড়ে ১২২

| বৃহস্পতিবার , ৪ জুলাই, ২০২৪ at ১০:৩৩ পূর্বাহ্ণ

সারি সারি অ্যাম্বুলেন্স, বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর সদস্যদের দ্রুত পায়ে বাস থেকে নেমে আসা, জুতোচপ্পলের স্তূপ, টিভি সাংবাদিকদের সরাসরি রিপোর্টিং আর এসবের মধ্যেই হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনদের খুঁজতে থাকা মানুষের ভিড়। গত মঙ্গলবার গভীর রাতে এরকমই ছিল হাথরাস জেলার সিকান্দ্রারাউ হাসপাতালের দৃশ্য।

তবে মঙ্গলবার দিনের বেলা এক ধর্মীয় জমায়েতে পদপিষ্ট হয়ে এখনও পর্যন্ত ১২২ জনের মৃত্যুর পিছনের কাহিনী শুধু ওইটুকুতেই সীমাবদ্ধ নয়। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জানতে পেরেছে যে ওই ধর্মীয় জমায়েত, যেগুলিকে ‘সৎসঙ্গ’ বলা হয়ে থাকে, সেটির আয়োজকরা অনুমতি নিয়েছিলেন ৮০ হাজার মানুষের জমায়েতের। প্রকৃতপক্ষে এর কয়েক গুণ বেশি মানুষ মঙ্গলবার জড়ো হয়েছিলেন ‘ভোলে বাবা’ নামে পরিচিত ওই স্বঘোষিত ধর্ম প্রচারকের সভায়।

আবার এই ‘ভোলে বাবা’ কীভাবে ইভটিজিংয়ের দায়ে পুলিশ কনস্টেবলের চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়ে, জেল খেটে বেরিয়ে ধর্মগুরু হয়ে উঠলেন, সেটিও যেন এক সিনেমার গল্প। এখন ওই স্বঘোষিত ধর্ম প্রচারকের খোঁজে তার কয়েকটি আশ্রমে তল্লাশি চালাচ্ছে উত্তরপ্রদেশ পুলিশ। তবে গতকাল বুধবার যে এফআইআর দায়ের হয়েছে, সেখানে ওই ধর্ম প্রচারকের নাম নেই বলে জানা গেছে। খবর বিবিসি বাংলার।

উত্তর প্রদেশ পুলিশ জানিয়েছে ‘ভোলে বাবা’ নামে পরিচিত নারায়ণ সাকার হরির আসল নাম সুরজ পাল জাটভ। কাসগঞ্জ জেলার বাহাদুরপুর গ্রামের বাসিন্দা জাটভ উত্তর প্রদেশ পুলিশের কনস্টেবল ছিলেন। চাকরি জীবনের গোড়ার দিকে বেশ কয়েক বছর পুলিশের স্থানীয় গোয়েন্দা বিভাগে কর্মরত ছিলেন তিনি। প্রায় ১৮টি থানা এলাকায় কাজ করেছেন। ২৮ বছর আগে ইভটিজিংয়ের অভিযোগ দায়ের হয় তার বিরুদ্ধে। প্রথমে সাসপেন্ড করা হয়েছিল জাটভকে, পরে বরখাস্ত হন তিনি। ইটাওয়া জেলার সিনিয়র পুলিশ সুপার সঞ্জয় কুমার জানিয়েছেন, ওই ইভটিজিংয়ের ঘটনায় বেশ লম্বা সময় জেলে ছিলেন সুরজ পাল জাটভ। কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে ‘বাবা’র রূপ ধরেন তিনি। বরখাস্ত হওয়ার পরে সুরজপাল জাটভ আদালতে গিয়েছিলেন নিজের চাকরি ফিরে পেতে। আদালত চাকরি ফিরিয়েও দিয়েছিল। কিন্তু ২০০২ সালে আগ্রা জেলায় কর্মরত অবস্থায় স্বেচ্ছায় অবসর নেন জাটভ। এরপর তিনি ফিরে গিয়েছিলেন নিজের গ্রামের বাড়িতে। কিছুদিন পরে তিনি দাবি করতে থাকেন যে সরাসরি ঈশ্বরের সঙ্গে কথা হয় তার। এই সময় থেকেই নিজেকে ‘ভোলে বাবা’ হিসাবে তুলে ধরতে থাকেন জাটভ।

কয়েক বছরের মধ্যেই ‘ভোলে বাবা’র ভক্ত সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে ওঠে। এই ভক্তকুলই তার হয়ে বড় বড় ধর্মীয় জমায়েতের আয়োজন করতে থাকে। ওইসব জমায়েতে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হতে শুরু করেন। নিজের ধর্মীয় জমায়েত বা ‘সৎসঙ্গ’এ ভোলে বাবা একাধিকবার দাবি করেছেন, সরকারি চাকরি থেকে তাকে যে কে এদিকে টেনে আনল, তা তিনি নিজেও জানেন না। এ ধরনের স্বঘোষিত ধর্মগুরুদের বেশিরভাগকেই দেখা যায় ভক্তদের কাছ থেকে বিপুল ধনসম্পত্তি ‘দান’ হিসাবে গ্রহণ করেন। তবে আশ্চর্যজনকভাবে এই ভোলে বাবাওরফে নারায়ণ সাকার ভক্তদের কাছ থেকে কোনও দান, দক্ষিণা ইত্যাদি গ্রহণ করেন না। যদিও বেশ কয়েকটি আশ্রম তৈরি করেছে তার চ্যারিটেবল ট্রাস্ট। অন্য হিন্দু ধর্ম গুরুদের মতো গেরুয়া বসন পরেন না ভোলে বাবা। সবসময়েই তার পরিধানে থাকে সাদা পাজামাপাঞ্জাবি বা জামাপ্যান্ট অথবা স্যুট। ভোলে বাবার সৎসঙ্গে যারা আসেন, তাদের বেশিরভাগই অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল শ্রেণির এবং অনগ্রসর জাতির মানুষ।

স্থানীয় সাংবাদিকদের মতে, ভোলে বাবা গত কয়েক বছরে হাথরাসে বহুবার সৎসঙ্গ করেছেন এবং প্রতিবারই আগেরবারের থেকে বেশি ভিড় হয়েছে। বাবার সৎসঙ্গে সংবাদ মাধ্যমকে ঢুকতে দেওয়া হয় না, ভিডিও করাও নিষিদ্ধ। তার নিরাপত্তায় সৎসঙ্গীদের একটি বড় দল থাকে যারা তাকে ঘিরে রাখেন। তাই ভোলে বাবার কাছাকাছি পৌঁছানো বেশ কঠিন। যেসব সৎসঙ্গ আয়োজন করেন তার ভক্তরা, সেগুলিতে ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকে নারীপুরুষ স্বেচ্ছাসেবকরাই। জল, খাবার, ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণসব কিছুরই দায়িত্বে থাকেন এই স্বেচ্ছাসেবকরাই। তবে এর আগেও তার ‘সৎসঙ্গ’এ অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে হুড়োহুড়ি পড়ে গিয়েছিল।

বাবা’র পায়ের ধুলো নিতে হুড়োহুড়ি : মঙ্গলবারের সৎসঙ্গে হাজির থাকা ভক্তরা জানাচ্ছেন জমায়েত শেষ হয়ে যাওয়ার পরে ‘বাবা’র পায়ের ধুলো সংগ্রহ করতে গিয়েই হুড়োহুড়িটা শুরু হয়। ঘটনাস্থল সিকান্দ্রারাউ শহর থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে ফুলরাই গ্রাম। জাতীয় মহাসড়ক ৩৪এর ধার ঘেঁষে বিরাট এলাকা জুড়ে তাঁবু ফেলা হয়েছিল। এখন খুব দ্রুততার সঙ্গে ওই তাঁবু খুলে ফেলা হচ্ছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন বেশিরভাগ মানুষ পদপিষ্ট হয়ে মারা গেছেন মহাসড়কের পাশের জায়গাটিতেই। ওই ধর্ম প্রচারক ‘ভোলে বাবা’র প্রস্থানের জন্য আলাদা পথ করা হয়েছিল। সৎসঙ্গ শেষ হতেই মহাসড়কের পাশে ‘বাবা’র দর্শনের জন্য বহু নারী ভিড় করেছিলেন। মঙ্গলবার বৃষ্টি হয়েছিল, তাই মাটি ভেজা ছিল। ‘ভোলে বাবা’র পায়ের ধুলো নেওয়ার জন্য নিচে ঝুঁকেছিলেন অনেক ভক্ত। হুড়োহুড়িতে পা পিছলিয়ে ওখানেই পড়ে যান বহু মানুষ। একবার যারা পড়ে যান, তারা আর উঠে দাঁড়াতে পারেননি। তবে কথিত ধর্মগুরু নারায়ণ সাকার বিশ্ব হরিভক্তদের জন্য না থেমে এগিয়ে যেতে থাকেন বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসাদিক অ্যাগ্রো থেকে ৬টি নিষিদ্ধ ব্রাহমা গরু জব্দ করেছে দুদক
পরবর্তী নিবন্ধদুই আড়তকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা