চৌদ্দ বছরে শুরু, রাজনীতিতে কেটেছে ৬৬ বছর

মোরশেদ তালুকদার | বুধবার , ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ at ৫:৫৮ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির পূর্ব নির্ধারিত জনসভায় প্রধান বক্তা হিসেবে অংশ নেওয়ার কথা ছিল। প্রস্তুতিও ছিল সেভাবে। কিন্তু জনসভার কয়েক ঘণ্টা আগে গতকাল সকালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। অর্থাৎ মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত নিজের ধ্যানজ্ঞান ছিল রাজনীতি। তিনি বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান। মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে যার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু হয়। তার ৮০ বছরের বর্ণাঢ্য জীবনের ৬৬ বছরই কেটেছে রাজনীতি করে। দীর্ঘ রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। দুই দফায় মন্ত্রীও ছিলেন। রাজনীতির কারণে অসংখ্যবার কারাবরণও করেন তিনি।

রাজনীতি করতে গিয়ে যখনই সুযোগ হয়েছে এ বীর মুক্তিযোদ্ধা ভূমিকা রেখেছেন চট্টগ্রামের উন্নয়নে। তার একান্ত সচিব নুরুল আজিম হিরু আজাদীকে জানান, ১৯৯১ সালে গঠিত মন্ত্রিসভায় আবদুল্লাহ আল নোমান প্রথম চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী করার প্রস্তাবনা পেশ করেন এবং ২০০১ সালে গঠিত মন্ত্রিসভায় ব্যক্তিগত ৫ম পৃষ্ঠার ৭ম কলাম

উদ্যোগে ১৭ দফা সম্বলিত এ প্রস্তাবনা পাশ করান। তার প্রস্তাবের ভিত্তিতে তৎকালীন মন্ত্রিসভায় বাণিজ্যিক রাজধানীর অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য সচিব কমিটি গঠন করা হয়। এছাড়া ভেটেরিনারি কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন উন্নয়নে ভূমিকা রয়েছে আবদুল্লাহ আল নোমানের। তাই তো দলমত নির্বিশেষে চট্টগ্রামবাসীর মনে স্থান করে নিয়েছেন তিনি।

৬৬ বছরের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার : আবদুল্লাহ আল নোমান জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ৩১ মে। তিনি ১৯৫৯১৯৬০ সাল থেকে ছাত্র রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হয়ে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের চট্টগ্রাম শহর শাখার সাধারণ সম্পাদক, জেলা কমিটির সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃত্বে ছিলেন। পরে ১৯৬২ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন এবং হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।

১৯৬৯ সালে ছাত্রদের ১১ দফার মাধ্যমে সৃষ্ট গণঅভ্যুত্থানকে চট্টগ্রামে সংগঠিত করেন এবং নেতৃত্ব দেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেন এবং মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭৩ সালে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাপের জাতীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও চট্টগ্রাম জেলার ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তখন তিনি সরকারের সকল সন্ত্রাস, নির্যাতন ও অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামে আন্দোলন গড়ে তোলেন। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে মওলানা ভাসানী আহূত চট্টগ্রামে ‘ভুখা মিছিল ও ভারতীয় পণ্য বর্জন’ কর্মসূচির আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। তাছাড়া ভাসানীর পক্ষে সরকারের নিকট ভাসানী ন্যাপের চট্টগ্রামের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসাবে স্মারকলিপি পেশ করেন। ১৯৭৮ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান কর্তৃক গঠিত জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটির সদস্য হন। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান পরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটি গঠন করলে তিনি সিনিয়র সহসভাপতি ও চট্টগ্রাম জেলা সাংগঠনিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হন। পরে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন সাংগঠনিক কমিটির সভাপতিও হন। দীর্ঘ ১৫ বছর তিনি বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিব ছিলেন। এর আগে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। মৃত্যুকালে তিনি বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান পদে ছিলেন।

এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছিল আবদুল্লাহ আল নোমানের রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। ১৯৮৬ সালে তিনি এরশাদ সরকার কর্তৃক কারারুদ্ধ হন। ১৯৮৭ সালে তিনি হুলিয়ায় থাকা অবস্থায় এরশাদবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন এবং স্বৈরশাসকের পতন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত রাখেন।

১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৪ নভেম্বর লালদিঘি ময়দানে বেগম খালেদা জিয়াকে তিনিই প্রথম ‘দেশনেত্রী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ১৯৯১ সালে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে চট্টগ্রাম৯ আসনে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত হন এবং ক্যাবিনেটে সিনিয়র মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। একই আসন থেকে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত হন। সেবার মাত্র ১৩ জনের যে মন্ত্রিসভা গঠিত হয় সেখানেও তিনি সিনিয়র মন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তৃতীয়বারের মতো সাংসদ নির্বাচিত হয়ে মন্ত্রী হন।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস গতকাল শোকবার্তায় বলেন, আবদুল্লাহ আল নোমান বাংলাদেশের রাজনীতিতে একজন গুণী নেতা ছিলেন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। ষাটের দশকের শুরু থেকে জীবনের শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত রাজনীতিতে সক্রিয় থেকেছেন আবদুল্লাহ আল নোমান। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে (বিএনপি) সক্রিয় থেকে তিনি চট্টগ্রাম৯ আসন থেকে তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। সাবেক এই মন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মৎস্য ও খাদ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। রাজনৈতিক ঘরানার বাইরেও চট্টগ্রামে সব দলমতের মানুষের কাছে শ্রদ্ধার আসনে ছিলেন তিনি।

শোকবার্তায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, একজন জাতীয় রাজনীতিবিদ হিসেবে দেশের সকল ক্রান্তিকালে জনগণের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। একজন জাতীয় রাজনীতিবিদ হিসেবে দেশবাসীর নিকট অত্যন্ত সমাদৃত ছিলেন।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন থেকে দলকে সুসংগঠিত করতে আবদুল্লাহ আল নোমান গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তার ভূমিকা ছিল অপরিসীম। তিনি গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সাহসী নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি ছিলেন দল অন্তঃপ্রাণ নেতা। তার মৃত্যুতে দেশ ও জাতীয়তাবাদী দল এক ত্যাগী, সাহসী, সংগ্রামী সজ্জন ও বর্ণাঢ্য রাজনীতিবিদকে হারাল। দেশের উন্নয়নমূলক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে তার অবদান দেশ, জাতি ও দল চিরদিন মনে রাখবে। তার মৃত্যুতে দলের অপূরণীয় ক্ষতি হলো। তার কর্মের মধ্য দিয়ে তিনি নেতাকর্মীদের কাছে অমর হয়ে থাকবেন।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, বিএনপি প্রতিষ্ঠার সময়কাল থেকে দলের নীতিআদর্শের প্রতি আবদুল্লাহ আল নেমানের একনিষ্ঠ আনুগত্য ছিল প্রশ্নাতীত। একাধিকবার মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য থাকা অবস্থায় তার কর্তব্য পালনকালে দেশের এবং জনগণের প্রতি তিনি সর্বোচ্চ প্রতিদান দিয়ে গেছেন।

বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা গোলাম আকবর খোন্দকার বলেন, আব্দুল্লাহ আল নোমান ছিলেন এক অসাধারণ দেশপ্রেমিক, আপোষহীন রাজনৈতিক নেতা এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে একজন অক্লান্ত সৈনিক। তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে কেটেছে। মন্ত্রী হিসেবে দেশ ও জাতির উন্নয়নে তার অবদান অনস্বীকার্য। জনগণের সেবাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তিনি কাজ করেছেন, যার প্রভাব আজও বিদ্যমান।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ উপদেষ্টা ফারুকআজম বীরপ্রতীক বলেন, আবদুল্লাহ আল নোমান ছিলেন একজন ত্যাগী রাজনীতিবিদ। রাজনৈতিক অঙ্গনে তিনি ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন নেতা হিসাবে সকলের কাছে সমাদৃত ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে দেশ একজন প্রথিতযশা রাজনীতিবিদকে হারাল।

সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, আবদুল্লাহ আল নোমান ছিলেন বাংলাদেশের রাজনীতির এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তার ভূমিকা ছিল অপরিসীম। তিনি কেবল চট্টগ্রাম নয় বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গনে এক কিংবদন্তি পুরুষ। তিনি শুধু নেতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান। তিনি ছিলেন নেতাদের নেতা। বিএনপির রাজনীতিতে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। চট্টগ্রামের উন্নয়নে তার অবদান চিরস্মরণীয়। তিনি স্বৈরাচারবিরোধী ৯০ গণআন্দোলনে শহীদের স্মৃতি রক্ষায় প্রতিষ্ঠা করেন এন এম জে মহাবিদ্যালয়।

নগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহ বলেন, আবদুল্লাহ আল নোমান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে স্থানীয় রাজনীতি থেকে জাতীয় পর্যায়ে বিশিষ্ট গণনেতায় পরিণত হন। দেশ ও জনগণের কল্যাণে তিনি আজীবন নিষ্ঠার সাথে কাজ করেছেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচলে গেলেন আবদুল্লাহ আল নোমান
পরবর্তী নিবন্ধকাদা ছোড়াছুড়ি চললে সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে : সেনাপ্রধান