(পর্ব ২)
৩.
হতে পারে কোনোদিন কোনো ‘মানুষ’ চাইনি আমি– শুধু ‘ছায়া’ চেয়েছি– যাকে আপনারা ‘স্মৃতি’ বলেন। এখনও আমি রাতে ঘুমাতে না পারলে চোখ বুজে পেছনের এক বা একাধিক সময়কে ঘিরে থাকা কোনো এক বা একাধিক ‘ছায়া’কে বেছে নিই। ফিরে যাই সেইসব ‘ছায়াসময়ে’। আজ এটা একটা খেলার মত হয়ে উঠেছে আমার কাছে। প্রতিদিনের একটা খেলা। চূড়ান্ত শেষ দিনটা ছাড়া যে খেলার শেষ নেই। বর্তমানের ‘মানুষ’ আর ‘ঘটনাগুলো’ কতটুকু ‘ছায়া’ হয়ে উঠল তার উপর নির্ভর করবে খেলাটা কতটা সমৃদ্ধ হবে। রক্তমাংসের মানুষের কোনো মূল্য নেই এ খেলায়। অতীতই এ খেলার রাজাধিরাজ! এ খেলার শেষ কথার– ‘স্মৃতিটুকু থাক!’
আজও যাই আমি সেই দিঘীটার পাশে। এখন অবশ্য সবসময় একা নয়, আমার ছয় বছরের ছেলেটাও কখনও থাকে আমার সাথে। আমরা সেইসব জায়গাতেই বসি, সেইসব গাছই ছুঁয়ে দেখি, সেই একইভাবে শুকনো পাতা উড়াই…। আমি ওকে একটা গল্প শোনাই–সোনার নৌকার গল্প। নানাভাবে, একই গল্প ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলি ওকে–
‘এই দিঘীর খুব গভীরে একটা সোনার নৌকা আছে। কোনো কোনো পূর্ণিমার রাতে যখন মধ্যরাত, চারিদিক শুনশান, সেই সোনার নৌকা ভেসে ওঠে দীঘির উপর। সেই নৌকায় একটা মণিমুক্তা বসানো আসনে বসে থাকেন এক জলদেবী। পাশে হুকুম তামিলের দু’চারজন দেবদূত। দুটো বাইসনও থাকে সেই নৌকায়। দীঘির বিহার শেষে জলদেবী একসময় নৌকাটা তীরে ভেড়ানোর নির্দেশ দেন। নৌকা তীরে ভিড়লে বাইসন দুটোকে পাশের ঐ উঁচু ধানক্ষেতটায় নিয়ে যায় দেবদূতেরা। শুরু হয় তীব্র লড়াই ওদের মধ্যে। কালো বাইসন দুটোর শিঙের ঘর্ষনে মেঘের মাঝের বিদ্যুতের মত আগুনের আঁকিবুকি ঝলসে ওঠে, ফুলকি ছোটে আগুনের স্ফূলিঙ্গের। দূরের সাঁওতাল গ্রামগুলো থেকেও সে–আগুন দেখা যায়। সে–সব গ্রামের কেউ কেউ মধ্যরাতের পষ্ট জ্যোৎস্নাতেও দেখেছে সে আগুন! সেই দীর্ঘ, তীব্র লড়াই শেষ হলে একটা মৃত বাইসন পড়ে থাকে ফাঁকা ধানক্ষেতে। তারপর মৃত বাইসনটাকে ফেলে সোনার নৌকা আর বিজয়ী বাইসনসমেত জলদেবী সেই দিঘীর জলের অনেক গভীরে হারিয়ে যান আবার। হেরে যাওয়া বাইসনটার মৃতদেহ দিনের আলোয় মিলিয়ে যায়। সোনালী চাঁদের মৃত্যু আর লাল সূর্যের জন্মের সন্ধিক্ষনে নির্ঘুম কেউ এখানে এলে রক্তাক্ত বাইসনটাকে দেখতে পায় শুধু। দূরের সাঁওতাল গ্রামগুলোর দু’একজন বৃদ্ধ এখনও বলেন– তাদের একজনই শুধু সেই রক্তাক্ত, মৃত বাইসনটাকে দেখেছিল চাঁদ–সূর্যের সমাপ্তি আর সূচনার সন্ধিক্ষণে। সেই মানুষটি হারিয়ে গেছে তারপর। কেউ তাকে খুঁজে পায়নি আর।’
চকচকে চোখে ছোট্ট বুকটার সমস্ত বিশ্বাস নিয়ে আমার ছেলে শোনে সে গল্প। বাসায় গিয়ে অতি উৎসাহে সবাইকে শোনায় গল্পটা তার সীমিত শব্দভান্ডার দিয়ে। ওর মা রেগে যায় আমার উপর– কি সব অবাস্তব কথা শেখাচ্ছি ছেলেটাকে! আমি চুপি চুপি হাসি মনে মনে। ঐ তোষকটার কথা মনে হলে যেমন একাকী, গোপন, নিঃশব্দ হাসি হাসতাম– তেমন হাসি। যে হাসির অর্থ শুধু আমিই জানি।
আমি জানি, এভাবেই প্রজন্মান্তরে বাহিত হবে সেই খেলা– যে খেলায় বাস্তবের কোনো ঠাঁই নেই, অবাস্তবই যেখানে সব। রূপকথা ছাপিয়ে সে খেলা একদিন জীবনেও ঢুকে পড়বে। তখন ছায়া হয়ে গেলেই শুধু সব ঘটনা, সব মানুষ সে খেলায় অর্থময় আর জীবন্ত হয়ে উঠবে, নয়ত নয়…
৪.
