ঠিক কুড়ি বছর আগে ২০০৩ খ্রিস্টাব্দের ১লা সেপ্টেম্বর আমাদের পূর্বসূরিদের পরম যত্নে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে প্রথম প্রকাশ্যরূপে আবির্ভূত হয়েছিল চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়– চুয়েট। বাংলাদেশের দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চলীয় চট্টগ্রাম জেলার কাপ্তাই–চট্টগ্রাম সড়ক ঘেঁষে রাউজান উপজেলার ঐতিহাসিক পাহাড়তলী এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রকৌশলবিদ্যার এই প্রতিষ্ঠান। প্রকৌশল, স্থাপত্য, নগর পরিকল্পনা ও বিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে শিক্ষাচিন্তা করে ২৮শে ডিসেম্বর, ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম প্রকৌশল কলেজ হিসাবে যাত্রা শুরু করেছিল। যুগপরিক্রমায় ১লা জুলাই ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে প্রকৌশলবিদ্যার এই কলেজ ইনস্টিটিউটে রূপান্তর ঘটে। নতুনভাবে নামকরণ হয় বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, বিআইটি, চট্টগ্রাম। তৎপরবর্তীতে আন্দোলন–সংগ্রাম আর সরকারি নির্দেশনায় বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে আত্মপ্রকাশ। বইয়ে–পুস্তকে আর ভিডিও–সিনেমায় দেখা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পুরোটাই এখানে আছড়ে পড়েছে। প্রাকৃতিক মনোরম পাহাড়–সমতল, লেক মিলিয়ে সবুজ প্রকৃতি, সারি–সারি গাছ–লতার সমারোহ, বাহারি সব ফুলের সমাহার, পাখিদের কিচির–মিচির–কলতান, প্রাকৃতিক জলাধার, উঁচু–নিচু মেঠোপথ, বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য, সঙ্গে সর্পাতঙ্ক মিলেমিশে অবস্থান; এই প্রতিষ্ঠান। ১৭১ একর জায়গা জুড়ে প্রকৌশলবিদ্যার অনুকরণে দৃষ্টিনন্দন সব অবকাঠামো বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ক্যাম্পাস প্রকৃতিপ্রেমীদের একটি বিনোদন কেন্দ্র্রও বটে।
মূল শহর থেকে গ্রামীণ জনপদে অবস্থান থাকা সত্ত্বেও প্রধান ফটকে ঢুকলেই স্ব–মহিমায় দাঁড়িয়ে থাকা গৌরবময় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, স্বাধীনতা ভাস্কর্য, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল, সাংস্কৃতিক চর্চার জন্য মুক্তমঞ্চ, ছাত্র–শিক্ষক সম্পর্কের গভীরতাবাহী–টিএসসি, পাহাড়–টিলা–টংকর–মেঠোপথ জোড়া দিয়ে তৈরি ঝুলন্ত সেতু–অনন্য মুগ্ধতার জন্ম দেয়। প্রকৌশল শিক্ষার ধরণ–গড়ন অন্যসব শিক্ষা থেকে আলাদা ব্যতিক্রম। ব্যতিক্রমী এই শিক্ষায় প্রায় সাড়ে তিনশত বন্ধুবৎসল চৌকষ শ্রদ্ধেয় শিক্ষকমণ্ডলী ছাত্রছাত্রীদের সান্নিধ্যে আসার ব্যাপারে আবেগতাড়িত ভূমিকা রাখেন। শতাধিক পিএইচডি ডিগ্রিধারীসহ মানবিক বোধে শ্রেষ্ঠত্বের সব শিক্ষকবৃন্দের সামনে যখন আমরা কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে দাঁড়াই, তখন শিক্ষকগণ আমাদের আগলে নেন। এক পরিবারভুক্ত আমরা সবাই বলে দ্বিধাহীন চিত্তে সব অভিব্যক্তি প্রকাশের আন্তরিক আদেশ দেন। এই আদেশ–নির্দেশে কোনো মালিন্য নেই, কৃত্রিমতা নেই। প্রাণের ছোঁয়া অনুভব করি। ব্যতিক্রমী–মনোগ্রাহী এইসব আলোচনায়, আলাপ–আড্ডায় নিজেকে প্রকৃত অর্থে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ভাবতে শুরু করি।
