চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) ৩৪ নং পাথরঘাটা ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মোহাম্মদ ইসমাইল বালী। তার পৈতৃক সম্পত্তি পাঁচ তলা একটি ভবনের বিপরীতে গৃহকরের ভ্যালুয়েশন ছিল এক লাখ ২০ হাজার টাকা। যা পঞ্চবার্ষিকী কর পুনর্মূল্যায়নে বৃদ্ধি করে প্রস্তাব করা হয় ১৮ লাখ টাকা। প্রস্তাবিত এ ভ্যালুয়েশনের বিপরীতে আপিল করেন তিনি। গতকাল সোমবার অনুষ্ঠিত আপিল শুনানিতে তা কমিয়ে ২ লাখ ৪০ হাজার টাকায় চূড়ান্ত করেন সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। অর্থাৎ প্রস্তাবিত ভ্যালু থেকে ১৫ লাখ ৬০ হাজার টাকা কমানো হয়েছে। তবে পূর্বের ভ্যালুয়েশনের ভিত্তিতে তিনি যে পৌরকর পরিশোধ করতেন এখন তা দ্বিগুণ হয়েছে। প্রসঙ্গত, গৃহকর নির্ধারণে ভবনের মূল্যায়নই হচ্ছে ‘ভ্যালুয়েশন’। চূড়ান্ত হওয়া ভেল্যুর বিপরীতে ১৭ শতাংশ পৌরকর পরিশোধ করতে হয় ভবন মালিকদের। এর মধ্যে ৭ শতাংশ গৃহকর, ৩ শতাংশ আলোকায়ন রেইট এবং ৪ শতাংশ আবর্জনা অপসারণ রেইট রয়েছে।
মোহাম্মদ ইসমাইল বালী দৈনিক আজাদীকে বলেন, চূড়ান্ত ভ্যালু নিয়ে আমি সন্তুষ্ট। তবে চট্টগ্রাম শহরের যারা আদিবাসী, যারা ভবনের ভাড়ার আয় দিয়ে সংসার চালান তাদের পৌরকর আরো সহনীয় করার জন্য অনুরোধ থাকবে। তিনি বলেন, আর্থিক সংকটের কারণে অনেক পরিবার শহর ছেড়ে চলে গেছে, তারা গ্রামে স্থায়ী হয়েছে। আবার যোগাযোগ সুবিধা বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেকে গ্রাম থেকে আসা-যাওয়া করেন। ফলে বর্তমানে অনেক ঘর খালি আছে। তাই যারা ঘর ভাড়ার আয় দিয়ে সংসার চালান তাদের গৃহকর সহনীয় করা দরকার।
আন্দরকিল্লাহস্থ নগর ভবনে গতকাল শুনানিতে ২০ নং দেওয়ানবাজার, ৩২ নং আন্দরকিল্লাহ এবং ৩৫নং বক্সিরহাট ওয়ার্ডের ১২০টি আপিল নিষ্পত্তি করা হয়। সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী উপস্থিত থেকে আপিলগুলো নিষ্পত্তি করেন। প্রস্তাবিত ভেল্যুর ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ কমানো হয়েছে শুনানিতে। এতে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন করদাতারা। এসময় মেয়র তাদের ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান।
শুনানিতে অংশ নেন বক্সিরহাট ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাজী নুরুল হক। তার ২৭৪/২৮৩ হোল্ডিংয়ের প্রস্তাবিত ভ্যালু ছিল ১১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। শুনানিতে তা কমিয়ে চূড়ান্ত করা হয় সাড়ে তিন লাখ টাকায়। যা পূর্বে ছিল তিন লাখ টাকা।
দেওয়ান বাজার ওয়ার্ডের কোরবানিগঞ্জের বাসিন্দা পেয়ার মোহাম্মদ তার হোল্ডিংয়ের প্রস্তাবিত দেড় লাখ টাকার ভেল্যু কমিয়ে নির্ধারণ করা হয় ৩৫ হাজার টাকায়। অবশ্য যা পূর্বে ছিল ২২ হাজার টাকা। প্রস্তাবিত ভেল্যু আপিলে কমানোয় সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন তিনি।
ওমর মিয়ার পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন শামীম। তিনি বলেন, আছাদগঞ্জ রোডে ৬৩ বছরের পুরনো চার তলা ভবনের প্রস্তাবিত ভেল্যু ছিল তিন লাখ ৮০ হাজার টাকা। আপিলে তা কমিয়ে দুই লাখ টাকা করা হয়েছে। এতে আমি সন্তুষ্ট। ভবনের আয় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ ও এতিমখানায় দেয়া হয় বলেও জানান তিনি।
