মহা বিদ্রোহী রণক্লান্ত/ আমি সেই দিন হবো শান্ত/ যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না। উৎপীড়িত, অত্যাচারিত, মানুষের পক্ষে একসাহসী কন্ঠের দৃপ্ত উচ্চারণের জিজ্ঞাস্য দৃষ্টি নিয়ে হাজির হয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যে। ধুমকেতুর মতো উত্থান ঘঠেছিল এক বিদ্রোহী চেতনার, সেই চেতনা ছিল মানবতার লাঞ্চনার বিরুদ্ধে, ধর্মের ছদ্ধবেশী আচরণের প্রতিবাদে, শোষণ শাসন ও ত্রাসের বিস্তার রোধে,অসাম্যের নির্লজ্জ উদ্ধত আস্ফালনে, পরাধীনতার নাগপাশ বন্ধনে, কৃত্রিমতা দূরীকরণে এক সোচ্চার জাগরণজনিত প্রতিবাদমুখর চেতনা, সেই প্রতিবাদী চেতনা সমূহ সবার অন্তর আত্মায় প্রোথিত হয়ে গেঁথে রয়েছে আমাদের বিদ্রোহী কবি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর চেতনা, যা প্রবাদ প্রতীক লাইন হয়ে আছে চেতনায় নজরুল।
নজরুল একাধারে সাহিত্যিক, দেশপ্রেমিক, সৈনিক, দার্শনিক, রাজনীতিবিদ সাংবাদিক, সম্পাদক, সংগীতজ্ঞ, সুরকার, কম্পোজার, চলচিত্রকার অভিনেতা, গায়ক, কবি এবং সর্বোপরি বিদ্রোহী কবিতার স্রষ্টা বিদ্রোহী কবি। নজরুল সর্বোতভাবে একজন অসামপ্রদায়িক মানবিক সাম্য চেতনার মানুষ যিনি একাধারে ধার্মিক, নিজধর্ম এবং পরধর্মের প্রতিও সমান শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তি।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর ডাক নাম ছিল দুখু মিঞা। ১৮৯৯সালের ২৪ মে এক নিতান্ত দরিদ্র পরিবারে তার জন্ম। পিতা ধর্মপ্রাণ ফকির আহমদ, মাতা জাহেদা খাতুন। শৈশবে তিনি পিতৃহারা হন। সীমাহীন দারিদ্র আর অনিশ্চয়তার মধ্যেও পিতার উদার ও উন্নত আদর্শই ছিল তার জীবন সংগ্রামের হাতিয়ার। ধর্ম বিষয়ে পিতার উদারতা তার মনকে পরিশীলিত করেছিল। মানবতার মহামন্ত্রের দীক্ষা তাঁর এখানেই।তিনি সর্বগ্রাসী ক্ষুধা নিয়ে পাঠ করেছেন কোরাণ,-রামায়ণ–মহাভারত ভাগবত–পুরাণ–কথকথা–ব্রতকথা, যাত্রাগান।উর্দু,আরবী–ফারসী–সংস্কৃত ভাষা পাঠেও তাঁর আগ্রহ ছিল প্রচুর।সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন বাউল–সুফী–ফকির–সাধু–সন্ন্যাসীর। তিনি ছিলেন উদাত্ত কণ্ঠের অধিকারী। ছিল তার রাগ রাগিনীর অনায়াস দক্ষতা।.১২ বছর বয়সে চরম দারিদ্রের বোঝা মাথায় নিয়ে পড়াশোনা ছেড়ে গান বাঁধার জন্য লেটোর দলে যোগ দিয়েছিলেন। গান বাঁধলেন, সুর দিলেন।এভাবেই তাঁর জীবন নদী এক বন্দর থেকে আরেক বন্দরে ভেসে চলছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন দশম শ্রেণির ছাত্র, সবে প্রি টেস্ট দিয়েছেন, দেশপ্রেমের কী এক উন্মাদনায় সৈনিক হিসাবে ৪৯নং বেঙ্গলী রেজিমেন্টে যোগ দিলেন।এরপর যুদ্ধ শেষ হলে অবসান হলো সৈনিক জীবনের।কিন্তু হৃদয়ে তাঁর রক্তাক্ত স্মৃতি, রচনা করলেন ‘রিক্তের বেদন’। লিখলেন, ‘বাউন্ডুলের আত্মকাহিনী’। কালবৈশাখীর প্রমত্ততা নিয়ে বাংলা কাব্য সাহিত্যে আবির্ভূত হলেন। কাজে লাগালেন তার ছোট বেলার পঠিত এবং অধীত জ্ঞান তথা রামায়ণ, পূরাণ, কোরাণ, মহাভারত, ফারসী, আরবী, বাংলা সংস্কৃত বিচিত্র শব্দ বৈভব।এভাবে মাত্র ২২বছর বয়সে ১৯২১ সালে রচনা করলেন ১৪৭ লাইনের ল্যান্ড মার্ক কবিতা’ বিদ্রোহী’ কবিতা,যে কবিতায় ছিল বরফ শীতল রক্তে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়ার উপকরণ।
বিদ্রোহী এমন একটি কবিতা যার তাৎপর্য ও প্রাসংগিকতা অপরিসীম,অম্লান ও চিরভাস্বর। আর এই কবিতার জন্য নজরুল হয়ে গেলেন বিদ্রোহী কবি। এই কবিতাটি একটি জাতির বিশুদ্ধ আবেগকে আত্মীকরন করে জাতির আত্মজাগরণের মন্ত্র রূপে আবির্ভূত হয়েছিল।কবি এই কবিতাটি মাঝ রাত থেকে ভোর রাত পর্যন্ত কাট পেন্সিল দিয়ে লিখেছিলেন, কারণ তিনি লেখার সময় এত একনিষ্টতায় বিভোর ছিলেন যে, তিনি মনে করেছিলেন, যদি কলম ব্যবহার করে লেখেন, তবে বার বার কালিতে কলম ডোবাতে হবে, এতে কবির মনসংযোগ নষ্ট হবে। এভাবে দীর্ঘ ১৪৭ লাইনের কবিতা তিনি সৃষ্টি করলেন। ভোর রাতে লেখা শেষ করার পর কাউকে পড়ে শোনানোর জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিলেন।অবশেষে এক বন্ধুকে পড়ে শোনালেন।ঐ মাসেই ১৩২৮ বঙ্গাব্দের সাপ্তাহিক বিজলী পত্রিকার পৌষ সংখ্যায় প্রথম কবিতাটা ছাপা হয়। পরে ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থে এই কবিতাটি দ্বিতীয় কবিতা হিসাবে প্রকাশিত হয়।কবিতাটি যে কবির হৃদয়ের আন্তরিক আকুলতায় ভরা তার প্রমাণ কবিতায় ৫৬ বার আমি শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। ‘আমিকে’ প্রচন্ড শক্তি হিসাবে অত্যাচারিত শাসনের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছেন। এখানে ‘বলো’ শব্দটিও অনেকবার বেশ জোড়ালো ভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। ‘আবার বিদ্রোহী কবিতা যে শুধু ক্রোধ ও প্রতিবাদের তাও নয়, এটি আবেগের, ভালোবাসার ও আত্মজাগরণেরও নাম। এটি প্রকৃতি, মানুষ ও সৃষ্টিকর্তার কাছে তর্জনী উঁচিয়ে জিজ্ঞাসারও নাম, আবার ভালোবাসার ও প্রেমেরও নাম। যেমন, ‘আমি অভিমানী চির–ক্ষুব্ধ হিয়ার কাতরতা ব্যাথা সুনিবিঢ়/চিত চুম্বন চোর কম্পন আমি থর–থর–থর প্রথম পরশ কুমারীর।/আমি গোপন প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল করে দেখা অনুক্ষণ/আমি চপল মেয়ের ভালোবাসা,তার কাঁকন চুড়ির কনকন।’ এভাবে তাঁর অমর সৃষ্টিকর্ম আমাদের কাছে বিস্ময় হয়ে আছে।
নজরুল বিদ্রোহের কবি, প্রতিবাদের কবি, তারুণ্যের কবি।সাহিত্যে তিনি বিদ্রোহী, গানে বুলবুল। নজরুল বিভিন্ন রকমের প্রায় তিন হাজার গান, কবিতা, হামদ, নাত, গজল, বিভিন্ন বই, সংবাদপত্র, ফিল্ম তৈরীসহ বিভিন্ন বৈচিত্রময় সৃজনশীল কাজ দ্বারা বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতিকে অকাতরে সমৃদ্ধ করে গেছেন। নজরুল তার সময়ের চেয়েও অনেক বেশী অগ্রসর ছিলেন।এটাই ছিল তার দোষের, এজন্য তাকে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছিল। তাঁর একমাত্র উপলব্ধি, ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই,নহে কিছু মহীয়ান’। তিনি পান করেছেন সমাজ মথিত গরল। অন্তরে হাজার দুঃখের ঝাঁপি, কিন্তু সাধনা করেছেন মানব জাতির মঙ্গলের, ধ্যান করেছেন সুন্দরের।