বর্তমান ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ রফিকুল আলম স্যারের ভারিক্কি চালের ঐকান্তিক কর্মচঞ্চলতা আমরা প্রথম দিন থেকেই ভিন্নমাত্রিক কর্মগুণে অনন্য বলে দেখে আসছি। চুয়েটের ৫টি অনুষদের অধীনে ১২টি ডিগ্রিপ্রদানকারী বিভাগসহ ১৮টি বিভাগ, ৩টি গবেষণা সেন্টার, ৩টি গবেষণা ইনস্টিটিউট, একটি কেন্দ্রীয় রিসার্চ ব্যুরো, একটি টেস্টিং ও কনসালটেন্সি সেন্টার, দেশের প্রথম এবং একমাত্র শেখ কামাল আইটি বিজনেস ইনকিউবেটর, দেশের একমাত্র ভূমিকম্প প্রকৌশল গবেষণা ইনস্টিটিউট, রিভার–হারবার ও ল্যান্ড স্লাইড রিসার্চ সেন্টারসহ প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো বিভাগ কর্তৃক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সেমিনার, কনফারেন্স আয়োজনে অনন্য দক্ষ এই বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রজ্ঞা–শ্রমনিষ্ঠা, আন্তরিকতা, মানবিক মূল্যবোধ ও স্বদেশপ্রীতির সতেজ ঢঙে দক্ষতার সাথে পরিচালনা করছেন। প্রকৌশল শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠান অনেক বিষয়ই বাংলাদেশে প্রথম হলেও পানিসম্পদ কৌশল বিভাগের আয়োজিত কনফারেন্স এ দেশের জন্য প্রকৃত অর্থেই অনবদ্য ভূমিকা রাখছে। চুয়েটিয়ানদের অকুন্ঠ ভালোবাসা নিয়ে উক্ত ক্যাম্পাসে অন্তত ২০টি সামাজিক–সাংস্কৃতিক সংগঠন নিবন্ধিত। এর বাইরে আরো অনেক সংগঠন বিশেষ করে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা মানবিকতা প্রকাশের জেলাভিত্তিক সংগঠন বেশ নজর কারে। সংস্কৃতিমনা এইসব সংগঠনের কর্মকাণ্ডে ইঙ্গিত করে–চুয়েট ক্যাম্পাস কতোটা ইনোভেটিভি, কতোটা ক্রিয়েটিভ। ‘জয়ধ্বনি’ সারাদেশব্যাপী আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক উৎসবে বেশ কয়েকবার চ্যাম্পিয়ন, রানারআপ হয়েছে, চুয়েট ডিবেটিং সোসাইটিও কম যায় না, নাটকীয় ঢঙের যুক্তিনির্ভর বিতর্ক করে জাতীয় বিতর্ক উৎসব, বাংলাদেশ টেলিভিশন বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অসংখ্যবার চ্যাম্পিয়ন, রানারআপ হয়েছে। রোবো মেকাট্রনিঙ অ্যাসোসিয়েশন, মহাকাশ ও রোবটিক গবেষণা সংস্থার সদস্য চুয়েটিয়ানরা প্রতিবছরই দেশ–বিদেশ থেকে বড় বড় সাফল্য নিয়ে আসছেন। গ্রিন ফর পিস’র সদস্যরা বছরজুড়েই পরিবেশ সচেতনতামূলক কাজের ফলবতী হই আমরা সকলে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ পেশাজীবী সংগঠন ‘ইনস্টিটিউট অব ইলেকট্রনিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিঙ ইঞ্জিনিয়ার্স’ এর চুয়েট ছাত্র শাখার কর্মকাণ্ড ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছে। চুয়েটের গৌরবময় পথচলার অগ্রযাত্রায় যাঁরা বিভিন্নভাবে ভূমিকা রেখেছেন, সহযোগিতা করে যাচ্ছেন প্রতিষ্ঠা দিবসের আনন্দঘন এই দিনে চুয়েট পরিবারের নবীনতম সদস্য হিসাবে সকলের অবদানকে বিনম্রভাবে কৃতজ্ঞতা জানাই।