তার অফিস টাইম শুরু হয় রাত এগারটায়। শেষ হয় ভোর পাঁচটায়। পেশায় সে চোর। বিশ্বস্ত সহচর মাহফুজকে নিয়ে তার সিএনজি টেক্সিতে চেপে ঘুরে বেড়ায় নগরীতে; বিশেষ করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে এমন এলাকাগুলোতে। প্রতিষ্ঠান অন্ধকার দেখলেই পেছনে পাইপ বেয়ে তরতর করে উঠে পড়ে। হাতে থাকা রেঞ্চের এক মোচড়ে ভেঙে ফেলে জানালার গ্রিল। ভেতরে ঢুকে প্রথমেই সিসিটিভি ক্যামেরা এড়াতে ডিভিআর মেশিন খুলে পানিতে চুবিয়ে রাখত। এরপর খোঁজ চলত টাকা-পয়সার। পাওয়া না গেলে হাতের কাছে যা পাওয়া যায়, তা-ই নিয়ে বেরিয়ে আসত। নির্দিষ্ট সময়ে ফোন করলে মাহফুজ এসে নিয়ে যেত তাকে। ভোরে ঘরে ফিরে চুরির যাবতীয় সামগ্রী তুলে দিত স্ত্রীর হাতে। এভাবেই গত সাত বছর ধরে চট্টগ্রাম জুড়ে চুরির ট্রিপল সেঞ্চুরি করেছে মনির। কিন্তু ভুল করেছে সে গত ১৮ মে রাতে। বাংলাদেশ সাপ্লাইয়ার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠানে ঢুকে সিসিটিভির ডিভিআর মেশিন ভেবে ডিশ কানেকশন মেশিন পানিতে চুবিয়ে রাখে। ডিভিআর মেশিন অন্য জায়গায় থাকার কারণে দ্রুত শনাক্ত করা যায় মনিরকে। গত শুক্রবার ও গতকাল শনিবার দুই দফায় মনির ও তার দুই সহযোগী স্ত্রী খুকু ও সিএনজি চালক মাহফুজকে গ্রেপ্তারের পর মনিরের কীর্তি সম্পর্কে জানতে পারে পুলিশ।
যে ঘটনায় পড়ল ধরা : সিএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ) বিজয় বসাক জানান, গত ১৯ মে নগরীর জুবিলী রোডে বাংলাদেশ সাপ্লাইয়ার্স নামে একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান থেকে ২৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকে চুরির চেষ্টার অভিযোগে কোতোয়ালী থানায় পৃথক দুটি মামলা দায়ের হয়। জুবিলী রোডে আমাফা সেন্টার নামে ওই ভবনে থাকা প্রতিষ্ঠান দু’টিতে সংঘটিত অপরাধের ঘটনা তদন্তে নামে পুলিশ। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহের পর দেখা যায়, আগের দিন ১৮ মে সন্ধ্যা ৬টার পর থেকে পরদিন ভোরের মধ্যে এ ঘটনা ঘটেছে। এরপর ফুটেজ দেখে প্রথমে সিএনজি টেক্সি চালক মাহফুজকে শনাক্ত করা হয়। তাকে পুরাতন রেল স্টেশনস্থ গ্রামীণ মাঠ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর তার কাছ থেকে মনিরের তথ্য পাওয়া যায়। জিজ্ঞাসাবাদে মাহফুজ জানায়, সে টেক্সিতে করে মনিরকে নিয়ে গিয়েছিল। মনির চুরি সংঘটনের পর আবার তারা ফিরে যায়। এ তথ্যের ভিত্তিতে নগরীর আকবর শাহ থানার বিশ্ব কলোনির শান্তিনগর জি ব্লকে মনিরের বাসায় তল্লাশি চালিয়ে চুরি করা ২৭ লাখ ৫ হাজার টাকা উদ্ধার এবং তাকে স্ত্রীসহ গ্রেপ্তার করা হয়। এছাড়া ব্যবহৃত সিএনজি থেকে দুইটি চাপাতি, রেঞ্চ ও চুরির অন্যান্য সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। তাদের কাছ থেকে একটি ব্যাংকের চেক বই উদ্ধার করা হয়েছে। বিজয় বসাক বলেন, আমরা সেই একাউন্টের লেনদেন নিয়েও খবর নিচ্ছি।
চুরির পরপরই অভিযান টিম : সাম্প্রতিক সময়ে নগরীতে এত বড়ো অংকের টাকা চুরির ঘটনা ঘটেনি। তাই ঘটনা জানার পর পরই সিএমপি কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীরের নির্দেশে উপ পুলিশ কমিশনার বিজয় বসাক একটি টিম গঠন করেন। টিমের সদস্যরা হলেন, কোতোয়ালী জোনের এসি মো. মুজাহিদুল ইসলাম, চকবাজার জোনের এসি কামরুল ইসলাম, কোতোয়ালী থানার ওসি নেজাম উদ্দীন, পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ কবির হোসেন, পরিদর্শক (অপারেশন) মো. জাবেদ উল ইসলাম, এসআই মো. মোমিনুল হাসান, এসআই মৃণাল কান্তি মজুমদার, এসআই মো. রবিউল ইসলাম, এএসআই অনুপ কুমার বিশ্বাস, এএসআই সাইফুল আলম ও কনস্টেবল রুবেল মজুমদার।
কে এই মনির : পুলিশের কাছে ইতোমধ্যেই ‘ভিআইপি’ চোরের তকমা পাওয়া মনিরের চুরির জীবন সাত বছরের। এর মধ্যে ধরা পড়েছে মাত্র দুইবার। খুলশী ও আকবর শাহ থানার দুটি চুরির মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে মনির দুই বছর কারাগারে ছিলেন। তার বড় ভাই আমীর আন্তঃজেলা চোরের সর্দার। গতকাল দুপুরে কোতোয়ালী থানায় ওসির কক্ষে মনির আজাদীকে বলেন, ‘ছোড থেইক্কাই চট্টগ্রামে আছি। একটা সময় নেশা পানি করতাম, হেরোইন গাঁজা খাইতাম কদমতলী আবুর স্পটে। রিহ্যাব সেন্টারেও ছিলাম। কিন্তু ভালা হই নাই। লোহা চুরি করতাম। তারপর আস্তে আস্তে এ লাইনে চলে আসি।’ এসময় ওসি কোতোয়ালী নেজাম উদ্দীন আজাদীকে বলেন, ‘চট্টগ্রামে এ ধরনের চোরদের এক সর্দার আছে। সবাই তাকে ‘চৌধুরী’ নামে চিনে। এই চৌধুরীই মনিরকে এ লাইনে নিয়ে এসেছে।’
মনির বলেন, ‘ভাঙারির দোহানে লোহা বিক্রি করতে গেছিলাম। এসময় চৌধুরীর সাথে দেহা। হে লাইনে জইন (জয়েন) করমু কিনা জিগাইলে রাজি অইয়্যা যাই। তাদের লগে দু’চারটা কামও করি। একটা কামে বেশ ভালো লাভ হয়। কিন্তু চৌধুরী আমারে মাত্র দশটা ইয়াবা ট্যাবলেট আর পাঁচ হাজারটা টেহা দেয়। আমি ভাবলাম, হেরাও শ্রম দিছে, আমিও দিচি। যদি ধরা খাই , হেগো যা শাস্তি হইবো, আমারো একই শাস্তি হইবো। তাইলে এত কম পামু ক্যান? এরপর থেইক্কা চিন্তা করলাম, যা করার একাই করমু। একাই ভোগ করমু, ধরা খাইলেও একাই শাস্তি ভোগ করুম। তারপর শুরু।’
ওসি নেজাম বলেন, আমরা চৌধুরীসহ আরো কয়েকজনকে খুঁজছি। আশা করি পেয়ে যাবো। তাদের গ্রেপ্তার করতে পারলে আশা করি চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানে চুরি রোধ করা যাবে।
সার্বক্ষণিক সঙ্গী মাহফুজ : ওসি নেজাম জানান, সিএনজি টেক্সি চালক মাহফুজ তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী। কাজ হোক না হোক তাকে দৈনিক ৫০০ টাকা করে দেন মনির। রাত ১১টার পর থেকে মাহফুজের টেক্সিতে শহরে ঘুরে বেড়ায়। মনির টার্গেট করা ভবনে ঢুকলে মাহফুজ আশেপাশে থেকে রেকি করে। পুলিশ কিংবা নিরাপত্তা প্রহরী দেখলে ফোন করে তা মনিরকে জানিয়ে দেন। চুরি করতে পারলে মনির মোটা অঙ্কের ভাগ দিতেন মাহফুজকে। ২৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা চুরির পর সিএনজি চালক মাহফুজকে ১০ হাজার টাকা ভাগ দেন। মনিরের কারাগারে থাকাকালীন মাহফুজ তাকে জামিন করানোসহ বিভিন্ন বিষয়ে সহায়তা করেন।
