বছর ঘুরে আমাদের জীবনে আবার এল ঈদ। এই ঈদ উৎসব মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও ভাবনাকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হয়। মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব হলো ঈদ। ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে খুশি। ঈদের আনন্দ যেমন আছে, কল্যাণও আছে। ঈদ উৎসব আমাদের মনে শুধু আনন্দের সঞ্চার করে না, আমাদেরকে দৈনন্দিন জীবনের সংকীর্ণ গণ্ডি থেকে মিলনের বৃহত্তর ক্ষেত্রেও উত্তীর্ণ করে। প্রতিটি উৎসব জীবনের ছন্দ স্পন্দন, প্রতিদিনের তুচ্ছতার যবনিকা, আত্মার দিগন্ত প্রসারণের চলন্তিকা। শান্তি, ঐক্য, একতা, সমপ্রীতি, ত্যাগ ও সম্ভাবনার বাণী বহন করে যে কোনো উৎসব…ঈদ উৎসবও এর ব্যতিক্রম নয়।
মানুষের বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা প্রবল। এ আকাঙ্ক্ষা শুধু ভোগের মাঝে সীমিত নয়। ঈদ উৎসব মানুষকে স্রষ্টার অসীম মহিমা এবং তার ভালোবাসা জাগ্রত করে। এই উৎসব প্রেম- পুণ্যে আপন মহিমার ছাপ পৃথিবীতে রেখে অপমরতার শিক্ষা দেয় মরণশীল মানুষকে। ঈদ উৎসব আমাদের জীবনে এক নতুন প্রাণ ও নির্মল আনন্দ সঞ্চার করে। ঈদের আগমনকে জাতীয় কবি স্বাগত জানিয়েছেন এইভাবে–‘শত যোজনের কত মরুভূমি পারায়ে গো/কত বালুচরে কত আঁখি ধারা সরায়ে গো/ বরষের পরে আসিল ঈদ।’
ঈদুল ফিতর অনুষ্ঠিত হয় রোজার মাস শেষ হয়ে শাওয়ালে চাঁদ নীলাকাশে উদীয়মান হলে। সারামাস কঠোর সংযমের মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদত বন্দেগী সমাপনের আল্লাহর কাছ থেকে পুরস্কার হিসেবে আসে ঈদুল ফিতর। ধর্মীয় চেতনার সঙ্গে আনন্দের সংযোগ থাকায় ঈদ উৎসব হয়ে ওঠে পবিত্রতম অনুভূতিতে আনন্দমুখর। এই পরমানন্দ মুহূর্তটি মুসলমানেরা ধর্মীয় নির্দেশনা অনুযায়ী গরিবদের ফিতরা দিয়ে থাকে। যেনো গরিবরাও আনন্দমুখর হয়ে ঈদ আনন্দ উপভোগ করতে পারে। এতে ধনী- গরিবের ব্যবধান কমিয়ে এই উৎসব সকলকে সাম্যের বন্ধনে আবদ্ধ করে।
মসজিদে নামাজ পড়ে পরস্পর কোলাকুলি করে, ঘরে এসে খাওয়া- দাওয়া করে পাড়া- প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি বেড়িয়ে ঈদের যে আনন্দ উপভোগ করা হয় প্রতিবছর। এবারও তাতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে মহামারি করোনাভাইরাস। ২০২০ সালের ঈদের মতো সারা বিশ্বের মুসলমানদের কাছে এবারের ঈদও এসেছে অদৃশ্য শত্রু করোনা কবলিত হয়ে। বিশ্বে প্রতিদিন হাজার হাজার লোক মারা যাচ্ছে এই ভাইরাসে। মানুষ হারাচ্ছে তার আত্মীয়- পরিজন প্রতিনিয়ত। বিশ্বের ঘরে ঘরে মৃত্যুর কান্না– প্রিয়জনকে হারানোর বেদনা। আমাদের দেশে গত ঈদের বছরের চেয়ে এবছর এই মহামারির বিস্তার অনেক বেশি। মৃত্যুর তালিকাও এবার অনেক লম্বা। এখন আমাদের উৎসব পালনের চেয়ে অদৃশ্য এই শত্রুকে মোকাবেলা করে সুন্দর পৃথিবীতে শ্বাস নিতে পারাটা মুখ্য বিষয়। কাজেই এবারও ঈদ আনন্দ মনে স্থান পাওয়ার মত সময় আসেনি আমাদের। করোনা মহামারি আমাদের মন থেকে ঈদের শপিং যাওয়া, পছন্দের রান্না- বান্না করা, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া- প্রতিবেশীকে খাওয়ানো, দূরগ্রামে অবস্থিত পরম আত্মীয়দের কাছে ছুটে যাওয়া সবই কেড়ে নিয়েছে। যেমনটি ঘটেছিল ১৯৭১ সালে বাংলার ঘরে ঘরে আসা ঈদের। সেসময় মানুষ ঘরে বন্দী ছিল দৃশ্যমান শত্রু পাক সেনার ভয়ে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ঈদ পালন করেনি মুক্তিযোদ্ধারা বরং দেশ স্বাধীন করে বিজয়ের ঈদ উৎসব পালনের প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। ৭১ এ আনন্দের ঈদ ছিল না, প্রিয়জনের শোকে সেদিন ছিল অশ্রুর ঢল।
করোনাকালীন এই ঈদে জাতি- ধর্ম- বর্ণ-গোত্র – ভাষা সব ভেদাভেদ ভুলে মানবতার শত্রু অদৃশ্য শক্তির দেওয়ালকে ভাঙ্গতে জোর প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। আতংকের স্বেচ্ছায় বন্দী জীবনে চির চেনা ঈদ আনন্দকে উপভোগ করি এবারও ঘরে বন্দী অল্প আয়োজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে। কারণ এই মহামারি থেকে বাঁচার উপায় হলো মানুষের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা। আর নিজের জন্য যে বাড়তি খরচ করা হতো সেটি করোনায় কর্মহীন অভাবগ্রস্ত মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে মহিমান্বিত ঈদের আনন্দকে বুকে ধারণ করি।
আমরা সুস্থ পৃথিবীতে আবারো হাসিমুখে নীলাকাশের রঙিন চাঁদ দেখে উৎফুল্ল মনে ঈদ পালনের আকুলতায় কবির ভাষায় যেনো রাঙাতে পারি জীবন—‘পথে পথে আজ হাঁকিব বন্ধু/ ঈদ মুবারক! আসসালাম/ ঠোঁটে ঠোঁটে আজ বিলাব শিরনী ফুল- কালাম/ বিলিয়ে দেওয়ার আজিকের ঈদ।’
লেখক: প্রাবন্ধিক, শিক্ষক