করোনা আতংক ছড়িয়ে পড়ার ঠিক আগে–আগে প্রমিলা ক্রিকেট বিশ্বকাপের একটা বড় আসর বসেছিল অস্ট্রেলিয়ায়। আমাদের মেয়েরা ধারাবাহিকভাবে ব্যর্থতার স্বাক্ষর রেখেছে। তবে এ–নিয়ে তেমন খারাপ লাগেনি। বাংলাদেশের মেয়েরা ক্রিকেট খেলছে বিশ্ব আসরে, এটা কী চাট্টিখানি কথা! খেলছে ওরা– এটাই বড়। খেলতে থাকুক। সাফল্য আসবে একদিন। কখনও জিতবে, কখনও হারবে। এই তো জীবন!
কিন্তু খারাপ লেগেছে যা দেখে, কেবল খারাপ লাগা নয়, মনটাই ভেঙে গেছে, তা হল– খেলা নিয়ে আলোচনা সমালোচনা বাদ দিয়ে বাংলাদেশ প্রমিলা ক্রিকেট দলের অধিনায়কের চোখের সাজ গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে গেল। খবরে একবার দেখেছিলাম– সাংবাদিক সম্মেলনে কথা বলছে এক মেয়ে, খেলোয়াড়ের পোশাক পরা। ভেবেছিলাম– সদ্য চলচ্চিত্রে নাম লিখিয়েছে, হয়তো খেলোয়াড়ের চরিত্রে অভিনয় করছে। পর্দায় ভেসে ওঠে মেয়েটির পরিচয়; বাংলাদেশ প্রমিলা ক্রিকেট দলের অধিনায়ক।
স্তব্ধ হয়ে যাই মেয়েটির চোখের সাজ দেখে। গাল ঠোঁট রাঙাতেও ভুল হয়নি তার। চুলের সাজও দেখার মতো! গণমাধ্যম লুফে নেয় হরিণ চোখের জাহানারাকে। কাগজে সরাসরি লেখা হয়– খেলায় তেমন কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতে পারেননি; না ব্যক্তিগতভাবে, না অধিনায়ক হিসেবে। কিন্তু সবার মন জয় করে নিয়েছেন তিনি তার কাজল, মাস্কারা, আইলাইনার টানা চোখ দুটো দিয়ে। সাংবাদিক সম্মেলনে মুহুর্মুহু আলোর ঝলকানি আর করতালি। উপস্থিত সকলের মন কেড়ে নিয়েছেন আমাদের জাতীয় মহিলা ক্রিকেট দলের অধিনায়ক তাঁর ডাগর দুটি আঁখির কারণে। ছেলেবেলায় শোনা ‘চোখ যে মনের কথা বলে’– গানটা মনে পড়ছে। জাহানারার চোখও কী তার মনের কথা বলছেনা? ও’দুটি চোখ একজন ক্রীড়াবিদের হয় কেমন করে!
