পাহাড়ি জেলা রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলার মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে সর্পিল চেঙ্গী নদী। বর্ষা মৌসুমে নদীর পানি বেড়ে চেঙ্গী নদী বিলীন হয়ে যায় বিশালাকার কাপ্তাই হ্রদে। শুষ্ক মৌসুমে ধীরলয়ে নদীর পানি কমতে শুরু হওয়ায় আবারও ভেসে উঠে চেঙ্গী অববাহিকা। নদীর দুইপাশে জেগে ওঠে ছোট–বড় ডুবোচর। এসব জেগে উঠা চরে নানান শাক–সবজি ও ফসল আবাদ করেন পাহাড়ের কৃষক–কৃষাণীরা। এবারও কাপ্তাই হ্রদের পানি কমতে শুরু হওয়ায় ভেসে উঠছে চর। এ সকল চরে তরমুজ আবাদ শুরু করেছেন স্থানীয় পাহাড়ি চাষীরা। অনেকেই আবাদ করছেন সরিষাসহ অন্যান্য সাথী সফলও।
নানিয়ারচর উপজেলার সদর ইউনিয়নের টিএন্ডটি বাজার এলাকার বাসিন্দা সিমান চাকমা। ২০২২ সালে চেঙ্গী নদীর তীরে জেগে ওঠা ডুবোচরে করেছেন তরমুজ চাষ। প্রথম বার তরমুজ আবাদ করে লাভের চেয়ে উল্টে আড়াই লাখ টাকা লোকসান গুনেছেন তিনি। কিন্তু লোকসানেই থেমে যায়নি সিমানরা। গত মৌসুমে (২০২৩ সালে) তরমুজ চাষ করে সফল হয়েছেন। লাভবানও হয়েছেন তিন বন্ধু। চলতি মৌসুমেও চেঙ্গী নদীর পাড়ের চরে তরমুজ চারা লাগিয়েছেন তিন বন্ধু সিমান চাকমা, ফাগুন চাকমা ও অমর বিকাশ চাকমা।
কৃষক সিমান চাকমা বলেন, ২০২২ সালে আমরা তিন জন মিলে তরমুজ লাগিয়ে একটা তরমুজও খেতে পারিনি। উল্টো আমাদের আড়াই লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। লোকসান হলেও গত মৌসুমে আবার তরমুজ লাগিয়ে লাভবান হয়েছি। গত মৌসুমে ৩ একর জমিতে তরমুজ লাগিয়ে ২০ লাখ টাকার ফল বিক্রয় করেছি। আমাদের তিন জনের ১৫ লাখ টাকা টিকেছে। চলতি মৌসুমে ৩ একর জমিতে তরমুজ বীজ রোপণ করেছি। ৪ হাজার ৩০০টি টবে (গর্তে) চারটি করে বীজ লাগানো হয়েছে। দুই সপ্তাহ আগে লাগানো বীজ থেকে চারা হয়েছে। এ পর্যন্ত সাড়ে ৩ লাখ টাকার মতো খরচ হয়েছে। আশা করছি, ভালো ফলন পাওয়া গেলে আমরা অধিক লাভবান হতে পারব। তরমুজের সঙ্গে সাথী ফসল হিসেবে বেগুন ও শিমের চারা লাগিয়েছি। সিমান চাকমা আরও বলেন, কৃষি বিভাগ যদি আমাদেরকে সহযোগিতা করা হয় তাহলে আমরা আরেকটু উপকৃত হতাম। ফসলে বালাইনাশক ছিটাতে যদি বড় স্প্রে মেশিনসহ অন্যান্য সহায়তা হতো আমাদের চাষীদের জন্য অনেক উপকার হতো।
উপজেলার সাবেক্ষ্যং ইউনিয়নের ডানে সাবেক্ষ্যং এলাকার বাসিন্দা রিপন চাকমা। সিমান চাকমাদের জমির পাশেই তরমুজ ক্ষেত করেছেন রিপন চাকমা ও কালাধন চাকমা। দীর্ঘবছর পর এবার আবার নতুন করে তরমুজ চাষে ঝুঁকেছেন তারা। জানতে চাইলে রিপন চাকমা বলেন, আমরা এবার নতুন করে ১২০ শতক জমিতে ১৬০০ টবে (গর্তে) চারটি করে তরমুজ গাছ লাগিয়েছি। দুই সপ্তাহ সময়ে গাছগুলো বেড়ে উঠছে। আমাদের এ পর্যন্ত ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। আমরা আশাবাদী তরমুজ চাষে সফলতার মুখ দেখব।
গতকাল শনিবার দুপুরে তরমুজ ক্ষেতে চাষীদের পরামর্শ দিতে এসেছেন একটি ফার্টিলাইজার কোম্পানির টেরিটরি ম্যানেজার শান্তি জীবন চাকমা। এসময় ক্ষেতে লাগানো তরমুজের বীজ দেখেন ও ফসলের রোগবালাই সম্পর্কে কৃষকদের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। জানতে চাইলে শান্তি জীবন চাকমা দৈনিক আজাদীকে বলেন, চেঙ্গী নদীর তীরের জেগে উঠা চরে চাষীদের তরমুজ ক্ষেত ঘুরে দেখেছি। মোটামুটি চারাগুলো আছে। ফসলে যেন রোগবালাই ধরতে না পারে সেজন্য কিছু পরামর্শ দিয়েছি। তরমুজ লতার রোগ প্রতিরোধী কিছু কীটনাশকের ব্যবহার ও যত্ন করলে চাষীরা ভালো ফলন পাবেন।
এদিকে, তরমুজ ক্ষেতের পাশের জমিতে সরিষা, সূর্যমুখী, বেগুন, ধানসহ অন্যান্য ফসল আবাদ শুরু করেছেন চেঙ্গী তীরের কৃষকরা। সরিষা ক্ষেতে সরিষা ফুলে মৌমাছি এসে ভনভন শব্দ করছে ক্ষেতজুড়ে। প্রতি বছরই পাহাড়ের প্রান্তিক এলাকার কৃষক–কৃষাণীরা নদী তীরে, কাপ্তাই হ্রদের জলে ভাসা জমিতে নানান ফসল আবাদের মধ্য দিয়ে নতুন ফসলের স্বপ্ন দেখেন। এতে করে পাহাড়ের প্রান্তিক মানুষ কৃষিকে প্রাধান্য দিয়ে একদিকে উৎপাদনশীল কাজে নিয়োজিত রয়েছেন আরেকদিকে স্বাবলম্বী হচ্ছেন আর্থিকভাবেও।
কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) রাঙামাটি কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. মনিরুজ্জামান দৈনিক আজাদীকে বলেন, কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে প্রান্তিক চাষীদের টেকনিক্যাল (কারিগরি) সহায়তা দেওয়া হয়ে থাকে। বিশেষত কোন জমিতে কোন ভ্যারাইটির (প্রজাতি) ফসল ভালো ফলন হবে। এছাড়া ফসলে রোগবালাই প্রতিরোধ ও প্রতিশোধক ব্যবহারে আমরা পরামর্শ দিয়ে থাকি। এছাড়া আপাতত চাষীদেরকে আমাদের কোনো আর্থিক সহায়তা প্রণোদনা দেওয়ার সুযোগ নেই।