যান্ত্রিক সংকটে বন্ধ হয়ে গেছে আমদানিকৃত গ্যাস সরবরাহ। এতে করে চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। চট্টগ্রামের কাফকো এবং সিইউএফএল সার কারখানা, শিকলবাহা বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ গ্যাসনির্ভর সব শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। গ্যাস নেই ৬৮টি সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশনসহ কয়েক হাজার বাণিজ্যিক এবং ৬ লাখের বেশি আবাসিক গ্রাহকের সংযোগে। পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে রান্নার চুলা। গ্যাস না থাকায় সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন আবাসিক গ্রাহকরা।
সকালে গ্যাসের চুলা জ্বলতে না দেখে হোটেলে ছুটে যান অনেকে। কিন্তু চাহিদার তুলনায় খাবার কম থাকায় ভোগান্তিতে পড়তে হয়। অনেকেই ফিরেছেন খালি হাতে। গ্যাস সংকটে রাস্তায় গাড়িও কমে গেছে। সাইফুদ্দীন সাকিব নামে এক ব্যক্তি তাই আক্ষেপ করে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বলছিলেন, চুলাত গ্যাস নাই, রাস্তাত গাড়ি নাই, কষ্টর শ্যাষ নাই। (চুলায় গ্যাস নেই, রাস্তায় গাড়ি নেই। কষ্টের শেষ নেই।)
কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চট্টগ্রামকে আমদানিকৃত গ্যাসনির্ভর করে ফেলায় সিলেট কিংবা কুমিল্লা অঞ্চলের গ্যাস এনে জরুরি পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার সুযোগও নেই। গত রাতে শেষ খবরে জানা গেছে, আজ সকালে গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক হবে। জানা যায়, সংস্কার কাজ শেষ করে সিঙ্গাপুর থেকে আনা এলএনজিবাহী জাহাজ (টার্মিনাল) মহেশখালীতে সাগরের তলদেশে পাইপলাইনে সংযোগ দেয়ার সময় গত বৃহস্পতিবার বিপর্যয় ঘটে। জাহাজের সাথে পাইপের সংযোগ দেয়া সম্ভব না হওয়ায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। চট্টগ্রাম পর্যন্ত ৯২ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইনের গ্যাস দিয়ে কয়েক ঘণ্টা চললেও বৃহস্পতিবার রাতে অনেক এলাকার গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। গতকাল ভোর রাত থেকে পুরো চট্টগ্রামের কোথাও গ্যাস ছিল না। তখন থেকে চট্টগ্রামের সর্বত্র গ্যাস প্রবাহ বন্ধ রয়েছে।
চট্টগ্রামে আগে সিলেট ও কুমিল্লা অঞ্চলের গ্যাস আনা হতো বিদ্যমান আশুগঞ্জ–বাখরাবাদ পাইপলাইন দিয়ে। এলএনজি আমদানি শুরু করার পর আশুগঞ্জ–বাখরাবাদ পাইপলাইনকে বাল্ব লাগিয়ে ওয়ানওয়ে করে ফেলা হয়। এতে চট্টগ্রামের দিক থেকে গ্যাস শুধু নেয়া যায়, চট্টগ্রামে আনা যায় না। গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নগরীসহ পুরো চট্টগ্রামে গ্যাসের হাহাকার শুরু হয়েছে। কেজিডিসিএলের কর্মকর্তারা বলেছেন, এলএনজি টার্মিনালের সাথে পাইপলাইনের সংযোগ দেয়ার চেষ্টা চলছে। তবে এতে কতক্ষণ সময় লাগবে তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছেন না। পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ শুরু হলেও চট্টগ্রাম পর্যন্ত সেই গ্যাস এসে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে কয়েক ঘণ্টা লেগে যাবে। এতে করে আজ গ্যাস সরবরাহ আদৌ শুরু কিংবা স্বাভাবিক হবে কিনা তা নিয়ে কর্মকর্তারা সংশয়ে রয়েছেন।
এদিকে গত রাত ১০টা ১২ মিনিটে মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জির টার্মিনালের সাথে পাইপলাইনের সংযোগ দেয়া হয়েছে। ৪৮০ মিলিয়ন ঘনফুট করে এলএনজি সরবরাহ দেয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। তবে চট্টগ্রামে গ্যাস পৌঁছাতে ৩–৪ ঘণ্টা সময় লাগবে। আজ সকালে নগরীসহ চট্টগ্রামের গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক হবে বলে জানিয়েছেন কেজিডিসিএলের কর্মকর্তারা।
এদিকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হওয়ায় জ্বলছে না চুলা। গৃহস্থালি খাতের গ্রাহকেরা ভোগান্তিতে পড়েছেন। খাবারের জন্য তারা হোটেরে ভিড় জমান। সেখানেও দেখা দিয়েছে খাবার সংকট। দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার না পেয়ে ফিরতে হয়েছে ক্রেতাদের।
অপরদিকে সিএনজি ফিলিং স্টেশনে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ট্যাঙিসহ বিভিন্ন গণপরিবহন চলাচল কমে গেছে। দ্বিগুণ–তিন গুণ ভাড়া হাঁকা হচ্ছে সিএনজি ট্যাক্সিতে। গ্যাসের অভাবে ঘরে–বাইরে নাগরিক দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করেছে।