ক’দিন আগে কাগজে দেখলাম– পাকিস্তান ক্রিকেটের কিংবদন্তী মিয়াঁদাদ বর্তমান প্রজন্মের ক্রিকেট খেলোয়াড়দের চুলের সাজসজ্জা দেখে ওদেরকে চলচ্চিত্রে নাম লেখাতে পরামর্শ দিয়েছেন। বছর পাঁচেক আগে আমাদের মোস্তাফিজের আত্মপ্রকাশের সময়টার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। গ্রামদেশের সহজ সরল কিশোর; কাটার মেরে শিকার ধরে খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠত আন্তর্জাতিক আসরে। মাথা ভরা চুল, চকচকে তবে অযত্নে বেড়ে ওঠা। বেশ কিছুদিন পর আমাদের আদরের মোস্তাফিজ নতুন হেয়ারস্টাইল নিল। কেমন একটা ব্যক্তিত্বের খোলস বসে গেল চোখেমুখে। উইকেট বধের পর শিশুর মতো আর হাততালি দেয় না। তখনই কেন জানি মনে হল– বাংলাদেশ কাটার মাস্টারকে হারাতে বসেছে। আশা করি, আমার আশংকা ভুল প্রমাণিত হবে। কাটারে কাটারে উইকেট তুলে নিয়ে বিশ্বসেরাদের দলে নাম লেখাবে ফিজ। সময় বলে দেবে তিনি কতদূর কী করবেন আমাদের জন্য।
বলিউডের ‘দাঙ্গাল’ ছবির কথা বলা যায় প্রসঙ্গক্রমে । অলিম্পিকে সোনা জয়ী ভারতীয় কুস্তীগির গীতা ফোগাটের (বাবার) জীবনকাহিনী নিয়ে নির্মিত বর্ষসেরা চলচ্চিত্র ‘দাঙ্গাল’। গীতা’র বাবা হাতেকলমে মেয়েদেরকে কুস্তিবিদ্যা শিক্ষা দেন। তবে সবার আগে সৌন্দর্যচর্চার সব পথ বন্ধ করে দেন। বাবা ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন সৌন্দর্য আর প্রতিভার বিকাশ একসঙ্গে হয় না। তাই সবার আগে মেয়েদের চুল ছোট করে দেন। সূর্য ওঠার আগ থেকে শুরু হয়ে যায় শরীরচর্চা। সাফল্য আসতে থাকে ধারাবাহিকভাবে। স্থানীয় পর্যায় থেকে জাতীয় পর্যায়ে সাফল্যের স্বাক্ষর রাখে গীতা। বাবার স্বপ্ন ডালপালা মেলতে থাকে; যেতে হবে আন্তর্জাতিক আসরে। উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য শহরের সেরা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভর্তি করিয়ে দেন মেয়েকে। শহুরে হাওয়া গায়ে লাগলে যা হয়; একটু সাজতে মন চায়, রমণীয় মোহনীয় হিসেবে নিজেকে সবার মধ্যমণি করার জন্য মুখিয়ে থাকে। গীতা চুল বড় করে, হাতের নখে রঙ লাগায়। ফলাফল প্রশিক্ষণে পর্যাপ্ত সময় দেওয়া হয়না, নিরবচ্ছিন্ন একাগ্রতাও আসেনা আসল কাজে। এমনকি বাবার শেখানো বিদ্যা ও কলাকৌশলকেও সেকেলে বলে বাতিলের খাতায় ফেলে দেয়। কর্মফল তৎক্ষণাৎ পেয়ে যায় সে হাতেহাতে– ধারাবাহিক ব্যর্থতা। বাড়ি গেলে মনঃক্ষুণ্ন হন বাবা মেয়ের সাজপোশাক দেখে। নিজের ভুল বুঝতে পেরে রূপচর্চার সামগ্রী সব ফেলে দিয়ে আগের মতো প্রশিক্ষণে মনোনিবেশ করে গীতা। এরপরই হাতে ওঠে সেই অধরা সোনা।
বাংলাদেশ প্রমিলা ক্রিকেটের অধিনায়ককে নিয়ে কথা হচ্ছিল। আমাদের জাহানারা ‘দাঙ্গাল’ থেকে কোন শিক্ষা নেবেন কিনা জানিনা। তবে আগামী দিনের মেয়েরা খেলোয়াড়ের খাতায় নাম ওঠাতে চাইলে সাজপোশাক ও রূপচর্চায় মনযোগ ঢেলে না দিয়ে শরীরচর্চা ও প্রশিক্ষণে আত্মনিয়োগ করবে– এই আশা করতে চাই। সাজতেই যদি হয় তবে নাম লেখাও চিত্রপুরিতে। মাশরাফিদেরকে টাইগার বলা হলে জাহানারা ও তার দলকে নিশ্চয় টাইগ্রেস বলা যায়। তবে হরিণ চোখের বাঘিনী দিয়ে কোন কাজ নেই বাংলাদেশের।
