চোখের জলে তামিম বললেন ‘বিদায়’

অবসর ঘোষণার পেছনে কারণ না খোঁজার অনুরোধ

নজরুল ইসলাম | শুক্রবার , ৭ জুলাই, ২০২৩ at ৫:৪৫ পূর্বাহ্ণ

বুধবার রাত তখন প্রায় সাড়ে ১১টা। জহুর আহমদ চৌধুরী স্টেডিয়াম থেকে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ খেলে হোটেলে ঢুকলেন তামিম এবং বাংলাদেশ দল। এরপর সবাই যার যার মত ঘুমিয়ে যাওয়ারই কথা। কারণ খেলার ক্লান্তি আর হারের ক্ষত মিলিয়ে রাতটা নিশ্চয় ক্লান্তিকরই ছিল তাদের। তবে তামিম যে সে রাতে ঘুমাননি সেটা একরকম নিশ্চিতই বলা চলে। কারণ পরদিন অর্থাৎ গতকাল তামিম যেন কিছু বলতে চেয়েছিলেন সাংবাদিকদের। বৃহস্পতিবার ভোর হতেই দেশের ক্রিকেটাঙ্গন সরব হয়ে ওঠে। চারদিক থেকে ভেসে আসছিল তামিম ইকবাল নাকি সংবাদ সম্মেলন করছে? সময় যতই গড়াচ্ছিল ততই নানা আলোচনার ডালপালা মেলছিল। এরইমধ্যে সংবাদ সম্মেলনের সময় এবং স্থান দুটোই পরিবর্তন হয়ে গেল। বেলা ১২টার জায়গায় করা হলো দুপুর দেড়টা। আর রেডিসনের পরিবর্তে ভেন্যু নির্ধারিত হলো টাওয়ার ইন। কি বলবেন তামিম? কেন এই সংবাদ সম্মেলন?

নানা জনের মন্তব্য থেকে ভেসে আসছিল নানা কিছু। সংবাদকর্মীদের অপেক্ষা যেন শেষ হচ্ছিল না। হোটেল টাওয়ার ইনের জনাকীর্ণ কৃঞ্চচূড়া হলে তখন সাপের জিভ চালানোর মত জায়গাও নেই। সবার অপেক্ষা কখন আসবেন তামিম। কি বলবেন তিনি? ওয়ানডে ছাড়ার ঘোষণা দেবেন? নাকি ছাড়বেন অধিনায়কত্ব?

ঠিক দুপুর দেড়টায় সংবাদ সম্মেলন কক্ষে প্রবেশ করলেন তামিম। ব্যক্তিগত গাড়িতে করে সংবাদ সম্মেলনে আসার আগে ছেড়ে দেন রেডিসন হোটেলে তার জন্য বরাদ্দকৃত কক্ষটি। গায়ে কালো টিশার্ট আর মাথায় হলুদকালোর কম্বিনেশনে তৈরি টুপি। হাতে কয়েকটা টিস্যু। চোখ জোড়া লাল। বুঝাই যাচ্ছিল কান্না করতে করতেই এসেছেন তিনি। কিন্তু তখনো বুঝার কোনো উপাই ছিল না তামিম কি ঘোষণা দেবেন।

বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রথম কথাটাই বললেন, ‘গতরাতে আফগানিস্তানের বিপক্ষে আমি আমার ক্যারিয়ারের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচটি খেলে ফেলেছি।’

এই কথা শোনার সাথে সাথে সংবাদ সম্মেলন কক্ষের আবহটাই পাল্টে গেল। সবাই হতভম্ভ হয়ে গেলেন। একি শোনালেন তামিম। কি শুনতে আসলাম আর কি শুনলাম। এরপর তামিম কথা বলেছেন সাড়ে ১১ মিনিট। যেখানে তিনি কেবলই কেঁদেছেন আর কেঁদেছেন। দ্বিতীয় যে কথাটি তামিম বলতে শুরু করেছিলেন সেটি হচ্ছে– ‘আমি আমার বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে ক্রিকেট খেলতে এসেছিলাম’। এই কথাটি শুরু করে শেষ করতে পারেননি। অঝোরে কেঁদেছেন। অন্তত টানা দেড় মিনিটের মত টেবিলে মাথা রেখে কেঁদেছেন তামিম। আবার মাথা তুলেছেন। একটু পানি পান করেছেন। নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু গলা দিয়ে যেন কথা বের হচ্ছিল না। তারপর বললেন আমার বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে আমার চাচা আকবর খান আমার হাতে প্রথম ক্রিকেট বল আর ব্যাট তুলে দিয়েছিলেন। তার হাত ধরেই ক্রিকেট বলে আমি প্রথম টুর্নামেন্ট খেলি। আর ছোট বেলায় ক্রিকেট শিখেছি আমার প্রথম কোচ তপন দত্তের কাছে। এরপর কাটিয়ে দিয়েছি ১৬ বছর ৪ মাস। এই সময়ে কতটা সবার প্রত্যাশা পূরণ করতে পেরেছি জানি না। তবে আমি সবসময় আমার শতভাগ দিয়ে খেলার চেষ্টা করেছি। আমি সবসময় নিজেকে উজাড় করে দিয়ে খেলার চেষ্টা করেছি। আমি যখন মাঠে নেমেছি তখন শতভাগ দিয়েছি। সবসময় দেওয়ার চেষ্টা করেছি।