কেজিডিসিএলের মহাব্যবস্থাপক আমিনুর রহমান গতকাল বিকালে বলেন, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করে চট্টগ্রামে সরবরাহ করা হয়। আমদানি করা এলএনজি রূপান্তর করে পাইপলাইনে সরবরাহের জন্য কঙবাজারের মহেশখালীতে দুটি ভাসমান টার্মিনাল রয়েছে। এর মধ্যে মার্কিন কোম্পানি এঙিলারেট এনার্জির টার্মিনালটি গত ১ নভেম্বর থেকে বন্ধ রয়েছে। এটি মেরামত করে সিঙ্গাপুর থেকে আনা হয়েছে। এটি বৃহস্পতিবার চালু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চালু করা যায়নি। এছাড়া পেছনের গতি বা ব্যাক প্রেশার না থাকার কারণে সামিট এলএনজি টার্মিনালটিও গ্যাস সরবরাহ করতে পারছে না। এ কারণে চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। সামিটের টার্মিনালটি খালি করা হচ্ছিল। এটিও রক্ষণাবেক্ষণের কাজে যাওয়ার কথা রয়েছে।
তিনি বলেন, মার্কিন কোম্পানি এঙিলারেট এনার্জির টার্মিনালটি পাইপলাইনের সাথে সংযোগ দেয়ার চেষ্টা চলছে। বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলীরা কাজ করছেন। এটির সংযোগ স্থাপিত হলে গ্যাস সরবরাহ শুরু হবে। তবে মহেশখালী থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত গ্যাস আসা এবং প্রবাহ স্বাভাবিক হতে কয়েক ঘণ্টা সময় লাগবে। আজ শনিবার চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ শুরু হতে পারে।
সারা দিন গ্যাস না থাকার যন্ত্রণায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নগরবাসী। ফেইসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করা হচ্ছে। খুলশী এলাকার আফজালুর রহমান দুপুরে খাবার কেনার বিড়ম্বনার কথা উল্লেখ করে বলেন, জুমার নামাজের পরে নগরীর বিভিন্ন স্থানে খাবার কেনার চেষ্টা করেছেন তিনি। সব জায়গায় মানুষের ভিড় এবং হাহাকার দেখেছেন বলে জানান।
আল ফালাহ গলির বাসিন্দা রিজিয়া বেগম বলেন, পূর্ব ঘোষণা ছাড়া হুট করে এমন বিপর্যয় সব এলোমেলো করে দিয়েছে। বৃহস্পতিবার চুলা টিম টিম করে জ্বলেছিল। আজ (গতকাল) সকাল থেকে একদম বন্ধ। সকালে নাস্তাও করতে পারিনি।
গ্যাস না থাকায় খাবারের জন্য চকবাজার এলাকার একটি হোটেলে গিয়ে কামরুল ইসলাম খাবার পাননি। তিনি বলেন, চকবাজার এলাকার কোনো রেস্টুরেন্টে নামাজের পরে খাবার ছিল না।
নগরীর উইমেন কলেজ মোড়ের মালেক হোটেলের ম্যানেজার জানান, সকালের নাস্তা থেকে শুরু করে দিনভর খাবারের জন্য প্রচুর মানুষ এসেছেন। তিনি বলেন, গ্যাস না থাকায় আমাদেরও সমস্যা হয়েছে। সিলিন্ডার ব্যবহার করে রান্না করছি। তবে মানুষের প্রচুর চাপ থাকায় সবাইকে খাবার দেয়া সম্ভব হয়নি।
জিইসি মোড়ের হোটেল জামানের ম্যানেজার বলেন, সকাল থেকে প্রচুর মানুষ খাবারের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। চাপ বেশি। আমরা সিলিন্ডার ব্যবহার করে খাবার তৈরি করেছি। তবুও গ্রাহকের চাহিদামতো খাবার দিতে পারছি না।
আবদুল হামিদ নামে চকবাজারের এক বাসিন্দা বলেন, গত রাতেও গ্যাস ছিল না। রাতে বশিরের (ডিসি রোড, পশ্চিম বাকলিয়া) ভাতের হোটেল থেকে ৫০ টাকার ভাত কিনেছি। কোনোমতে খেয়েছি। সকালের নাস্তা করতে পারি নাই। বাবা–মা, বউ–বাচ্চাসহ নাস্তা না করে সকাল শুরু করেছি। দুপুরও অনিশ্চিত।
গ্যাসের অভাবে অনেকে ছাদের উপর ইটের চুলা বানিয়ে রান্না সেরেছেন। কেউ কেউ তেলের চুলা কিনে এনেছেন। সবকিছু মিলে গ্যাসের অভাবে নগরজীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে বলে সংশ্লিষ্টরা মন্তব্য করেছেন।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রামে গ্যাসের দৈনিক চাহিদা প্রায় ৪শ মিলিয়ন ঘনফুট। আমদানিকৃত এলএনজি থেকে চট্টগ্রামে দৈনিক ২৭০ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো গ্যাস দেয়া হয়। এর মধ্যে কাফকো, সিইউএফএল সার কারখানা এবং শিকলবাহা বিদ্যুৎ কেন্দ্র ১৩০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস ব্যবহার করছিল। বাকি গ্যাস জোড়াতালি দিয়ে চট্টগ্রামের ৬৮টি সিএনজি স্টেশন, কয়েক হাজার শিল্প ও বাণিজ্যিক গ্রাহক এবং ৬ লাখের বেশি আবাসিক গ্রাহকের গ্যাসের যোগান দেয় কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি।