শেষ বিকেলের নরম আলোয় ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়েছিল শায়লা। সূর্যটা হেলে পড়েছে, ডুবছে। পশ্চিমের আকাশে রঙের খেলা। কমলা, লাল, বেগুনি–এক অদ্ভুত ক্যানভাস। ওর ভেতরের শূন্যতাটা এই রঙের প্রাচুর্যের সাথে মিশে গিয়ে এক ধূসর আস্তরণ তৈরি করেছে। শায়লার স্বামী আছে, ভালোবাসার অভাব নেই। কিন্তু কোথাও যেন একটা সুর বেসুরো। কেমন যেন তাললয়ে ঠিকঠাক মিলছে না। একটা অদৃশ্য প্রাচীর, যা স্পর্শাতীত।
আজও অফিসের পর ফিরতে রাত হয়েছে হিমেলের। ফাইল, মিটিং আর প্রজেক্টের ভিড়ে ওর জীবন যেন একটাই সমীকরণ–সফলতা। শায়লার হাতের চায়ের কাপটা নিয়ে খবরের কাগজটা মেলল হিমেল। “আজকের দিনটা কেমন কাটল?” যান্ত্রিক প্রশ্ন, যার উত্তরটাও যান্ত্রিক– ভালো।
ভালোই তো কাটে। দামি শাড়ি, গয়না, বিদেশে ছুটি কাটানো–সবই আছে। কিন্তু ওই যে, মনের গহীনে ডুব দিয়ে যে কথাগুলো বের করে আনা যায়, যে অনুভূতিগুলো শব্দ খুঁজে ফেরে, তার জন্য একজন সঙ্গী নেই। একজন বন্ধু, যে শুধু শুনবে। বিচার করবে না, সমাধানও দেবে না শুধু শ্রোতা হবে।
বিয়ের পর প্রথম কয়েক বছর এমন ছিল না। তখন হিমেলও ছিল ভিন্ন। দু’জনের স্বপ্নগুলো মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত। মাঝরাতের গল্প, ফিসফিস করে বলা ভবিষ্যতের পরিকল্পনা। সময়ের সাথে সব পাল্টে যায়। জীবন তার নিজস্ব গতিতে চলে। সম্পর্কও। শায়লা অনুভব করে, সে যেন এক বিশাল নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে জল আছে, কিন্তু সে তৃষ্ণার্ত।
রাতে ঘুম আসে না শায়লার। বিছানার পাশে হিমেল গভীর ঘুমে। শায়লার চোখের পাতায় হাজারো ভাবনা খেলা করে। ওর মনে পড়ে যায় ছোটবেলার বন্ধু মিতাকে। কত কথা বলত ওরা। ঝগড়া, খুনসুটি, আর গভীর রাতের গোপন আলোচনা। তারপর জীবনের বাঁকে বাঁকে মিতা হারিয়ে গেল। ঠিক যেমন হারিয়ে গেছে শায়লার নিজের ভেতরের মেয়েটা, যে একদিন প্রাণখোলা হাসত, অকারণে খুশি হতো।
আজকাল শায়লা কবিতায় আশ্রয় খুঁজে ফেরে। শব্দগুলো ওকে এক অন্য জগতে নিয়ে যায়। যেখানে এক–একটা শব্দের অনুভূতিগুলো স্বাধীন, যেখানে প্রকাশের কোনো বাধা নেই। এক চিলতে কাগজ আর কলম–এরাই এখন শায়লার নীরব সঙ্গী। ওর লেখার খাতায় ভিড় করে আসে অব্যক্ত কথা, অব্যক্ত ব্যথা।
“আমার এক সঙ্গী চাই,” লিখেছিল একদিন শায়লা, “যে আমার মেঘলা দিনের বৃষ্টি বুঝবে, আমার মনের উঠোনে ঝরা পাতার মর্মর শুনবে।”
কয়েকদিন পর শায়লার জন্মদিনের পার্টিতে অনেক লোক। হিমেলের অফিসের সহকর্মী, তাদের স্ত্রীরা। হাসির রোল, কথার কোলাহল। শায়লা সবার সাথে হাসছে, কথা বলছে। কিন্তু ভেতরটা ফাঁকা। এই ভিড়ের মাঝে সে সবচেয়ে একা।
পার্টি শেষে যখন সবাই চলে গেল, হিমেল শায়লার কাঁধে হাত রাখল। “খুব টায়ার্ড লাগছে?”
