চির সবুজের স্বর্গীয় ভূমি হোক আগামীর বাংলাদেশ

রশীদ এনাম | শুক্রবার , ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ at ৫:২৭ পূর্বাহ্ণ

প্রকৃতিপ্রেমী দ্বিজেন শর্মা প্রকৃতিকে নিয়ে বলেছিলেন, ‘মানব সভ্যতা আজ বিপন্ন প্রকৃতি ও মানবের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। মানুষ যেন প্রকৃতিকে বাদ দিয়েই চলতে চায়। মানুষের এই ব্যবহারে প্রকৃতি এখন রূষ্ট। প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে যে যুদ্ধ শুরু হয়েছে তাতে মানুষের জেতার কোনো সম্ভাবনা নেই। এ দেশে আরেকটি নতুন সভ্যতা গড়ে তুলতে হবে। যেখানে মানুষ ও প্রকৃতি সহাবস্থানে থাকবে। মানুষ তুমি বৃক্ষের মতো আনত হও সবুজ হও’। প্রকৃতিকে বাঁচাতে হলে বৃক্ষরোপণ আন্দোলন গড়ে তোলতে হবে এবং গাছকে কর্তন নয় সংরক্ষণ করুন। কদিন আগেও সারাদেশে অসহনীয় তাপমাত্রায় মানুষ হারে হারে টের পেয়েছে। খরতাপ দাহ থেকে বাঁচার জন্য দেশের মানুষ একটু ছায়া একটু শীতল হাওয়া খুঁজে ফিরেছে। আমরা এও দেখেছি করোনাকালীন একটু অঙিজেনের জন্য কতো হাঁসফাঁস করেছে মানুষ। অক্সিজেনের ভাণ্ডার যে গাছ আমরা ভুলে যায়। যান্ত্রিক ধূসর নগরী ঢাকায় বড়ো বড়ো গাছগুলো বিলুপ্তের পথে। সরকারি বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে নির্বিচারে গাছ কাটার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। রাজধানীতে একসময় বড়ো বড়ো পাকুড়, বট, রেইন ট্রি ছিলো এখন তা দেখা মিলে না। প্রকৃতিবান্ধব তাল গাছকে বলা হয় বন্ধু বৃক্ষ। বজ্রপাতের প্রাণহানি কমাতে তালগাছ লাগানো পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে দুর্যোগ মন্ত্রণালয়। তালগাছ রাস্তার পাশে প্রাকৃতিক শোভা বর্ধণ করে। তাল গাছের ডালে বাবুই পাখির বাসা দুলে এখন শুধু বইয়ের পাতায় আছে বাস্তবে দেখা মিলে না। তালগাছ নেই বাবুই পাখির বাসাও নেই।

