ছাদের দরজাটা লোহার। ঝাঁপ করে খোলা যায় না, কাঁধ দিয়ে ধাক্কা দিতে হয়। আজও আনোয়ারা ধাক্কা দিয়েই খুললেন। তিনতলার ফ্ল্যাট থেকে পাঁচ তলার ছাদ–পুরো দুই ফ্লোর একাই উঠেছেন। হাঁপাচ্ছেন না, বরং চোখে মৃদু জেদ। একটা সাদা সুতি ওড়না মাথায়, মুখে হালকা চাহনি, যে কেউ বলবে–এই বয়সে এমন ছিপছিপে নারী খুব কম দেখা যায়।
ছাদে আজ পাখি নেই। তিনটে ছেলে নিচে ক্রিকেট খেলছে, দূর থেকে আওয়াজ ভেসে আসছে-‘আন্টি বলটা আনেন তো!’ আন্টি শব্দটার প্রতি আনোয়ারার প্রবল বিতৃষ্ণা। কে এই ‘আন্টি’? আমি তো কারো কিছু নই। নিজেকে নিজে ‘আন্টি’ বলে কি বয়সটা কমে আসে?
তিনি ছাদের এক কোণে রাখা প্লাস্টিকের পুরোনো চেয়ারটায় বসে পড়লেন। চারদিকে ছড়ানো কিছু ফেলে দেওয়া শাড়ির গিট্টু, একটা খোলা রঙচটা ছাতা, আর পুরনো ঠোঙা। আনোয়ারা একটুও অশান্ত হলেন না। এটাই তো তাঁর ‘ছাদঘর’।
এই ছাদেই তিনি কাঁদেন। এই ছাদেই চুপ করে বসে থাকেন। কারো বউ নন এখানে, কারো মা নন। শুধু আনোয়ারা। চৌষট্টি বছর বয়সে কেউ স্বাধীন হতে চায় না। কিন্তু তার চেয়ে বড় সত্যি হলো, কেউ একা হতে চায় না। আর একাকীত্ব যখন জোর করে গলায় ঝোলানো মালার মতো পড়ে, তখন ছাদঘর একমাত্র আশ্রয়।
আজ পাঁচ দিন হলো, ছোট ছেলে রাফি মালয়েশিয়া গেছে। যাওয়ার দিন রাফি একবার চোখ তুলে তাকায়নি। শুধু বলেছিল, ‘আম্মা, জিদ কমায়া ফেলেন। দুনিয়া বদলাইছে।’
হ্যাঁ,বদলেছে। এই বদলটাকেই কেউ বলে ডিজিটাল, কেউ বলে এঙপ্লোরেশন, কেউ বলে বাস্তবতা।
আনোয়ারা বলেন, অভিমান!
তিন ছেলে, দুই মেয়ে। কেউই তাঁর সাথে থাকে না। ছোট মেয়ে শিউলি ফোন করে মাঝে মাঝে। বাকিরা মাঝরাতে ফেসবুকে ছবি দেয়, যেখানে তাঁদের গালে গোলাপি ফিল্টার, পাশে ক্যাপশন: ‘My Queen- My Mom’।
আনোয়ারা ছবিগুলো দেখতে পান। অথচ তাঁদের কোনো রানি বা রান্না লাগে না।
ছাদঘরে আজ তিনি সঙ্গে এনেছেন একটা পুরোনো ডায়েরি। লাল মলাট, একপাশে আঁকাবাঁকা হিজিবিজি লেখা। এটি তাঁর নয়, তাঁর মৃত স্বামীর। স্বামী ছিলেন খুব সাধারণ–রেলওয়ের জুনিয়র হিসাবরক্ষক। নাম–জুবায়ের। কখনো ভালোবাসা প্রকাশ করেননি, কিন্তু সংসার ভেঙে পড়লে মুখ গোমড়া করে চা বানিয়ে দিতেন। সেই জুবায়ের মারা গেছেন আট বছর হলো। বুকে ব্যথা উঠেছিল। তখন আনোয়ারা রান্না ঘরে শীতের পিঠা বানাচ্ছিলেন। তাঁর ভেতরের গিল্টি এখনো ঘুমায় না।
ডায়েরিটা খুলতেই আনোয়ারার চোখ আটকে গেল একটা পাতায় লিখা: ‘আনোয়ারার সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্তটা ওর মাথা নিচু করে চা বানানোটা না, বরং জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখা। আমি ওকে ছাদে যেতে দিই না, পাছে ও নিজের মতো মানুষ হয়ে যায়।’
আনোয়ারার ঠোঁট কাঁপে। কী ভয়াবহ এই স্বীকারোক্তি! কী গভীর এই দখলদারিত্ব! একটা জীবন পার হয়ে গেল–নিজেকে মানুষ বানাতে গিয়ে কখনো নিজের মতো মানুষ হতে পারেননি।
নিচে কোনো শব্দ নেই। হঠাৎ খুব নিঃশব্দ লাগে সবকিছু। ছাদঘরের পাশের ফ্ল্যাটে নতুন ভাড়াটে এসেছে। ছোট মেয়ে, চুলে লাল রং, চোখে স্মার্ট চশমা, নাম বীথি। আনোয়ারা একদিন তাকে দেখেছেন–ছাদে হেডফোন লাগিয়ে নাচছে। ভয় হয়, না জানি কী ভাবে! কিন্তু আজ তিনি হঠাৎ দাঁড়ালেন। এক পা, দুই পা করে ছাদের মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন। মুখে হাওয়া লাগছে। তার পরনে লাল–সাদা বুটিকের শাড়ি। এই শাড়ি তিনি তিন বছর পর পরেছিলেন রাফির বিয়েতে, যেদিন তাকে বউমা রান্নাঘরে যেতে দিয়েছিল, এই বলে-‘আম্মা, ওভার এঙাইটেড হইয়েন না।’
আনোয়ারা এবার ডায়েরিটার পাতাগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে ছাদ থেকে ছুঁড়ে দিলেন। বাতাসে উড়তে লাগল, একেকটা পৃষ্ঠা যেন একেকটা জবাবহীন বছর। তিনি ভাবলেন–জুবায়ের যদি জানত, তাঁর মৃত্যুর পরও ছাদে উঠতে ভয় করে আনোয়ারার!
তাঁর পায়ের নিচে যেন একরকম আভা। ছাদঘরে আজ এক নতুন আলোর জন্ম হলো। যেখানে একজন আনোয়ারা মাথা তুলে দাঁড়িয়েছেন। তিনি এবার হাসলেন। খুব সামান্য হাসি, কিন্তু তাতে একটা প্রতিজ্ঞা লুকিয়ে আছে। এই ছাদঘর এখন আর গোপন আশ্রয় নয়। এটা অধিকারের উঠান।