বাংলাদেশের জাতীয় স্বাধীনতা ও মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক সাংস্কৃতিক মুক্তির লড়াইয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক রাজনীতির অন্যতম পুরোধা শ্রমিক নেতা ও সাংসদ চৌধুরী হারুনর রশীদ। তিনি পটিয়া নির্বাচনী এলাকা থেকে ১৯৮৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সাংসদ নির্বাচিত হন। আগামী বছর (২০২৬) তাঁর জন্মশতবর্ষ, আর গতকাল ১৯ অক্টোবর ছিল তাঁর মৃত্যুদিবস। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের মহান সংগঠক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শ্রমিক নেতা চৌধুরী হারুনর রশীদের অসাধারণ দীপ্তিময় কর্মজীবনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।
চৌধুরী হারুনর রশীদ বাংলাদেশের প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ–সভাপতি ও চট্টগ্রাম জেলা ন্যাপ এর সভাপতি, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। তিনি ছিলেন মহান ভাষা আন্দোলনের অগ্রগামী ভাষা সংগঠক, চট্টগ্রাম সর্বদলীয় ভাষা সংগ্রাম পরিষদের তিনি ছিলেন যুগ্ম আহ্বায়ক। অসাধারণ রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, জীবন–যাপন ও আচরণে পরিশীলিত, রাজনৈতিক শিষ্টাচার সমন্বয়ে তিনি এক উন্নত রাজনৈতিক সংস্কৃতির দৃষ্টান্ত রেখেছেন যা সকল রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীর কাছে অনুকরণীয়।
চৌধুরী হারুনর রশীদের জন্ম চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার মনসা গ্রামে। কৈশোরে তিনি রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৪১ সালে স্কুলে পড়ার সময় তিনি পাকিস্তান আন্দোলনে যোগ দেন, ১৯৪৩ সালে বাংলায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের (তেতাল্লিশের মন্বন্তর নামে পরিচিত) সময় তিনি চট্টগ্রাম শহর ও গ্রামে ত্রাণ তৎপরতায় অংশ নেন। ১৯৪৬ সালে চট্টগ্রাম কলেজে পড়ার সময় বামপন্থী প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন ছাত্র ফেডারেশনের সাথে তাঁর সম্পর্ক গড়ে উঠে। এরই প্রভাবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব বাংলার জনগণের ওপর পাকিস্তান শাসক গোষ্ঠীর অত্যাচার, দমন নিপীড়ন, মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক প্রচারণা, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে অব্যাহত ষড়যন্ত্র, উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার চক্রান্ত প্রভৃতি গণবিরোধী রাজনীতির কারণে মুসলিম লীগের রাজনীতির প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেন। তরুণ চৌধুরী হারুন ক্রমশ বাম প্রগতিশীল রাজনীতির প্রতি ঝুঁকে পড়েন। এই সময় অর্থাৎ ১৯৪৮ সালে তিনি চট্টগ্রামে প্রগতিশীল শিল্পী সাহিত্যিকদের সংগঠন সাংস্কৃতিক বৈঠক এবং মাহবুবউল আলম চৌধুরী ও সুচরিত চৌধুরীর যুগ্ম সম্পাদনায় সাহিত্য পত্রিকা মাসিক সীমান্ত প্রকাশনায় সক্রিয় উদ্যোগে যুক্ত হন। এই সময়ে তিনি তাঁর বড় ভাই যিনি রেলে চাকরি করতেন তার সুবাদে রেল শ্রমিক কর্মচারীদের আন্দোলনের সাথেও যুক্ত হন। তিনি রেল শ্রমিকদের মুখপত্র সাপ্তাহিক প্রভাতী পত্রিকায় ছদ্মনামে লিখতেন। ১৯৪৯ সালে তিনি রেল শ্রমিকদের আন্দোলন সংগ্রামে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেন এবং তাদের আস্থাভাজন নেতায় পরিণত হন। রেল শ্রমিক আন্দোলনের মুখপত্র আওয়াজ নামে একটা পত্রিকা প্রকাশিত হলে চৌধুরী হারুন তার কার্যকরী সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৯৫০ সালে তিনি রেলওয়ে একাউন্টস এমপ্লয়ীজ লীগের নির্বাচনে তৎকালীন সভাপতি ও শক্তিশালী অবাঙালী শ্রমিক নেতা চেরাগ খানকে পরাজিত করে ঐ সংগঠনের সভাপতি পদে বিজয়ী হন। একই বছরে তিনি ব্যাংক কর্মচারীদের প্রথম সংগঠন পূর্ব বাংলা ব্যাংক এমপ্লয়ীজ ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নির্বাচিত হন। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৪ বছর, অল্প বয়সে তিনি চট্টগ্রামের শ্রমিক আন্দোলনে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তার উদ্যোগে চট্টগ্রামের ভাষা আন্দোলনে বিভিন্ন সংগঠনের শ্রমিক কর্মচারীরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।