জাহানারার প্রতি কোন ব্যক্তিগত বিদ্বেষ নেই। তবে ভয়টা অন্য কোথাও। আগামী দিনের প্রমিলা ক্রিকেটাররা জাহানারাকে অনুসরণ করবে, জীবনাদর্শ হিসেবে বেছে নেবে, ওর মতো হওয়ার জন্য স্বপ্ন দেখবে, যেমন করে মাশরাফিকে জীবনের নায়ক মেনে অনেক খেলোয়াড় উঠে আসছে বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে। কলসিন্দুরের এক ঝাঁক কিশোরী দারুণ সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়ে আমাদেরই অবহেলায় কেমন করে নাই হয়ে গেল আমাদের ক্রীড়াঙ্গন থেকে। এ–পর্যায়ে রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে রূপবতী ক্রীড়াবিদ পোষার মতো বিলাসিতা আমরা বরং না–ই করি।
রূপচর্চা ও সাজসজ্জায় কোন অপরাধ নেই। যে রাঁধে সে কী চুল বাঁধেনা? কিন্তু চুল বাঁধতে গিয়ে হাঁড়ির খাবার পুড়ে ছাই হয়ে গেলে পরিবারসুদ্ধ উপোষ দিতে হয়। জরিন ফিতার খোঁপা কিংবা দীঘল বিনুনি কিংবা কাজল টানা ডাগর আঁখির সৌন্দর্য দিয়ে আর যাই হোক পেট পুজো অন্তত চলবেনা।
পুনশ্চ: করোনাকালের ঈদুল ফিতরের রাতে টেলিভিশনের অর্ধশত ইষ্টিশনে জমকালো ভাঁড়ামোপূর্ণ আয়োজন থেকে চোখ ফিরিয়ে মুঠোফোনে খবরের কাগজ দেখি। আঁতকে উঠি ছোট্ট একটি সংবাদ দেখে। না, সরকারি হিসেব মতো ঈদের দিনে করোনায় মৃত্যু পাঁচশ ছাড়িয়েছে বলে নয়। মাত্র পনের হাজার একশ টাকায় প্রকৌশলী হত্যার নীল নকশা রচিত হয়েছিল বলেও নয়। আমরা বাঙালিরা অযাচিত মৃত্যুর খবরে আজকাল বড় বেশী বিচলিত হইনা। আঁতকে উঠি যে খবরটা দেখে তা হল– বাংলাদেশ প্রমিলা ক্রিকেট দলের অধিনায়কের ওপর রচিত সচিত্র প্রতিবেদনে। শিরোনামটা অনেকটা এরকম– ছেলেদের ‘ক্রাশ’ হতে পেরে তিনি আনন্দিত। এ বিষয়টা নিয়ে বিশদ আলোচনার অভিরুচি নেই। নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া যেন তাঁর চিরায়ত শ্বেতশুভ্র স্বর্গীয় রূপে আমার সামনে এসে উপবিষ্ট হলেন। তাঁর স্বপ্নের নারীমুক্তি এমন করে প্রসাধন আর সাজসজ্জার আভরণে ঢাকা পড়ে যাওয়ায় মৃদু ভৎসনা করেন তিনি।
নারী কেবল শিক্ষকই নয়, বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, বৈমানিক ও প্রশাসকের আসনে বসবে কেবল তারা আছে তা জানান দিতে নয়, বরং সমাজ, দেশ, জাতি ও পৃথিবীর মঙ্গলে ভূমিকা রাখতে। একইভাবে নারীক্রীড়াবিদেরও সমাজের প্রতি, জাতির প্রতি সর্বোপরি নিজ সমপ্রদায়ের প্রতি দায়িত্ব আছে, আছে দায়বদ্ধতা। আমাদের মতো অনগ্রসর সমাজে প্রত্যন্ত অঞ্চল হতে এতদুর আসতে জাহানারাকে নিশ্চয় কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। তিনি আগামীদিনের স্বপ্নবিলাসী মেয়েদের পথ প্রদর্শক হয়ে গৌরব বোধ করবেন। হরিণ চোখের বাঁকা চাহনির তীরে শত সহস্র যুবকের ঘুম কেড়ে নিয়ে যদি তিনি আত্মতৃপ্তিতে ভোগেন তবে খেলার জগতকে বিদায় জানানোটাই বোধকরি তাঁর জন্য সমীচীন হবে।