চেনা গানের অচেনা গীতিকার

শাহরিয়ার আদনান শান্তনু | সোমবার , ১ জুলাই, ২০২৪ at ১০:৫৫ পূর্বাহ্ণ

ভালো লাগে জোছনা রাতে

মেঘ হয়ে আকাশে ভাসতে

ধানের শীষে বাতাস হয়ে

কৃষাণীর মন ছুঁয়ে যেতে

ভালো লাগে রোদ হয়ে

ঐ পাখির ডানা ছুঁয়ে খেলতে

রেনেসাঁ ব্যাণ্ডের তুমুল জনপ্রিয় একটি গান। এই গানটি যখনই শুনি, এক স্নিগ্ধ সুন্দর জোছনা রাতে চলে যাই। যেমন গানের কথা, তেমনই সুর। আর তেমনই আবেগী কণ্ঠ। বরেণ্য সুরকার ও গায়ক নকীব খানের সুরে ও কণ্ঠে আমরা গানটি আজও শুনছি। রেনেসাঁর প্রথম এলবামে এই গানটি আছে। কিন্তু কার লেখানাম ছিল না। আরও অনেক বছর পর জানতে পারি এই গানটি লিখেছেন ডা. আরিফ। কে এই আরিফ? আশি / নব্বই দশক পেরিয়ে গেল। ডা. আরিফকে জানা গেল না। অবশেষে একসময়ে জানলাম, তিনি গায়ক নকীব খানের বন্ধু। বিদেশে থাকেন। তখনও নকীব ভাইয়ের সাথে পরিচয় হয়নি। বাংলাদেশের বিখ্যাত এই গুণী সংগীতশিল্পীর সান্নিধ্যে আসা হয়নি। এরপর কেবল অপেক্ষা। আর অপেক্ষায় থাকতাম, যদি সুযোগ হয় আরিফ ভাইয়ের সাথে পরিচয়ের।

করোনাকালে অনলাইনে একটি গানের অনুষ্ঠান করছিলাম বরেণ্য সংগীত শিল্পী নকীব ভাইয়ের সাথে। তখনই ফেরদৌসী খান স্বপ্না নামের একজন অনলাইনে অনুষ্ঠানটি উপভোগ করছিলেন। তিনি লিখলেন: আমি ডা. আরিফের স্ত্রী। এই গানটি আমার স্বামীর লেখা। দারুণ উপভোগ করছি অনুষ্ঠানএই ধরনের মন্তব্য পড়ে চমকে যাই। যাক, অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সূত্র পাওয়া গেছে। এবার স্বপ্নার সাথে যোগাযোগ হলো। দেখা গেল, স্বপ্না আমাদেরই ব্যাচমেট। ব্যস, এর বছর খানেক পরে ফেসবুকে আলাপন এবং ডা. আরিফ ভাইয়ের সাথে আলাপচারিতা।

আরিফ ভাই আশির দশকে অনেক জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা। একসময়ে আমরা গানগুলো শুনতাম, গাইতাম। এখনো গাইছে সেই গান। ডা. আরিফের লেখা জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে আছে

#ভালো লাগে জোছনা রাতে (রেনেসাঁ)

#আচ্ছা কেন মানুষগুলো এমন হয়ে যায় (রেনেসাঁ)

#ও নদীরে তুই যাস কোথায় রে (রেনেসাঁ)

#ঐ ঝিনুকফোটা সাগর বেলায় (সামিনা চৌধুরী)

#নন্দিতা তোমার কথা আমি ভুলিনি এখনো (শেখ ইশতিয়াক)

#ওগো হরিণী চোখের মনোহরিণী (শেখ ইশতিয়াক)

#এলোমেলো বাতাসে উড়িয়েছি শাড়ির আঁচল (বেবী নাজনীন)

#ও বন্ধুরে তুই কত দূরে (বেবী নাজনীন)

#আমি মুঠোর ভেতর পদ্ম নিয়ে (তপন চৌধুরী, সোলস)