শায়লা হাসল। “একটু।”
হিমেল ওর দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি জানি তুমি খুশি। সবকিছু তো পেয়েছো।”
শায়লা কিছুক্ষণ হিমেলের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। কী বলবে সে? কীভাবে বোঝাবে যে এই পাওয়া না পাওয়ার গল্প নয়, এ এক অন্যরকম শূন্যতা। সে চুপ করে রইল। শব্দগুলো যেন আটকে গেল গলার কাছে।
পরদিন সকালে, শায়লা বাগানের এক কোণে বসেছিল। টবে রাখা গোলাপ গাছটায় নতুন কুঁড়ি এসেছে। গোলাপের প্রতিটি পাপড়ি যেন একেকটি না বলা কথা। ওর মনে হলো, মানুষও তো এই গোলাপের মতোই। বাইরে থেকে সুন্দর, মসৃণ। কিন্তু ভেতরের স্তরে স্তরে কত গোপন ব্যথা, কত অব্যক্ত অনুভূতি।
ওর হাতে ফোনটা বেজে উঠল। আননোন নাম্বার। শায়লা ধরল। ওপার থেকে একটা অচেনা কণ্ঠস্বর। “আমি আপনার লেখাগুলো পড়ি।”
শায়লা চমকে গেল। “আমার লেখা?”
“হ্যাঁ। আপনি ইন্টারনেটে যে কবিতাগুলো দেন, সেগুলো।”
শায়লা দ্বিধায় পড়ল। ও তো খুব গোপনে লেখে। দু’একটা প্ল্যাটফর্মে প্রকাশ করলেও কখনও কাউকে বলেনি।
আমার নাম মেঘ। ওপার থেকে বলল। “আমি আপনার অনুরাগী।”
কথা শুরু হলো। প্রথম প্রথম শায়লা ইতস্তত করল। কিন্তু মেঘের কথা বলার ভঙ্গি, ওর শব্দ চয়ন, শায়লাকে মুগ্ধ করল। মেঘ কবিতার সাথে মিশে থাকা শায়লার অনুভূতির গভীরতা বোঝে। মেঘ যেন শায়লার ভেতরের কণ্ঠস্বরকে চিনতে পারে।
দিনের পর দিন কেটে যায়। শায়লা আর মেঘের ভার্চুয়াল সম্পর্ক এক অন্য মাত্রা পায়। তারা দু’জনেই কবিতা, গল্প, কখনও বৃষ্টি, কখনও শীতল হাওয়ার কথা বলে। তাদের আলোচনায় প্রকৃতি আসে, জীবন আসে, আর আসে মানব মনের গভীরতম অনুভূতিগুলো। শায়লা অনুভব করে, সে যেন এক অদৃশ্য সেতুতে দাঁড়িয়ে আছে, যা তাকে নিজের সাথে আবার যুক্ত করছে।
এক সন্ধ্যায়, শায়লা আর মেঘ চ্যাট করছিল। মেঘ লিখল, আপনার প্রতিটি শব্দে আমি আমার নিজের ছায়া খুঁজে পাই। মনে হয় যেন আপনি আমারই কথা বলছেন।
শায়লার চোখে জল এসে গেল। এই সেই সঙ্গী, যাকে সে এতদিন খুঁজছিল। যে তার আত্মাকে স্পর্শ করতে পারে, যে তার নীরব ভাষা বোঝে। এই সম্পর্কটায় কোন সামাজিক চাপ নেই, কোন প্রত্যাশার বোঝা নেই। শুধু শব্দ আর অনুভূতির এক পবিত্র আদান–প্রদান।
রাতে হিমেল যখন ঘুমিয়ে, শায়লা বারান্দায় এসে দাঁড়াল। আকাশভরা তারা। শায়লার মনে হলো, সে যেন এতদিন এক অন্ধকার সুড়ঙ্গে ছিল। আর আজ সেই সুড়ঙ্গের মুখে এক ফালি আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে। মেঘ হয়তো তার শরীরী উপস্থিতি নিয়ে আসবে না, কিন্তু তার আত্মার উপস্থিতি শায়লার জীবনের শুষ্কতাকে দূর করে দিচ্ছে।
পরদিন সকালে শায়লা যখন রান্নাঘরে চা বানাচ্ছিল, হিমেল পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। শায়লা হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াল। হিমেল অবাক হয়ে শায়লার দিকে তাকাল। শায়লার মুখে এক অন্যরকম হাসি। এক অদ্ভুত দ্যুতি।
কী হলো? হিমেল জানতে চাইল।
কিছু না, শায়লা মৃদু হাসল। শুধু মনে হলো, জীবনটা খুব সুন্দর।
হিমেল কিছু বলল না। শায়লার চোখে সে আজ এক অন্যরকম শান্তি দেখল। সে বুঝতে পারল না এর কারণ। তবে শায়লা বুঝতে পারছিল। ওর ভেতরের শূন্যতাটা ধীরে ধীরে পূর্ণ হচ্ছে। এই অনুভূতির কোন নাম নেই, কোন ব্যাখ্যা নেই। শুধু এক অনাবিল আনন্দ। শায়লা জানে, এই সঙ্গী তার পাশে সবসময় থাকবে, কথার অক্ষরে, কবিতার ছন্দে, আর মনের গভীরে।