‘আমার একটা নীতি আছে’ : মনিরের দাবি, চোর হলেও তার একটা নীতি আছে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেই চুরি করে মনির। কোনো বাসাবাড়িতে চুরি করে না। টাকা হাতে পেলে অন্য জিনিসে হাত দেয় না। চুরির পেশাটা খারাপ। তাই তার তিন ছেলে এক মেয়ের কাউকে এই পেশায় আনবেন না বলেও জানান আজাদীকে। তিনি বলেন, রমজানের সময় আমি চুরি করতে বের হইনি। প্রতি রমজানেই এই বিরতি দেই। রোজা শুরুর আগে ও শেষে মূলত চুরি করি। চুরির টাকায় বিশ্বকলোনি এলাকায় জায়গা কিনে পাঁচটি সেমিপাকা ঘর তৈরি করে ভাড়া দিয়েছি। পাশাপাশি একটা ভাঙারি দোকানও দিয়েছে।
সাত বছরে ৩০০ চুরি : সেই লোহা চুরি থেকে শুরু, এরপর গত ৭ বছরে আনুমানিক ৩০০ চুরির তথ্য পুলিশকে জানিয়েছে মনির। সমপ্রতি তার চুরির তালিকায় রয়েছে কোতোয়ালী থানার নজীর আহমদ রোডের একটি বেসরকারি অফিস থেকে ২০ হাজার টাকা চুরি, জামালখান এলাকার একটি কম্পিউটার একাডেমি থেকে ল্যাপটপ চুরি, রাজাপুকুর লেনের ৩টি কাগজের গোডাউন থেকে ৫০ হাজার টাকা, চকবাজারের একটি রেস্টুরেন্ট থেকে ৩৬ হাজার টাকা, ১টি এলইডি মনিটর, ১২ কেজি প্যাকেটজাত দুধ, ১৩ প্যাকেট ঘি, আগ্রাবাদের একটি অফিস থেকে মূল্যবান জিনিস চুরি। ধরা পড়ার পর পরই মনির পুলিশের অভিযান টিমকে ১১ টি স্থানে নিয়ে গেছে, যেখানে সম্প্রতি চুরি করেছেন।
চুরির টাকায় ভাইয়ের জন্য জেয়াফত: কোতোয়ালী থানার ওসি নেজাম উদ্দীন আজাদীকে বলেন, ২৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা চুরির পর মনির তার বড় ভাই আন্তঃজেলা চোর আমীরের জন্য গত ২০ মে বাড়িতে মিলাদ পড়িয়েছে, সেখানে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থাও ছিল। সেখানে খরচ করেছে ৩৫ হাজার টাকা।
পুলিশের ওপর আস্থা : মামলার বাদী বাংলাদেশ সাপ্লাইয়ার্সের কর্ণধার ও ভবন মালিক কাইজার আবুওয়াল আজাদীকে বলেন, গত ১৮ মে সন্ধ্যা ৭ টায় আমি অফিস বন্ধ করে বাসায় চলে যাই। পরদিন জানতে পারি আমাদের ৩ তলায় মিউচুয়্যাল ট্রাস্ট ব্যাংকের গ্রিল কেটে চুরির চেষ্টা হয়েছে। পরে এসে দেখি, চতুর্থ তলায় আমার প্রতিষ্ঠানের গ্রিল কাটা। লোহার সিন্দুক, কাগজ পত্র সব এলোমেলো। সিন্দুকে রাখা ২৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা নেই! পরে আমি পুলিশের দ্বারস্থ হই। পুলিশ আমাকে যে সহযোগিতা করেছে তা ভুলবো না। অনেকে বলেছে, পুলিশ কী করবে? কিন্তু তাদের কথায় কান দেই নি আমি। শেষ পর্যন্ত পুলিশের উপর আস্থা ছিল। সেই আস্থার প্রতিদান তারা দ্রুততার সাথে দিয়েছে।