#শাল পিয়ালের বনে কাছে এসেছিল (কুমার বিশ্বজিৎ)

#একদিন ফুলের বনে একটি গোলাপ তুলতেই (তপন চৌধুরী)

#জোছনায় আমি কিছু কাশফুল তোমার জন্য তুলেছি (নকীব খান)

আশির দশকের তারুণ্যবেলার এই গানগুলো মাতিয়ে রেখেছিল। এবং এটাও বলা যায়, এখনো নস্টালজিক হয়ে যাই। সবচেয়ে বড় কথা, এখনো গানের কনসার্টে, বিভিন্ন টিভি অনুষ্ঠানে গানগুলো গাইছে এই প্রজন্মের শিল্পীরা। এমন বিষয়টি কেমন লাগে আরিফ ভাইয়ের কাছে জানতে চাইলাম। তিনি বললেন: “আজও আমার লেখা গান মানুষ গায়, শোনে এটা কখনোই ভাবিনি। অবাক লাগে।” আসলেই তাই। আমাদেরও অবাক লাগে। ভালো লাগে। এত সমৃদ্ধ কথা, এমন সুন্দর মনকাড়া সুর ও গায়কীতে আজও নেশাগ্রস্ত হয়ে আছি।

ডা. মোহাম্মদ আরিফ। জন্ম ১৯৫৯ সালের ৪ জুন। চট্টগ্রাম শহরের চন্দনপুরায় বেড়ে ওঠেন। মডেল কিন্ডার গার্ডেন স্কুল, এম.ই স্কুল (চট্টগ্রাম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়), কাজেম আলী স্কুল, চট্টগ্রাম কলেজে লেখাপড়া করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এম.বি.বি.এস ডিগ্রি অর্জন করেন। তারপর বিদেশ গমন। প্রথমে ইরান, পরে সৌদি আরব।

আরিফ ভাইয়ের লেখালিখি শুরু একেবারেই স্কুল জীবন থেকেই। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়াকালীন সময় থেকেই কবিতা লিখেছেন। পরে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়াকালীন সময়ে প্রথম ছোট গল্প ও কবিতা প্রকাশিত হয় পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায়। লেখালেখির শুরুটা এভাবেই হয়। যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের পড়ছেন, তখন ছোট্ট বেলার বন্ধু নকীব খান তাঁকে গান লেখার কথা বলেন। জীবনের প্রথম গান লেখার ঘটনাটা ছিল এমন

১৯৮০ সালের শেষের দিকে একদিন রাতে ট্রেনে করে ঢাকা যাচ্ছি। ছুটে যাচ্ছে ট্রেন। দুই পাশে ছিল ধানের ক্ষেত। আমি এসব দেখে লিখে ফেললাম গানের মুখটা :

ভালো লাগে জোছনা রাতে

মেঘ হয়ে আকাশে ভাসতে

খসড়া গানটি ট্রেনেই লেখা হলো। পরে শেষ অন্তরায় একটু আটকে যাই। নকীব সহায়তা করলো। এভাবেই আমার গান লেখা শুরু। ”

তারপর তো বাকীটুকু ইতিহাস হয়ে আছে। রেনেসাঁ, নকীব ভাই কিংবা অন্য শিল্পীরা এখনো গানটি গাইছেন।