এসব শুনে আপনারা কি আমাকে বাস্তবতা থেকে পালিয়ে বেড়ানো এক মানুষ ভাবছেন? আপনারা হয়ত বলতে চান– বাস্তবতা থেকে পালিয়ে না গিয়ে আমার উচিত ছিল বাস্তবের মুখোমুখি হবার। ঘটনার মুখোমুখি হওয়া উচিত ছিল।
‘আমার সেই ঘরের দেয়ালগুলো যখন দু’জোড়া কালো, পেশিবহুল সাঁওতাল হাত শাবল ঢুকিয়ে উঁপড়ে ফেলছিল পাশের পুকুরে– যে দেয়ালে আমার আর আমার বোনেদের নাম লেখা ছিল–সেখান থেকে দীঘির ধারের সেই বনে পালিয়ে না গিয়ে আমার উচিত ছিল দেয়ালগুলোর ধসে পড়ার মুখোমুখি হবার।’
‘যে খাটটায় বসে আমি জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখতাম, অনেক নিথর দুপুরে বাইরে যেতে না দিয়ে যে খাটে আমার মা আমাকে কারবালার বিষন্ন ঐ গানটা শুনিয়ে ঘুম পাড়াতেন–
‘…যাও হে ঘোড়া দাও হে খবর, যেইখানেতে আছেন মা’য়,/তোমার ছেলে চাইছে পানি, কারবালাতে পানি নাই…’
–আর আমি লুকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়তাম– সেই খাটের টুকরোগুলো খুলে নিয়ে যাবার সময়ও আমার সেখানে থাকা উচিত ছিল।’
‘কিংবা প্রতারক আত্মসচেতনতায় নিজেকে গুটিয়ে না নিয়ে আত্মবিস্মৃত হয়ে সহজ আবেগে জড়িয়ে পরা উচিত ছিল ‘তার’ সাথে।’
কিন্তু, শুধু কি আমিই বাস্তবের মুখোমুখি হতে চাইনি? আপনারাও কি চান বাস্তবের মুখোমুখি হতে?
চাইলে, ঘরের ফটোফ্রেমটায় দু’জনের ছবি ঝুলিয়ে রাখতেন না বছরের পর বছর– যখন আপনার মধ্যরাতের স্বপ্নে আরেকজন ঢুকে পড়ে!
চাইলে, সন্তানের মধ্যে নিজের শৈশবকে আগলে রাখতে যেতেন না– যখন আপনিই দেখেছেন আপনার সন্তানের সবটুকু পড়তে পারা হাসি হঠাৎ একদিন কেমন বুঝতে না পারার মত অচেনা হয়ে পড়ে আপনার কাছে; যে হাসিতে সদ্য জানা জীবনের কোনো রহস্যময় অভিজ্ঞান লুকিয়ে থাকে– যা আপনি ধরতে পারেন না। অনেক খুঁজেও ধরতে পারেন না…। ঐ দিন আপনি আপনার শৈশবকে চিরদিনের মতো হারান!
চাইলে, নিরালম্ব অসহায়ত্বের মূহূর্তে আশ্রয়ের মিথ্যা প্রলোভনে মায়ের কাছে ছুটে যেতেন না– যখন আপনি জানেন আপনার অসহায়ত্বের ভাষা এখন সেই মানুষটিও পড়তে পারবেন না। আপনিও হয়তো বলতে পারবেন না।
তবে, শুধু কি আমিই, আপনারাও তো চাননা বর্তমান আর বাস্তবের মুখোমুখি হতে! তাই আপনারা ফটোফ্রেমে ছবি টাঙিয়ে রাখেন, ঘর সাজান, সন্তানের মধ্যে নিজ শৈশবকে আগলে ধরতে চান, মায়ের কাছে ছুটে যান। যদিও মনের গভীরে সেইসব মোহন মিথ্যাকে ঠিকই অনুভব করেন, কিন্তু সাহস করেন না স্বীকারের। আপনাদের আর আমার পার্থক্য শুধু ঐ খেলাটায়-‘ছায়ামানুষ’ আর ‘ছায়াসময়’ নিয়ে যে খেলা। বর্তমানকে ‘ছায়ামানুষ’ আর ‘ছায়াসময়ে’ রূপান্তরের যে খেলা। এখন হয়ত আপনারা খেলেন না সেই খেলা। কিন্তু আমি জানি, একদিন আপনারাও সেই খেলা শুরু করবেন কোনো এক নির্ঘুম, ‘সঙ্গীময়’ একাকীত্বের রাতে। আপনাদেরও ঘুনপোকার একটানা শব্দে মাঝ–রাতে ঘুম ভেঙে যাবে… (চলবে)