দীর্ঘ এই পথ চলায় আমার পরিবার, সংবাদ কর্মী, আমার মা, ভাই, বোন, স্ত্রী, দুই সন্তান, সর্বোপরী আমার দেশের অগণিত ক্রিকেট ভক্তের সমর্থন পেয়েছি। আমি যে হঠাৎ করেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি তা কিন্তু নয়। বেশ কিছুদিন ধরেই আমি এটা নিয়ে ভাবছিলাম। আমার পরিবারের সঙ্গে কথা বলে ঠাণ্ডা মাথায় আমি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং সেই ঘোষণাই এখন দিচ্ছি।

অঝোরে কেঁদে কেঁদে তামিম বললেন, এই দীর্ঘ ক্যারিয়ার চলাকালে আমার সন্তানেরা আমাকে সবচাইতে বেশি মিস করেছে। তামিম বলেন, আমি সবসময় মনে করি এবং বিশ্বাস করি ব্যক্তির চাইতে দল বড়। আমি মনে করি আমার এই সিদ্ধান্ত দলের কোনো ক্ষতি করবে না। আর সবাই বাংলাদেশ দলকে, বাংলাদেশের ক্রিকেটকে সমর্থন দিয়ে যাবেন। কারণ আমরা সবাই বাংলাদেশের ক্রিকেটের মঙ্গল এবং উন্নতি কমনা করি। আমার অবসর ঘোষণার পেছনে কোনো ধরনের কারণ খোঁজারও চেষ্টা করবেন না। আমি এটাকে এখানেই শেষ করতে চাই।

সাংবাদিকদের অনুরোধ করে তামিম বলেন, বাংলাদেশ দলের হয়ে যারা ক্রিকেট খেলছে তাদের নিয়ে আপনারা লিখবেন। তবে আপনাদের লেখনীতে যেন লিমিট ক্রস না হয়। আমরা অনেক সময় নিজেদের বাউন্ডারির বাইরে নিয়ে যাই। সেটি করতে গিয়ে একজন ক্রিকেটারের ক্ষতি করবেন না। সামনে বিশ্বকাপ রয়েছে; আমরা, আপনারা সবাই মিলে বাংলাদেশ দলের অংশ হয়ে থাকব সে আশাই করি। তাছাড়া আফগানিস্তানের বিপক্ষে আমাদের আরো দুটি ওয়ানডে ম্যাচ রয়েছে এই সিরিজে। সে দুটি মাচে জিতে আমরা সিরিজ জিতব তেমনটাই আশা করি। দলের জন্য সবসময় শুভ কামনা থাকবে আমার। কারণ এই দলটির হয়ে আমি ১৬ বছরের বেশি খেলেছি।

আমি বারবার বলেছি আমি আমার বাবার স্বপ্ন পূরণ করতেই ক্রিকেট খেলি। জানি না কতটা সফল হয়েছি। এই কথা বলতে গিয়ে বারবার অঝোরে কেঁদেছেন বাবার অতি আদরের ছোট ছেলে তামিম। তিনি বলেন, হয়তো তিনিও আজ আমার জন্য গর্ববোধ করবেন। আমি আসলে আজকে আর বেশি কিছু বলতে চাই না। বলার মত অবস্থায়ও নেই। অনেক কথা বলার ছিল বা বলতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু বলতে চাই না। আমি এখানেই শেষ করতে চাই।

আজ আমি ধন্যবাদ জানাতে চাই আপনারা যারা সংবাদ কর্মী আছেন তাদের। যারা আমাকে ক্রিকেটার হওয়ার পথে সহায়তা করেছে, মানবিক মানুষ হওয়ার পথে সহায়তা করেছে তাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানাই। আমার অধিনায়ক যাদের অধীনে আমি খেলেছি, আমার টিমমেট যাদের সঙ্গে আমি খেলেছি, তারা সবাই আমাকে যথেষ্ট সহায়তা করেছে। আমি সবার কাছে কৃতজ্ঞ। আমি আবারো বলেছি আমার আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ার যেমন এখানেই শেষ তেমনি আমার অবসরের কারণ কিংবা ভাবনা সবকিছুরই ইতি টানছি এখানে। আমার আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ারের সমাপ্তি ঘোষণা করছি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধতামিমের অবসর স্বেচ্ছায় নাকি চাপে, প্রশ্ন মাশরাফির
পরবর্তী নিবন্ধএখন এডিস মশা কামড়ায় দিনে-রাতে সমানে