আচ্ছা কেন মানুষগুলো এমন হয়ে যায়”এই গানটিও চমৎকার ও সুপারহিট গান। ব্যতিক্রমী কথা ও সুর। এই গানটি সম্পর্কে জানার আগ্রহ আমার। আরিফ ভাই জানালেন, “এই গানটি লিখেছি ১৯৮৪ সালের জুলাই মাসে। ধানমন্ডির পাঁচ নম্বরের উল্টো দিকে মীরপুর রোডে প্রখ্যাত গায়ক ফেরদৌস ওয়াহিদের একটি রেকর্ডিং স্টুডিও ছিল। নকীবের গানের রেকর্ডিং চলছিল। সেখানে আমি বসেছিলাম। হাতে কলম ও ডায়েরি। হঠাৎই এই গানের কথা মনে আসলো। মাত্র পাঁচ মিনিটেই গানটি লিখে শেষ করি। নকীব তাঁর গান রেকর্ডিংয়ের মাঝখানে ফ্রি হলে, তাঁকে গানটা দেখালাম। ও পড়ে বললো: এটি দারুণ গান হবে। সুপারহিট হবে। পরে দেখলাম, সত্যিই হিট হয়ে গেল এই গানটি।”

আরিফ ভাইয়ের আরেকটি জনপ্রিয় গান

ঐ ঝিনুকফোটা সাগরবেলায়

আমার ইচ্ছে করে

আমি মন ভেজাবো ঢেউয়ের মেলায়

তোমার হাতটি ধরে। ”

নকীব খানের সুরে গেয়েছেন সামিনা চৌধুরী। এই গানটি আরিফ ভাই লিখেছেন তাঁর স্ত্রী ফেরদৌসী খান স্বপ্নাকে নিয়ে। ভীষণ রোমান্টিক গান। তাই কৌতূহল ছিল প্রচন্ড। আরিফ ভাই সেই কৌতূহলও মেটালেন জানিয়ে।” গানটি লিখি ১৯৮৪ সালের নভেম্বর মাসের শেষের দিকে। তখন স্বপ্নার সাথে বিয়ের কথাবার্তা চলছে। আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল বিয়ের পর ওকে নিয়ে কক্সবাজার যাবো। বিয়ে হলো। কিন্তু আমরা চলে গেলাম ইরান। কক্সবাজার আর যাওয়া হলো না। অবশেষে দশ বছর পর ১৯৯৬ সালে ইরান থেকে দেশে ফিরে স্বপ্নাকে কক্সবাজার গেলাম। আর ঐ সময়ে আমার গানটি নকীব সুর করেছে। সে তখন সামিনা চৌধুরীর প্রথম অডিও ক্যাসেটের কাজ করছিল। ঐ ক্যাসেটে আমার লেখা চারটি গান আছে। যার মধ্যে একটি হলো এই গানটি।”

আরিফ ভাই এবং নকীব ভাই এই যুগলের মেলবন্ধনটা গানের জগতকে সমৃদ্ধ করেছে। প্রখ্যাত সুরকার মকসুদ জামিল মিন্টুও আরিফ ভাইয়ের লেখা গান সুর করেছেন। প্রয়াত গায়ক ও সুরকার শেখ ইশতিয়াকও গেয়েছেন। গেয়েছেন তপন চৌধুরী, কুমার বিশ্বজিৎ, বেবী নাজনীন, সামিনা চৌধুরী।

এমনসব জনপ্রিয় গানের গীতিকবি মোহাম্মদ আরিফ পেশাগত জীবনে চিকিৎসক হয়ে পাড়ি জমালেন ইরান। পরে সৌদি আরব। কাজের ব্যস্ততায় আর লেখা হয়নি। আর লিখলেও দেশে না থাকায় সুরকারের কাছে পৌঁছেনি তাঁর লেখা গান / কবিতা। ফলে আমরা বঞ্চিত হলাম দারুণ সমৃদ্ধ গান থেকে। আরিফ ভাই এখন কানাডার নিউ ফাউন্ডল্যান্ডে বসবাস করছেন। এখন আর গান/কবিতা লেখা হয়ে উঠছে না। পেশাগত ব্যস্ততা এবং প্রবাসে থাকার কারণে বিশাল বিরতি হয়ে গেছে। আমরা আশা করবো, আরিফ ভাই আবারও সেই আগের মতো গান নিয়ে উপস্থিত হবেন আমাদের মাঝে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ – এর অন্ত্যমিল
পরবর্তী নিবন্ধআমাদের বাতিওয়ালা