গত বছরের ২২ শে এপ্রিল বাস ও মোটরসাইকেলের সংঘর্ষে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্ত ও তৌফিক নামের দুই শিক্ষার্থী নিহত হয়। তাদের মৃত্যুতে ১০ দফা দাবি নিয়ে উত্তাল হয় চুয়েট। বেপরোয়া গতির শাহ আমানত ও এবি ট্রাভেলস বাস নিষিদ্ধকরণ ছিল অন্যতম দাবি। কিন্তু এই সড়কে এখনো বন্ধ হয়নি মৃত্যুর আর্তনাদ।
চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ চারটি উপজেলা কাপ্তাই-চট্টগ্রাম সড়কে অবস্থিত। এ সড়কে দুর্ঘটনায় মৃত্যর মিছিল ভারি হচ্ছে। প্রতিদিন কোনো না কোনো জায়গায় রক্তপাতের দৃশ্য দেখা যায়। তবে ৪ উপজেলাই রাঙ্গুনিয়া সংলগ্নে অবস্থিত। রাঙ্গুনিয়া উপজেলার যোগাযোগের মূল আঞ্চলিক সড়ক হচ্ছে কাপ্তাই-চট্টগ্রাম সড়ক। এ সড়কটি এসব উপজেলার ৯ লক্ষাধিক মানুষের যাতায়াতের প্রধান সড়ক। এই সড়কে রয়েছে বিপদজনক ৪০টি বাঁক। ফলে অনেক আগের থেকেই এটি মৃত্যুকূপে হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
জানা যায়, ৫২ কিলোমিটারের ওই সড়কে ৪০টি মতো বিপজ্জনক বাঁক রয়েছে। ১০ হাজারের বেশি সিএনজি ও অটোরিক্সা চলাচল করে থাকে এ সড়কে। যেগুলোর অধিকাংশই রেজিস্ট্রেশনবিহীন, ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন। চালকদের উল্লেখযোগ্য অংশ অদক্ষ। পুরনো ফিটনেসবিহীন লক্কড়-ঝক্কর গাড়ি, অদক্ষ চালক দ্বারা নিয়ন্ত্রণহীণভাবে চলছে। এরা ড্রাইভিং নীতিমালা না জানার ফলে কাপ্তাই সড়ক মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। বেপোয়ারা যানবাহন চলাচলে প্রতিনিয়তে এই সড়কে প্রাণ হারাচ্ছে অনেক মানুষ।
গত বছরের ডিসেম্বর মাসে সিএনজি উল্টে আহত হয় আব্দুল্লাহ আবীর ও কৌশিক কাব্য নামের চুয়েটের দুই শিক্ষার্থী। উক্ত দুর্ঘটনায় কৌশিক কাব্যের ফিমার ভেঙ্গে যায় এবং দীর্ঘসময় তাকে স্ট্রেচারে চলাফেরা করতে হয়। এছাড়া ইনজুরির জন্য শরীরের বিভিন্ন স্থানে সেলাই করা প্রয়োজন পড়ে আব্দুল্লাহ আবীরের।
আহত শিক্ষার্থী কৌশিক কাব্য বলেন, যে রাস্তায় আমার বন্ধু লাশ হলো, যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে সজোরে বিচার চাইলাম, রাস্তার উন্নয়ন চাইলাম, অথচ সে রাস্তায় কয়েকমাসের মাথায় আমার এক্সিডেন্ট হয়ে ফিমার ভাঙছে। এর চেয়ে দুঃখের বা ব্যর্থতার আর কিছু হইতে পারেনা। প্রতিদিন নতুন নতুন এক্সিডেন্টের খবর শুনি আর শিউরে উঠি। সেদিন সকালের সেই স্মৃতি চোখের উপর ভাসে।
তিনি আরো বলেন, এই রাস্তায় আমি সহজে সিএনজিতে উঠিনা আর, কিন্তু বাধ্য হয়ে এরপর যতবারই উঠেছি পুরা রাস্তা আমার জন্য ট্রমাটিক ছিল। একটা রাস্তায় এক্সিডেন্ট হওয়ার জন্য যা যা থাকা দরকার সবই বিদ্যমান। নাই কোনো ডিভাইডার, নাই প্রশস্ততা, নাই কোনো রেগুলেশন, তার উপরে একঘেয়ে সোজা পথ। এরমধ্যে অদক্ষ চালকের হাতে সিএনজির মত ঝুকিপূর্ণ যানবাহন। এই রাস্তায় প্রতিটি মৃত্যু আমার কাছে রাষ্ট্র কর্তৃক হত্যা, যে হত্যার বিচার কখনোই হবেনা।
চলতি বছরের ২৩ শে ফেব্রুয়ারি পিকনিকে যাওয়ার সময় পিকনিকে যাওয়ার সময় প্রায়ই ৪০ জন যাত্রী নিয়ে উল্টে যায় বাস। এতে ১৩ জন আহত হয়। গতমাসের ১৪ মার্চ রাঙামাটির কাপ্তাই বিএন স্কুল এন্ড কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্র মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়। দুইদিন আগে (২৪ এপ্রিল) বাইক দুর্ঘটনায় হবু স্বামী স্ত্রী নিহত হয়। গতকাল ২৬ শে এপ্রিল রাঙ্গামাটিতে পিকআপ ভ্যান ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে পাঁচ জন নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ঘটনাস্থলে তিন জন এবং হাসপাতালে নেওয়ার পথে দুই জনের মৃত্যু হয়। এই সড়কে মৃত্যুর আর্তনাদ যেন নিত্যদিনের ব্যাপার।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রকল্যাণ অধিদপ্তর এর উপ-পরিচালক ড. মো. আবু মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, এ ধরনের ঘটনা যেগুলো প্রতিনিয়ত ঘটছে তা খুবই মর্মান্তিক। এজন্য ট্রাফিক ব্যবস্থা উন্নীতকরণ, অবৈধ এবং ফিটনেসবিহীন যানবাহন অপসারণের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
এই সমস্যা সমাধানে প্রশাসন কি অবস্থান নিতে পারে জানতে চাইলে পুরকৌশল বিভাগে চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ইতমাম ওবাইদ সামিন বলেন, ২০২৪ সালের ২২ এপ্রিল এই সড়ক আমাদের প্রিয় সহপাঠী শান্ত ও ছোটভাই তৌফিকের অমূল্য জীবন অকালে ছিনিয়ে নেয়। বিভিন্ন সময়ে চুয়েটের শিক্ষার্থী ছাড়াও আরো অনেকে নানাভাবে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। ফিটনেসবিহীন গাড়ি, দক্ষতাবিহীন চালক, লাইসেন্সবিহীন গাড়ির আনাগোনা সময়ে সময়ে দুর্ঘটনার মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। দ্রুত বাঁকগুলোর সংস্কার এবং প্রশস্তকরণ এর পাশাপাশি নিয়মিত ট্রাফিক মনিটরিং, স্পিড ব্রেকার স্থাপন ও ফিটনেসবিহীন যানবাহনের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যনে কঠোর বিধিনিষেধ প্রণয়ন-ই পারে দুর্ঘটনার মাত্রা কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে আনতে।
কম্পিউটার বিজ্ঞান ও কৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী নাহিন মুনকার বলেন,কাপ্তাই সড়ক তো দুর্ঘটনা আর লাশের মিছিলের আরেক নাম৷ এইতো কয়দিন হল, আমার ভাই শান্ত-তৌফিকের রক্তের দাগ এখনো শুকায় নাই। মাত্র কদিন আগে একজন কলেজছাত্র রোড এক্সিডেন্টে নিহত হল। প্রতিবছর হতাহত হচ্ছে, ষাটের অধিক দুর্ঘটনা হয়েছে ফি বছরে, শতাধিক আহত হচ্ছে, নিহত হচ্ছে অনেক। গাড়ির গতিবিধি, অপরিকল্পিত সড়কে ফিটনেসবিহীন গাড়ি দিয়ে চালকদের নিয়ন্ত্রণহীন ড্রাইভিং এখানে বিপদের মাত্রাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
তিনি আরো বলেন, অথচ, এই দুর্ঘটনা সম্বলিত কাপ্তাই সড়কই অসংখ্য মানুষের রিজিকের রাস্তা, তাদের নিয়মিত যাতায়াত করতে হচ্ছে ঝুঁকির মধ্যে দিয়েই। কাপ্তাই রাস্তার মাথা থেকে কাপ্তাই পর্যন্ত অর্ধশত কিলোমিটারের এই পথে ৩৫-৪০ টির অধিক বাঁক আছে। এগুলো বরাবর ঝুঁকিপূর্ণ। এ অবস্থায় উশৃংখল ড্রাইভিং এর বলি হতে হচ্ছে সাধারণ মানুষদের। গতকাল হবু স্বামী-স্ত্রীর মৃত্যু হল, এই লাশের মিছিল প্রতিনিয়ত বড় হচ্ছে। এই রিস্কি এরিয়ার গতি নিয়ন্ত্রণ, পুলিশবক্সের কঠোর মনিটরিং, সড়ক উন্নয়নের জন্য কঠোর ব্যাবস্থাপনা ছাড়া জনগণের মুক্তি নেই।
আনন্দের সংবাদ হলো চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়ক প্রশস্তকরণের মাধ্যমে চার লেইনে উন্নীতকরণ এর কাজ। প্রাথমিকভাবে সড়কটির মোহরা রাস্তার মাথা থেকে রাউজান গশ্চি ধরের টেক পর্যন্ত দুটি প্যাকেজে সাড়ে ১৩ কিলোমিটার সড়ক প্রশস্ত করার কাজ চলছে। এতে খরচ হচ্ছে ৫০ কোটি টাকা। ইতিমধ্যে ঠিকাদার নিয়োগ সম্পন্ন করে বাকি কাজ চলমান আছে।
সড়ক সরু হওয়ার কারণেই কি এই দুর্ঘটনা? নাকি এতে আছে চালকের অসাবধানতা এবং প্রশাসনের গাফিলতি? সড়ক চারলেইন করলেই কি দুর্ঘটনা থেমে যাবে? এখনো নিশ্চিত ভাবে বলা যাচ্ছে না এসব প্রশ্নের উত্তর। এই সড়ক সংলগ্ন ৪ উপজেলার প্রায় ৯ লক্ষ মানুষ ও চুয়েট শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতে কি আছে তা এখনো অনিশ্চিত।
দুই শান্ত- তৌফিকের মৃত্যু কি যথেষ্ট ছিল? নাকি এই সড়ক নিরাপদ নিশ্চিত করতে আরও ঝরাতে হবে হাজারো প্রাণ?