কবিতার কথায় সেই তেরোশত নদী আর নিরন্তর নদীপথ যাত্রা পেরিয়ে এক অনন্ত সুখের সবুজে ঘেরা সুন্দরবন। এ এমনই এক সবুজ যা মানুষ কেবল স্বপ্নে দেখে। সমুদ্রের জলের গভীরতার মতো গভীর এ সবুজ, আকাশের অম্লান নীলিমার মত অমলিন এ সবুজ। এ সবুজের গহীন হৃদয়ে কি আছে জানি না, শুধু এটুকু জানি, এ সবুজ মানব হৃদয়ে বড্ড স্বস্তি দেয়, শান্তি দেয়। হৃদয়ের ওপর বয়ে যাওয়া সমস্ত যন্ত্রণাকে ততক্ষণ ম্লান করে রাখে যতক্ষণ মানুষ তার সান্নিধ্যে থাকে।
এই সবুজের তো কতশত ভিন্নতা আছে। কয়েকটা রকমফের দেখতে পেলাম চোখের সামনে। কখনো শিশুর মত, কখনো টিয়াপাখি, কখনোবা হলুদ ফুলে মাখামাখি হলদে সবুজ, কখনো যেন মায়ের কথা না শোনা ঝাঁকরা চুলের দস্যি শ্যামল কন্যার সেই গায়ের রঙের মত গাঢ় সবুজ!
কি অপার সৌন্দর্য!
দুটো চোখ শুধু জুড়িয়েই যায়।
ছোটবেলায় দাদুকে(আমরা ঠাকুমাকে দাদু ডাকতাম) দেখতাম ভোরের আলো খুলতেই বাহির বারান্দায় গিয়ে বসতেন। অপলক তাকিয়ে থাকতেন সবুজের দিকে। আমি প্রশ্ন করলে বলতেন “কথা বলিস না, সবুজগুলো দেখ। দেখতাম। এমন করে ঘন্টাখানেক কাটিয়ে গেলে রোদ চড়া হলে দাদু উঠে যাওয়ার সময় বলতাম ও দাদু বলনা….সবুজ কেন দেখতে হয়? দাদু বলতেন, ঘুমভাঙা চোখে ভোরের সবুজ দেখলে দৃষ্টি প্রখর হয়, চোখ ভালো থাকে, চোখের প্রেসার বাড়ে না।” চোখের আবার প্রেসার কি? কি জানি বাপু, দাদুর অত গুরু গম্ভীর কথা মাথায় কিছুতেই ঢুকতো না।
বয়স যখন বিশ পেরোলো তখন জানতে পারলাম “গ্লুকোমা” বা চোখের প্রেসার সম্পর্কে। তখন থেকেই চিরন্তন সবুজ দেখলেই আমার মনের কোটরে সযতনে রাখা দাদুর সেই উক্তিটি মনে পড়ে “চোখের প্রেসার”!
দাদুকে মনে মনে ভালোবেসে আমি সবুজকে আলিঙ্গন করতে থাকি আমার সমগ্র অস্তিত্ব দিয়ে।
দু’পাশে চিরসবুজ ম্যানগ্রোভ আর বুক উপচানো ভালোবাসার জীবন স্রোত নিয়ে বয়ে চলে কল্লোলিনী “বলেশ্বর”। নদী যেখানেই থাকে সেখানেই প্রকৃতি যেন চিরকুমারী। কখনোই যেন যৌবন ফুরায় না তার। তারই যৌবনের অনুষঙ্গগুলোর দেখাও পেলাম একটু আধটু। তার মনের রাজা,বনের রাজা,রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে না দেখলেও তার নিরীহ প্রজাদের দেখলাম বেশ। দেখলাম সদ্য কিছু গিলে খেয়ে ফেলা গলনালী নিয়ে বেরসিক বিশ্রাম করছে এক বিষধর শঙ্খচূড়ের ছানা। শুশুকগুলো ডিগবাজি খেলছিল বলেশ্বরের জলে। হঠাৎ একটি শূকর ঘাটের পানে আসতে চেয়ে আমাদের দেখে ভোঁ দৌড় দিয়ে ঢুকে গেল অরণ্যে।
মায়া হরিণ চকিতে এসে মায়া লাগিয়ে গেল। তাকে আরো দেখবার প্রতীক্ষায় অধীর হল চোখ। কিন্তু সে দেখা দিল না আর। মাছরাঙারা কয়েকজন মিলে পালা করে ছোঁ মারছিল জলে আর চতুর ঠোঁটে তুলে আনছিল মৎস্য মুলুক। ঝিঁঝি পোকার ডাকে তালা লেগে যাচ্ছিল কানে। দূরে কোথাও ঘুঘু ডাকছিল। সুর্য দেব বলেশ্বর নদীর কোণ থেকেই বিদায় জানালেন আমাদের। মনে পড়ল বন কর্মকর্তাদের বেঁধে দেয়া সময়ের কথা।
ঐ এক টুকরো ঘাটে কিছু সুন্দর ছবিতে বন্দী হলাম আকরাম ভাইয়ের কল্যাণে। কারণ এমন স্মৃতি বড্ড মধুর হবে সুদূর ভবিষ্যতের জন্য। কন্যারা বলেশ্বরের জলের মতই ছলাৎ ছলাৎ করল অতটুকু সময়। ডাক্তারবাবুর যত তাড়া। যেন গুরুতর অসুস্থ কোনো রোগীর ব্যবস্থা করতে যেতে হবে তাকে তখনই।
সন্ধ্যা নামতেই আবার খেয়া পার করলাম। বড় কন্যা নৌকার দাঁড় হাতে নিয়ে জল কাটার চেষ্টা চালাল। আমার পুঁটি ছানার মনটা পড়ে রইল জলে। আর আমি মিশে রইলাম বনের গভীরে, ঝিঁঝিদের বাগানে, বলেশ্বরের ঢেউয়ে আর দাদুর সাথে দেখতে শেখা সেই চির অবারিত সবুজে।