স্ট্যাম্প বিক্রিতে জালিয়াতি, অনিয়ম এবং জালিয়াতি করে তৈরি স্ট্যাম্প আদালতে দাখিলের অভিযোগে ফারুক আহাম্মেদ নামের কর্ণফুলীর শিকলবাহার এক বাসিন্দার বিরুদ্ধে আদালতের পক্ষ থেকে মামলা দায়ের হয়েছে। এতে অজ্ঞাতনামা স্ট্যাম্প ভেন্ডরদেরও আসামি করা হয়েছে।
গতকাল মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট–২ এর বেঞ্চ সহকারী এস এম শফিউল আজম বাদী হয়ে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট–১ এর বিচারক জুয়েল দেবের আদালতে মামলাটি দায়ের করেন। এর আগে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট–২ এর বিচারক মো. অলি উল্লাহ আসামিদের বিরুদ্ধে দন্ডবিধির ৪৬৭ সহ বিভিন্ন ধারা ও স্ট্যাম্প অ্যাক্টের ৬৯ ধারায় মামলা দায়েরের নির্দেশ দেন।
বেঞ্চ সহকারী ও মামলার বাদী এস এম শফিউল আজম আজাদীকে এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, আদালত অভিযোগটি গ্রহণ করে এফআইআর হিসেবে গণ্য করে তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন দাখিলের জন্য কোতোয়ালী থানাকে নির্দেশ দিয়েছেন। আদালত সূত্রে জানা যায়, সদরঘাট নৌ থানা পুলিশ গত ৪ মে রাতে ১২০০ কেজি চোরাই চিনিসহ একটি নৌকা জব্দ করে। এ ঘটনায় কর্ণফুলী থানায় পরদিন সাইফুল ও রাজ্জাক নামের দুজনের বিরুদ্ধে চোরাই মাল হেফাজতে রাখার অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করা হয়। এরপর গত ১৬ মে ফারুক আহাম্মেদ পুলিশের জব্দ করা উক্ত নৌকার মালিকানা দাবি করে নৌকাটি জিম্মা নেওয়ার জন্য আবেদন করেন। তিনি নৌকাটি স্ট্যাম্প মূলে ক্রয় করেছেন মর্মে দাবি করে ১০০ টাকা মূল্যমানের তিনটি নন–জুডিসিয়াল স্ট্যাম্প আদালতে দাখিল করেন। যা জালিয়াতির মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে। স্ট্যাম্পের তারিখ, সম্পাদনকারীদের স্বাক্ষর ও সাক্ষীদের স্বাক্ষর ছিল সন্দেহজনক। এ জন্য আদালত চট্টগ্রাম ট্রেজারি শাখা থেকে স্ট্যাম্প সরবরাহের তারিখ বিষয়ে রিপোর্ট তলব করেন। ট্রেজারি শাখা প্রতিবেদনে জানায়, স্ট্যাম্প তিনটি গত ৬ মে তারিখে চট্টগ্রাম ট্রেজারি থেকে সরবরাহ করা হয়েছে। কিন্তু জিম্মা আবেদনকারী ফারুক আহাম্মেদ জাল–জালিয়াতি ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে ক্রয়–বিক্রয়ের তারিখ গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর উল্লেখ করে স্ট্যাম্পগুলো খাঁটি হিসেবে আদালতে দাখিল করেন। নৌকাটিকে প্রতারণামূলকভাবে জিম্মা নেওয়ার জন্য এবং কর্ণফুলী থানার চোরাই মাল হেফাজতে রাখার মামলাটিকে নিষ্ফল করার অভিপ্রায়ে তিনি এই জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন।
বেঞ্চ সহকারী বলেন, জালিয়াতির মাধ্যমে তৈরি করা স্ট্যাম্প আদালতের নজরে পড়ার পর পরই ফারুক আহাম্মেদ এর জিম্মার আবেদন নামঞ্জুর করে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। স্ট্যাম্পে ভেন্ডরের নাম বা লাইসেন্স নম্বর উল্লেখ করা ছিল না। এ ঘটনায় অজ্ঞাতনামা স্ট্যাম্প ভেন্ডর জড়িত মর্মে আদালতের কাছে প্রতিয়মান হয়েছে। জিম্মার আবেদন শুনানি শেষে আদালতের দেওয়া আদেশে বলা হয়, মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ২য় আদালতে ইতিপূর্বেও প্রকৃত তারিখের পূর্ববর্তী তারিখ উল্লেখ করে সৃজিত অসংখ্য স্ট্যাম্প দাখিল করা হয়েছে। কিছু কিছু স্ট্যাম্পে বিক্রয়ের তারিখ নেই ও ক্রেতার নাম নেই। ঐ স্ট্যাম্পগুলোর কোনোটিতেই ভেন্ডরের নাম বা লাইসেন্স নম্বর নেই। প্রতিটি স্ট্যাম্পের পেছনে সদর মোকাম কালেক্টর, চট্টগ্রাম নামের সিল ছিল। ট্রেজারি শাখা, চট্টগ্রাম থেকে প্রতিবেদন নিয়ে দেখা গেছে ঐ স্ট্যাম্পগুলোর বেশিরভাগে প্রকৃত তারিখের পূর্ববর্তী তারিখ উল্লেখ করে বিক্রয় করা হয়েছে। ফলে, সদর মোকাম কালেক্টর, চট্টগ্রামের অধীন অজ্ঞাতনামা স্ট্যাম্প ভেন্ডররা সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধি লঙ্ঘন করে স্ট্যাম্প বিক্রয় করে সরাসরি জালিয়াতিতে জড়িত হচ্ছেন এবং ক্ষেত্র বিশেষে জালিয়াতির পথ তৈরি করে জালিয়াতিতে সহায়তা করছেন। কোনো কোনো ভেন্ডর ট্রেজারি থেকে সংগ্রহ করা স্ট্যাম্প বিক্রি না করে মজুদ রাখেন এবং দীর্ঘদিন পর অধিক মূল্যে ঐ পুরাতন স্ট্যাম্প বিক্রয়ের প্রকৃত তারিখের পূর্ববর্তী তারিখ উল্লেখ করে বিক্রি করেন।
আদালতসূত্র জানায়, ইতিপূর্বে এই ধরনের স্ট্যাম্প দাখিল করায় স্ট্যাম্প দাখিলকারী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ২য় আদালতের পক্ষ থেকে ৬টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। কিন্তু অজ্ঞাতনামা স্ট্যাম্প ভেন্ডরসহ অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা সনাক্ত না হওয়ায় ও আইনের আওতায় না আসায় একই ধরনের অপরাধের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। সমপ্রতি জাল স্ট্যাম্প দাখিলের প্রবণতা পূর্বের তুলনায় বেড়েছে।
আদালতের আদেশে আরও বলা হয়, স্ট্যাম্প ভেন্ডর কর্তৃক প্রকৃত তারিখের পূর্ববর্তী তারিখ উল্লেখ করে স্ট্যাম্প বিক্রয় বা বিক্রিত স্ট্যাম্পের পেছনে ও রেজিস্টারে ক্রেতার নাম–ঠিকানা, বিক্রয়ের তারিখ, ভেন্ডরের নাম ও লাইসেন্স নম্বর উল্লেখ না করা ইত্যাদি বিষয়ে যথাযথ তদারকি ও ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। সংশ্লিষ্ট ভেন্ডর ট্রেজারি শাখা থেকে কত তারিখে সরবরাকৃত স্ট্যাম্প কত তারিখে, কার কাছে বিক্রয় করেছেন সে বিষয়ে মাসিক বা বার্ষিক প্রতিবেদন ট্রেজারি শাখায় জমা দেওয়া বাধ্যকতামূলক করলে এই ধরণের জালিয়াতির পথ বন্ধ হতে পারে। স্ট্যাম্প ভেন্ডরদের লাইসেন্স প্রদান, লাইসেন্স নবায়ন ও লাইসেন্স বাতিল করার ক্ষেত্রে উপর্যুক্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। স্ট্যাম্প সরবরাহ, ক্রয়– বিক্রয়, হিসাব সংরক্ষণ ও তদারকিতে যথাযথ ব্যবস্থপনার মাধ্যমে সমস্যার স্থায়ী সমাধান হতে পারে। বিষয়টি অত্যন্ত জনগুরুত্ব সম্পন্ন। এ সংক্রান্ত অবগতি ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আদেশের কপি জেলা প্রশাসক ও ট্রেজারি অফিসার বরাবর প্রেরণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলেও জানান বেঞ্চ সহকারী এস এম শফিউল আজম।