বিদ্যুত বিভাগ, ওয়াসা, সড়ক ও জনপদ বিভাগকে দেখা যায় বিদ্যুতের লাইন টানার নামে কিংবা সড়ক প্রশস্ত করার নামে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করে বর্ষিয়ান গাছগুলোর উপর চড়াও হয়। যে বৃক্ষটি বিনামূল্য নিয়মিত অঙিজেন দেয় তাকে নিমিষে হত্যা করি। কি নিমুক হারাম মানুষ। খুব অবাক হয়েছি কিছুদিন আগে পটুয়াখালি জেলার কলাপাড়ায় গ্রামীণ সড়ক নির্মাণের সময় ৩০টি তাল গাছ কেটে সাবাড় করেছে। এজন্য হাইকোট নির্দেশনা দিয়েছে অনিবার্য প্রয়োজনে একটি গাছ কাটলে ঐ গাছের পরিবর্তে ১০টি গাছ লাগাবে। এবং আগে গাছ লাগাতে হবে তারপর কাটবে। চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের মূল ফটকের অক (Acquired Knowledge) নকশাটি ও চট্টগ্রাম চারুকলা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ শিল্পী সবিহ্‌ উল আলম স্যারের করা। বর্তমানে ফটকটি ভেঙে ফেলা হয়েছে) নকশাটি করার সময় প্রকৃতিপ্রেমী শিল্পী প্রফেসর সবিহ্‌ উল আলম বর্ষিয়ান রেইন ট্রিকে বাঁচানোর জন্য নান্দনিক কলেজের ফটকের নকশাটি সরু করেছিলেন। দৃষ্টিনন্দন প্রবেশদ্বারটি ভেঙে নতুন করে করার জন্য বর্ষিয়ান রেইনট্রিগুলো কেটে সাবাড় করেছে। চট্টগ্রাম শহর থেকে কক্সবাজার যাওয়ার পথে মাঝে মাঝে পাখিডাকা ছায়াসুনিবিড় রাস্তার দুপাশে কিছু বর্ষিয়ান গাছ ছিলো। গাড়ি করে যাওয়ার সময় মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গাছগুলোর সৌন্দর্য উপভোগ করতাম। রাস্তা বড়ো করতে গিয়ে গাছগুলো কর্তন করা হয়েছে। গাছের শরীরে মাশাআল্লাহ পেরেক, ব্যানার, দাবটি চাকুকুন্তি কোড়াল এসবের কোপ তো নিয়মিত আছে। অনেক অভদ্রদের দেখা যায় লাইন ধরে গাছের গোড়ায় প্রকৃতির কাজ সারে, লজ্জা শরমের বালাই নেই। ময়লা আবর্জনা গাছের নিচে ছুড়ে ফেলে। যতো অত্যাচার সব গাছের উপর। সম্প্রতি আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যেমে দেখেছি, যুক্তরাজ্যের ওয়েলসে সবচেয়ে উঁচু একটি পাইন গাছটি ঝড়ে বিধ্বস্ত হয়। গাছটি কেটে ফেলার দরকার হয় কিন্তু কাঠুরে শিল্পী সাইমন রোর্কে গাছটির স্মৃতি ধরে রাখতে গাছটিকে না কেটে হাতের আদলে একটি চমৎকার শিল্পরূপ দেন। শিল্পকর্মটি একটি বিশেষ অর্থবহন করে, পৃথিবীতে যারা গাছ কেটে প্রকৃতির ক্ষতি করছে, তাদের বিরুদ্ধে এই হাতটি প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে বুঝানো হয়েছে। এসবের মাঝেও আনন্দের সংবাদ হলো চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসন কদমতলী, বটতলী, আমবাগান, নিমতলাসহ গাছের নামে যে এলাকায় রয়েছে সেই নামের সঙ্গে মিল রেখে গাছ লাগানোর উদ্যোগ নিয়েছে সত্যি প্রশংসার দাবী রাখেন চট্টগ্রাম জেলাপ্রশাসন।

পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে উন্নয়ন কাজ করার সময় বৃক্ষকে কিভাবে বাঁচিয়ে রাখা যায় সে চিন্তা করে কাজ করে। অথচ আমাদের দেশে উন্নয়নের নামে কাজ শুরু করার আগে গাছের উপর করাত কোড়াল দিয়ে কোপ মারার প্রতিযোগিতা শুরু হয়। একশ্রেণির মানুষ রাজনীতি বা জনপ্রতিনিধিদের প্রভাব দেখিয়ে গাছ কেটে চুরি করে বিক্রি করে। উন্নয়নের নামে গাছ বিক্রির টাকা দলদাসদের পকেটে না হয় সরকারি আমলাদের পকেটে যায়। পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার সত্য কথা বলেছেন, ‘বৃক্ষ বাঁচিয়ে উন্নয়নের চিন্তা এ দেশে নেই’। তাঁকে ধন্যবাদ তিনি যে বিষয়টি গভীরভাবে অনুধাবন করেছেন। যারা গাছের উপর নির্বিচারে অত্যাচার কর্তন করেন। এদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত এবং বর্ষিয়ান গাছগুলো রক্ষাণাবেক্ষণ জরুরি।

সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মুর্তিরমতো বর্ষিয়ান পাকুড় এবং বট গাছগুলোর নিচে গেলে কি প্রশান্তি শীতল হাওয়া। এসব গাছের ফলগুলো পাখিদের খুব প্রিয় খাবার। তাছাড়া এসব গাছে নানা রকমের পাখির অভয়ারণ্য বিশেষ করে, টিয়া, ময়না, বুলবুল, বট ঘুঘু, চিঁহি, শালিকসহ নানারকমের পাখির আবাসস্থল। তাছাড়া গাছের সংকটে অনেক বুনো প্রাণী এবং বিহঙ্গ বিলুপ্তের পথে। একবার ভেবে দেখেছেন? অক্সিজেন কিন্তু আল্লাহর দান। যেটা প্রকৃতি থেকে মানবদেহে প্রবেশ করে। একটা গাছ বছরে ১১৮ কেজি অঙিজেন সরবরাহ করে। বাতাস থেকে শোষণ করে ২৩ কেজি কার্বণডাই অঙাইড। একটি গাছ প্রায় দুজন মানুষের অক্সিজেন যোগায় ।

পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মনীষী প্রিয় নবিজি হযরত মুহাম্মদ(সাঃ) বলেছেন, ‘যদি তুমি জানো পরের দিনই রোজ কেয়ামত, তারপরেও একটি গাছ লাগিও’। ‘পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ’ গ্রন্থর লেখক আহমদ ছফা লিখেছেন, ‘বৃক্ষের ভেতর যে সরল জীবনপ্রবাহ স্পন্দিত হয়, তার সঙ্গে মানুষের হৃদস্পন্দনের অবশ্যই একটা মিল আছে। প্রকৃতিগতভাবে উভয় একই বস্তু। কিন্তু তারতম্য শক্তি হচ্ছে গতিশীলতায়। একজন পুরুষ একজন নারীর সঙ্গে যেভাবে সম্পর্ক নির্মাণ করে, সেভাবে একজন মানুষ একটি বৃক্ষের সঙ্গে সম্পর্ক সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু মানুষ যিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতে পারেন, বৃক্ষেরও একটি জীবন্ত সত্তা রয়েছে, অন্য যে কোনো প্রাণীর মত’।

গাছ নিয়ে বিশ্বকবি রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘গাছগুলি যে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ওদের মধ্যে যেন একটা না জানা ভাব আছে সেই ভাবনায় বর্ষার মেঘের ছায়ায় নিবিড়ে শীতের সকালের রোদ্রোজ্জ্বল হয়ে উঠে। সেই না জানা ভাবনার ভাষায় কচি পাতায় ওদের ডালে ডালে বকুনি জাগে, গান ওঠে ফুলের মঞ্জুরিতে’।

প্রকৃতি আজ বিপন্ন। প্রতিনিয়ত দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। পাখি ডাকা ছায়াঘেরা সবুজ গ্রামও হারিয়ে যেতে বসেছে। বৃক্ষ খেকোরা থেমে নেই, প্রতিনিয়ত সাবাড় করে চলেছে। গাছ খেকোদের জন্য প্রকৃতি ফোঁসে উঠছে। দিন দিন বেড়ে চলেছে তাপদাহ, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প, বন্যা, বজ্রপাতসহ মহামারি পিছু ছাড়ছে না।

আগামীর বাংলাদেশকে সবুজায়ান করতে পাড়ায়, মহল্লায়, ক্লাব, সংগঠনের তরুণসমজাকে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে। এবার বিশ্বপরিবেশ দিবসের স্লোগান ছিল প্লাস্টিক দূষণ সমাধানে সামিল হই সকলে। ‘সবাই মিলে করি পণ বন্ধ হবে প্লাস্টিক দূষণ’ আমাদের প্রত্যেকের উচিত অন্তত তিনটি করে গাছ লাগানো। দেশীয় ফল খাওয়ার পর বীজগুলো ফেলে না দিয়ে যত্ন করে মাটিতে রোপণ করি। পরিবেশ রক্ষা করতে গাছ লাগানোর কোনো বিকল্প নেই। যেখানে খালি জায়গা বিশেষ করে উঠানে, মাঠে, বাড়ির ছাদে কিংবা পরিত্যক্ত জায়গায়, গাছ লাগাতে পারে। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য গাছ। মনকে ভালো রাখতে প্রকৃতিকে ভালোবাসতে হয়। গাছ কর্তন নয় এখন গাছ লাগানোর শ্রেষ্ঠ সময়। প্রকৃতি বাঁচলে বাঁচবে দেশ, চিরসবুজের স্বর্গীয় ভূমি হবে আগামীর বাংলাদেশ।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও ব্যাংকার।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেহ সক্ষমতায় ফিজিওথেরাপি
পরবর্তী নিবন্ধরাউজানের আশ্রয়ণ প্রকল্পসমূহ পরিদর্শন করছেন ইউএনও