সেই সুন্দরের স্তবগানে উচ্চারিত হয়েছে, ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণ তুর্য।’ তাঁর কবি প্রকৃতি সম্বন্ধে তাঁর নিজেরই স্বীকারোক্তি ‘আমি সুন্দরের হাতে বীণা, পায়ে পদ্মফুলই দেখিনি,তার চোখ ভরা জলও দেখেছি নজরুলের লেখনী উপমা, অলংকার সৌন্দর্যে অতুলনীয়। তিনি ছিলেন বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী। কবি গানে গদ্যে পদ্যে দেশের যৌবন শক্তিকে বারবার আকুল আহবান জানিয়ে লিখেছেন—‘চল চল চল/উর্ধধ গগনে বাজে মাদল/ নিম্নে উতলা ধরণী তল, অরুণ প্রাতের তরুণ দল/চলরে চলরে চল। ‘যেই গান এখন আমাদের রণ সংগীত হয়েছে।
নজরুলের সৃষ্ট গদ্য, পদ্য বা সংগীতে ব্যবহৃত শব্দসমূহ একটা আলাদা বৈভব সৃষ্টি করে।বিভিন্ন ভাষা থেকে বিভিন্ন বিদেশী সুরনিয়ে বাংলা গানে তিনি অনেক অসাধারন বৈচিত্র এনেছেন।তার বিখ্যাত আরবী সুরের গান যেটা ছোটরা নাচের ক্ষেত্রে ব্যবহার করে থাকে—‘শুকনো পাতার নূপুর পায়ে,নাচিছে ঘূর্ণিবায়/জল তরঙ্গের ঝিলি মিলি ঝিলি মিলি, ঢেউ তুলে সে যায়।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল তাঁর কণ্ঠস্বর। আজীবন সংগ্রাম করেছেন শোষিত মানুষের মুক্তির জন্য। তরুণদের কাছে তিনি বিদ্রোহের অনন্ত প্রতীক। চির উন্নত শির কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর মাত্র দুই যুগের সৃষ্টিকর্ম জুড়ে পরাধীন দেশের মানুষকে মুক্তির পথ দেখিয়ে গিয়েছেন।
আমাদের দুর্ভাগ্য এই বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী কবি মাত্র ৪৩ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি তাঁর সৃষ্টির ঝরণা উৎসারিত করতে পেরেছিলেন। কারন ১৯৪২ সালে ৪৩ বছর বয়সে তিনি দূরারোগ্য ব্যাধি পিক্স ডিজিজ–২ রোগে আক্রান্ত হয়ে বাকশক্তি ও বোধশক্তি হারান। অসুস্থতা নিয়ে জীবন্মৃত হয়ে আরও প্রায় ৩৪ বছর বেঁচেছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কবিকে যথাযোগ্য মর্যাদায় পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন এবং বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করে ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ করে দেন।
তিনি ১৯৬০ সালে পদ্মভূষণ উপাধি প্রাপ্ত হন। ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে ডি.লিট উপাধি প্রদান করেন। তিনি ১৯৭৬ সালে একুশে পদক এবং মৃত্যুর পর ১৯৭৭ সালে স্বাধীনতা পুরষ্কারেও ভূষিত হয়েছিলেন। বাংলা সাহিত্যে তিনি ধূমকেতুর মতো হাজির হয়ে ধূমকেতুর মতো চলে গেলেন। জৈষ্ঠ্যে তাঁর আবির্ভাব, ভাদ্রে তাঁর জীবনাবসান। ‘মহাবিদ্রোহী জীবন–রণক্লান্ত কবি’ চির শান্তির কোলে ঘুমিয়ে পড়লেন। কবির সৃষ্ট গানের কথার মতো ‘মসজিদেরও পাশে আমায় কবর দিও ভাই।’ তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে কবিকে সমাহিত করা হয়। বাংলাদেশের জনগণের কাছে ‘জাতীয় কবি’ হিসাবে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম আজীবন চিরস্মরণীয় হয়েই রয়েছে, থাকবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, শিক্ষাবিদ।