মাদ্রাসায় না যাওয়ায় বকা দিয়েছিলেন মা। সেই বকায় অভিমান করে সিলেট থেকে চট্টগ্রামে চলে আসে সাত বছরের মাদ্রাসা পড়ুয়া জুনায়েদ। অভিমানে সে যখন বাড়ি ছাড়ছে তখন পিছু নেয় ছোট বোন। তাকেও সাথে নিয়ে জুনায়েদ ট্রেনে চড়ে। ট্রেন চলে আসে চট্টগ্রামে, স্টেশনে নেমে তারা চোখে মুখে অন্ধকার দেখে। এক পর্যায়ে পুলিশি সহায়তায় দুই শিশুকে স্বজনদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে।
সিনেমাকে হার মানানো গল্পটি একেবারে অন্যরকম। সিলেটের মাদবপুরের মেহেরগাঁও মদিনাতুল উলুম মাদ্রাসায় শিশু শ্রেণিতে পড়ে মোহাম্মদ জুনায়েদ। সে স্থানীয় ধর্মঘর গ্রামের মোহাম্মদ জসিম উদ্দিনের পুত্র। তার মায়ের নাম রইসা খাতুন। খাদিজা নামের বছর তিনেক বয়সী তার একটি ছোট বোনও রয়েছে। ধর্মঘরে তাদের সংসার, দিনকাল সেখানেই কাটে। জুনায়েদ মাদ্রাসায় পড়তে না যাওয়ায় মা রইসা খাতুন বকা দেয় রোববার সকালে। মায়ের বকুনি হজম করতে না পেরে জুনায়েদ বাড়ি থেকে বের হয়ে রেলস্টেশনের দিকে হাঁটতে থাকে। বেশ কিছুদূর আসার পর সে খেয়াল করে যে, তার পিছু পিছু ছোট বোন খাদিজাও চলে এসেছে। অভিমানে ক্ষুব্ধ হয়ে থাকা জুনায়েদ তখন বোনকে নিয়ে বাড়ি ফেরার পরিবর্তে সামনে হাঁটতে থাকে। স্টেশনে পৌঁছে একটি ট্রেন পায়, সেটিতে চড়ে তারা দুজন চট্টগ্রামে চলে আসে। কিছুদিন আগে তারা একবার চট্টগ্রামে এসেছিল। এখানে তার নানার বাড়ি বলেও সে জানে। পথিমধ্যে ট্রেনে তারা দিব্যি বেশ ঘুরে ফিরে থেকে যায়। কয়েকজন যাত্রী তাদের টুকটাক খাবারও দিয়েছে। তবে টিকেট চেক না করায় রেলওয়ের কারো হাতে তারা পড়েনি। দুই ভাই বোন নিজেদের মতো করে মাধবপুর থেকে চট্টগ্রামে এসে পৌঁছায়।
রোববার রাতে স্টেশনে পৌঁছার পর দুই শিশু চোখে মুখে অন্ধকার দেখে। তারা স্টেশনের অদূরে নানার বাড়ি বলে ধারণা করলেও স্টেশন থেকে বের হতে গিয়ে দেখে যে সেখানে কোন পুকুর–টুকুর নেই। হাজার হাজার মানুষ এবং গাড়ির ভিড়ে তারা দিশেহারা হয়ে উঠে। অল্পবয়সী দুইটি শিশুর এলোমেলো ঘোরাঘুরি এবং কান্নাকাটি স্থানীয় কিছু লোকজনের নজরে পড়ে। তারা বিষয়টি নিউমার্কেট এলাকায় কর্তব্যরত পুলিশকে জানায়। কোতোয়ালী থানা পুলিশের এসআই ইকবাল ভুঁইয়া শিশু দুইটিকে গ্রহণ করে প্রথমে খাবার খাওয়ায়। তারপর তাদের কাছ থেকে নাম পরিচয় জানার চেষ্টা করে। কিন্তু দুই শিশু নিজেদের নাম এবং বাবার নাম ছাড়া আর তেমন কিছু বলতে পারছিল না। শুধু ধর্মঘর নামের জায়গায় তাদের বাড়ি এটুকু বলতে পারছিল। এছাড়া চট্টগ্রামে রেলওয়ে স্টেশনের পাশে একটি পুকুর পাড়ে নানার বাড়ি এটুকুও বলছিল।
এসআই ইকবাল ভুঁইয়া দুই শিশুকে নিয়ে রেলওয়ে স্টেশনের চারদিকে নানা স্থানে ঘুরিয়ে দেখায়। কিন্তু কোথাও নানার বাড়ি খুঁজে পাওয়া যায় না। পরে তাদেরকে পাহাড়তলী রেলওয়ে স্টেশনের পাশে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ঢেবার পাড়ে নানার বাড়ির খোঁজ করা হয়। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হয়নি। নানার বাড়ি কিংবা শিশুদের পরিচয় মেলেনি। সব শুনে সে সময় স্থানীয় এক বাসিন্দা মন্তব্য করেন, ‘ছ ত কারবার…’।
এসআই ইকবাল ভুঁইয়া পরবর্তীতে গুগলে চার্জ দিয়ে ধর্মঘর গ্রামের হদিশ বের করে। মাদবপুরে ধর্মঘর একটি গ্রামের হদিশ পাওয়ার পর তিনি মাদবপুর থানার সহায়তায় ওখানের জসিম উদ্দিনের কোনো ছেলে মেয়ে হারিয়েছে কিনা তা খোঁজ করার ব্যবস্থা করেন। পরবর্তীতে মাদবপুর থানা নিশ্চিত করে যে, জসিমউদ্দিনের দুই শিশু হারিয়েছে। তারা জসিমউদ্দিনের সাথে এসআই ইকবাল ভুঁইয়ার কথা বলিয়ে বিষয়টি নিশ্চিত করে। পরবর্তীতে জসিমউদ্দিন তার শ্বশুর বাড়ির ঠিকানা এবং ফোন নম্বর দেয়। অবশেষে গতকাল বিকেল তিনটা নাগাদ জুনায়েদ এবং তার বোন খাদিজাকে তাদের মামার হাতে তুলে দিয়ে হাফ ছাড়ে পুলিশ। জুনায়েদ পুলিশকে রেলস্টেশনের পাশে পুকুর পাড়ে নানার বাড়ি বললেও প্রকৃতপক্ষে তা কালুরঘাটে। অবশ্য মায়ের বকুনিতে সে আর কোনদিন ঘর ছাড়বে না বলে পুলিশকে জানিয়ে গেছে।