চৌধুরী হারুন শ্রমিক রাজনীতির পাশাপাশি শিক্ষা সাহিত্য সহ নানা সামাজিক–সাংস্কৃতিক আন্দোলনে যুক্ত থাকেন। ১৯৫০ সালে স্বার্থান্বেষী মহলের প্ররোচনায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হলে তাঁর নেতৃত্বে পূর্ব বাংলায় চট্টগ্রামে লেখক শিল্পী ও সংস্কৃতি কর্মীদের উদ্যোগে দাঙ্গাঁ বিরোধী প্রচার আন্দোলন, মিছিল সংঘটিত হয়। চৌধুরী হারুন সর্বদলীয় সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী সংস্কৃতি সংসদের যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫১ সালে চট্টগ্রামে হরিখোলার মাঠে (বর্তমানে মোমিন রোড, হিন্দু ফাউন্ডেশন কার্যালয়) ১৬–১৯ মার্চ ৪ দিন ব্যাপী সংস্কৃতি সম্মেলনে চৌধুরী হারুনের উদ্যোগী ভূমিকা ছিলো। তিনি এই সম্মেলনে দপ্তর সম্পাদক ছিলেন। এটি ছিল স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম সংস্কৃতি সম্মেলন। এই সম্মেলনে সভাপতির অভিভাষণ দেন মনীষী আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ। রাজনৈতিক তৎপরতায় তিনি সামনের সারিতে ছিলেন। ১৯৫১ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান কর্তৃক দেশের খসড়া সংবিধান কমিশনের মূলনীতি গণস্বার্থবিরোধী ভূমিকার বিরুদ্ধে চট্টগ্রামে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ মিছিল সংঘটিত করেন এইজন্য তাকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তিনি মুক্তি পান। ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামে তখন নানা রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক তৎপরতা ও কর্মকান্ড চলে। চৌধুরী হারুন এসব তৎপরতায় খুবই উদ্যোগী ছিলেন। এ কারণে তাকে সর্বদলীয় ভাষা সংগ্রাম পরিষদ এর যুগ্ম আহ্বায়ক নির্বাচিত করা হয়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী ঢাকায় পুলিশের গুলি বর্ষনে কয়েকজন ছাত্র শহীদ হলে চট্টগ্রামের লালদিঘি ময়দানে ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ২২শে ফেব্রুয়ারী আয়োজিত বিশাল গণ–সমাবেশে তিনি মাহবুব–উল–আলম চৌধুরী রচিত একুশের প্রথম দীর্ঘ কবিতা “কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি” পাঠ করেন। এতে সমাবেশে এক অভূতপূর্ব আবেগ ও ক্রোধ জেগে ওঠে। সেই রাতেই পুলিশ চৌধুরী হারুন কে গ্রেফতার করে জেলখানায় নিয়ে যায়। উত্তেজিত জনতা জেলখানা ঘেরাও করে তাঁর মুক্তি দাবি করলে প্রশাসন জেল গেটে ১৪৪ ধারা জারি জনরোষ দমন করে। এতে নেতা ও সংগঠক হিসেবে তরুণ বয়সেই তাঁর জনপ্রিয়তার প্রমাণ মেলে।
চৌধুরী হারুনের এবারের জেল–জীবন বেশ দীর্ঘ হয়। ভাষা আন্দোলনের সময় ১৯৫২ সালে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সম্পর্কিত হন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফন্ট সরকার ক্ষমতায় এলে তিনি মুক্তি পান। মুক্তি লাভের পর তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আওয়ামীলীগে কাজ করেন। কিন্তু পরে ১৯৫৭ সালে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যোগ দেন। এর ১০ বছর পর চীন মস্কোর দ্বন্দ্বের ফলে ন্যাপ এর মতবিরোধ দেখা দিলে তিনি ১৯৬৭ সালে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ এর নেতৃত্বাধীন ন্যাপ এ কেন্দ্রীয় নেতা হন, (সহ–সভাপতি) এবং চট্টগ্রাম জেলা ন্যাপ এর সভাপতি নির্বাচিত হন। ৫০ এর দশকে তিনি কালুরঘাট জুট মিল শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হন।
১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুব খান মার্শাল ল জারি করে এবং চৌধুরী হারুন ও অন্যান্য রাজনৈতিক নেতার ওপর গ্রেফতার পরোয়ানা জারি করে। তাকে ধরিয়ে দিতে সরকার ১০,০০০/- টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। চৌধুর হারুন আত্মগোপনে থেকে পূর্ব বাংলার স্বাধীকার, গণতন্ত্র, নির্বচন ও স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন সংগঠনে বিশিষ্ট ভূমিকা নেন। ১১ বছর আত্মগোপনে থাকার পর ঊনসত্তরের গণঅভূত্থানে আইয়ুবের পতন হলে চৌধুরী হারুন প্রকাশ্য রাজনীতিতে ফিরে আসেন। এই দীর্ঘ ১১ বছর হুলিয়া মাথায় নিয়ে তিনি চট্টগ্রামে ছাত্র গণআন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন সংগঠিত করেন। ঊনসত্তরের গণঅভূত্থানে অভূতপূর্ব গণ জোয়ারের সৃষ্টি করে।
১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে চৌধুরী হারুন অসামান্য অবদান রেখেছেন। ১৯৭১ এর অসহযোগ আন্দোলন ও স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র প্রস্তুতির লক্ষ্যে তিনি ছাত্র–যুব–শ্রমিক জনতাকে সংগঠিত করেন, তাদের অস্ত্র সংগ্রহে উদ্বুদ্ধ করেন। বোয়ালখালীতে বেঙ্গল রেজিমেন্টের তৎকালীন মেজর জিয়ার বাহিনিকে সহায়তা করতে সর্বোত সচেষ্ট ছিলেন। রাঙ্গুনিয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের অস্থায়ী ট্রেনিং ক্যাম্প চালু করেন। সশস্ত্র প্রতিরোধের সময় তিনি বিদ্রোহী সেনাবাহিনির অন্যতম অধিনায়ক ক্যাপ্টেন রফিকের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। সশস্ত্র প্রতিরোধের এক পর্যায়ে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ভারতের ত্রিপুরায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। ভারতে অবস্থানকালে তিনি ও মোঃ ফরহাদ ভারত সরকারের সাথে আলোচনা করে ছাত্র ইউনিয়ন ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য কর্মীদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেন। এই ৩ সংগঠনের প্রায় ১৯ হাজার সদস্যের সমন্বয়ে গেরিলা বাহিনী গড়ে ওঠে। চৌধুরী হারুন এই গেরিলা বাহিনীর অপারেশন কমান্ড কাউন্সিলের অন্যতম আহ্বায়ক নিযুক্ত হন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম বিজয় অর্জনের পর চৌধুরী হারুন রশীদ দেশপ্রেমিক এক রাজনৈতিক নেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। দেশের রাজনীতি ও শ্রমিক আন্দোলনে তিনি ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সক্রিয় ভূমিকা নেন। এই সময় তিনি বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সভাপতি ও রেল শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হন। একইসাথে ন্যাশনাল (মোজাফফর ন্যাপ) কেন্দ্রিয় কমিটি ও জেলা ন্যাপের সভাপতি নির্বাচিত হন।
বিগত শতকের ৮০ এর দশকে এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে শ্রমিক কর্মচারীদের প্রতিবাদ সংঘটিত করেন এবং স্কপ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। ১৯৮৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পটিয়া আসন থেকে সাংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮৯ সালে তিনি গণতন্ত্রী পার্টিতে যোগদান করে। ১৯৮৮ সালে তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন, পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হওয়ায় ডাক্তারের পরামর্শে তিনি সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মকান্ড থেকে বিরত হোন। ১৯৯৫ সালে চৌধুরী হারুনের অর্ধ শতাব্দীর ও বেশি সময় ধরে রাজনীতি ও শ্রমিক জনতার আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা রাখায় এই ত্যাগী নেতাকে চট্টগ্রাম বাসীর পক্ষ থেকে এক সংবর্ধনা দিয়ে তাঁর নিঃস্বার্থ ত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। এই সংবর্ধনা কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন তৎকালীন মেয়র এ বি এম মহিউদ্দীন চৌধুরী। ২০০০ সালের ১৯ অক্টোবর চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এক অকুতোভয় সংগ্রামী জননেতার বর্ণাঢ্য জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। কিশোর বয়স থেকে দেশ ও মানুষের মুক্তির আন্দোলনের যে পাঠ নিয়ে রাজনীতির পথে নেমেছিলেন, দেশের স্বাধীনতা ও জনগণের মুক্তি আন্দোলনে অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করে চৌধুরী হারুন সে পথে বিশ্বস্ত থেকে হেঁটেছেন আমৃত্য।
লেখক : সভাপতি বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র চট্টগ্রাম জেলা কমিটি, সদস্য শ্রম সংস্কার কমিশন