আন্দরকিল্লাহর তসলিম মোহাম্মদের টিনশেডের একটি রুম রয়েছে। যার প্রস্তাবিত ভেল্যু ছিল সাত হাজার টাকা। আপিলে তা কমিয়ে ধার্য্য করা হয় আড়াই হাজার টাকা। এতে সন্তুষ্ট বলে জানান চসিকের স্বাস্থ্য বিভাগের এ কর্মচারী।
আপিল শুনানির আগে আনুষ্ঠানিক সভায় বক্তব্য দেন, সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। এতে তিনি বলেন, আপিল বোর্ডের শুনানির মাধ্যমে করদাতাদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়ে সহনীয় পর্যায়ে চূড়ান্ত গৃহকর নির্ধারণ করা হচ্ছে। করদাতাদের সামর্থ্য অনুযায়ী কর দেয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে। চসিকের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে গিয়ে গৃহকর ছাড়া অন্য কোনো আয়ের পথ নেই। সরকার কর্তৃক আগে যে থোক বরাদ্দ দেয়া হতো তাও বর্তমানে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সহনীয় পর্যায়ে কর নির্ধারণপূর্বক করের আওতা বৃদ্ধি করে চসিকের বিশাল ব্যয় নির্বাহ করতে হবে।
রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, একটি মহল আয়তনের উপর কর মূল্যায়ন করার যে দাবি জানাচ্ছে তা আমলে নিলে কর মূল্যায়ন সহনীয় হবে তা ভ্রান্ত ধারণা। সেক্ষেত্রে ভাড়ার উপর কর মূল্যায়ন যতটুকু সহনীয় করা যায় তা আয়তন ভিত্তিক মূল্যায়নে সম্ভব নয়। করদাতারা চসিককে যে কর প্রদান করছে তা ২০১০ সালের মূল্যায়ন। বিগত সময়ে দুই দফা কর মূল্যায়নের বিধি-বিধান থাকলেও তা স্থগিত ছিল। এতে করদাতারা সেই কর থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব হয়েছে।
মেয়রের একান্ত সচিব মো. আবুল হাসেমের সঞ্চালনায় স্বাগত বক্তব্য দেন, প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মো. নজরুল ইসলাম, রিভিউ বোর্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংরক্ষিত কাউন্সিলর কাউন্সিলর নীলু নাগ, হাজী নুরুল হক, গাজী মো. শফিউল আজম, সংরক্ষিত কাউন্সিলর রুমকী সেনগুপ্ত, রিভিউ বোর্ডের সদস্য প্রকৌশলী অসীম সেন, অ্যাডভোকেট রাসেল সরকার ও কর কর্মকর্তা মো. সেলিম সিকদার।
প্রসঙ্গত, দি সিটি কর্পোরেশন ট্যাঙেশান রুলস অ্যাক্ট ১৯৮৬ এর ২১ ধারা মতে, সিটি এলাকায় প্রতি পাঁচ বছর অন্তর সকল প্রকার স্থাপনার পরিমাপ ও সংশ্লিষ্ট তথ্য সরেজমিন সংগ্রহ করে পৌরকর নির্ধারণ করা হয়। আইনটির আলোকে ২০১৬-২০১৭ অর্থ বছরে গৃহ ও ভূমির পঞ্চবার্ষিকী কর পুনর্মূল্যায়ন (রি-অ্যাসেসমেন্ট) করে চসিক। পুর্নমূল্যায়ন শেষে তা ২০১৭ সালের ৩১ আগস্ট জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়।
তখন প্রস্তাবিত পৌরকের বিরুদ্ধে আপত্তি জানান ভবন মালিকরা। বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে তারা মাঠে নামেন। এক্ষেত্রে ‘চট্টগ্রাম করদাতা সুরক্ষা পরিষদ’ ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করে। এরপর মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে একই বছরের ২৭ নভেম্বর থেকে অ্যাসেসমেন্ট কার্যক্রম স্থগিত করেছিল চসিক। গত বছরের (২০২২) ১৮ জানুয়ারি স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করা হয়। এরপর একই বছরের ১ জুলাই থেকে ২০১৭ সালের অ্যাসেসমেন্টের আলোকে কর আদায়ে কর্যক্রম শুরু করে চসিক। স্থগিত থাকা এ অ্যাসেসমেন্টের বিপরীতে করদাতারা যে আপিল করেন তার উপর শুনানি অনুষ্ঠিত হয় গতকাল।