চিরন্তন ত্যাগের প্রতীক

ফারজানা আজিম | বৃহস্পতিবার , ৫ জুন, ২০২৫ at ৬:১৩ পূর্বাহ্ণ

কোরবানি কেবল একটি ধর্মীয় অনুশীলন নয়, এটি এক মহান দর্শন, এক চিরন্তন ত্যাগের প্রতীক। কোরবানির মর্মবাণী শুধু পশু জবাইয়ের আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এর গভীরে লুকিয়ে আছে আত্মনিয়োগ, নিঃস্বার্থতা এবং সর্বোচ্চ ত্যাগের শিক্ষা। ইতিহাসের পাতায় ইব্রাহিম (আঃ🙂 ও ইসমাইল (🙂এর অমর ত্যাগের কাহিনি শুধু ধর্মীয় নয়; এক মানবিক শিক্ষা যেখানে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার মধ্যেই রয়েছে প্রকৃত বিশ্বাসের প্রকাশ। কোরবানি শব্দটি উচ্চারণে ত্যাগের এক গভীর আহ্বান ধ্বনিত হয়।

কোরবান কিন্তু কেবল পশু জবাইয়ের আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং আমাদের চারপাশেই প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে হাজারো অদৃশ্য কোরবানি। বাবামার নীরব নিঃস্বার্থ জীবন, নারীর জীবনে প্রতিটি পরতে সামাজিক দায়ের ভার, কৃষকশ্রমিকের ঘামে ভেজা উন্নয়ন, দেশের সৎ নাগরিকদের সত্যতায় চলার সংগ্রাম, সবই একটি রক্ত রক্তমাংসের কোরবান।

আমাদের বাবারা সারা জীবন নিজের স্বপ্নকে কোরবানি দিয়ে সন্তানদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করেন, মায়েরা নিজেদের চাওয়া পাওয়াকে বিসর্জন দিয়ে আমাদের শৈশবকৈশোর আর যৌবনের জন্য এক অব্যক্ত ইতিহাস রচনা করেন। আমাদের নারীরা জীবনে নানা প্রান্তের, নিজের অস্তিত্বকে ছোট করে অন্যকে বড় করে তোলেএটিও এক কোরবানি। আজকের বাস্তবতায় এই ত্যাগের নতুন রূপ আমরা আরো গভীরভাবে অনুভব করছি। বিশেষ করে বর্তমানে এমন এক অস্থির সময় চলছে, যেখানে বহু নিরীহ মানুষ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, অনেকেই চাকরি হারিয়েছে, বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতেযারা কোন অপরাধের সাথে জড়িত ছিল না। কিন্তু প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই কোরবানি পশু কিনতে পারার মত অবস্থায়ও নেই। অথচ হয়তো আগের বছর পর্যন্ত তারা পরিবারে আনন্দ ভাগাভাগি করতেন। এই কথাগুলো বলতে গিয়ে আমরা ভুলে যাচ্ছি না যারা অপরাধ করেছেন, অন্যায়ভাবে সম্পদ গড়েছেন, তাদের বিচার হতেই হবে। কিন্তু সে বিচার যেন নিরপেক্ষ হয়, যেন শত সহস্র নিরীহ মানুষের জীবন নষ্ট না হয় ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বিতার ছায়ায়। এই ত্যাগের মিছিলে আমরা ভুলে যেতে পারি না ২০২৪ এ শহীদ হওয়া সেই সাহসী সন্তানদের যারা গণতন্ত্র ও ন্যায় বিচারে স্বপ্নে প্রাণ দিয়েছেন। তাদের রক্ত কোরবানিরই আরেক ভাষ্যস্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার জন্য আত্মদান। আজকে এই সময়টাকে তাই বলা যায় এক দীর্ঘ কঠিন কোরবানির অধ্যায়, যেখানে মানুষ কেবল অর্থ বা পশু নয় হারাচ্ছে জীবিকা, মানসিক শান্তি, নিরাপত্তা ও স্বপ্ন। এই পরিস্থিতিতে কোরবানির তাৎপর্য নতুন ব্যঞ্জনা নিয়ে আসেএটি প্রশ্ন তোলে, ভাবায়, জাগায়। এই রূপক কোরবানি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, ত্যাগ কেবল অতীতে নয়, এটি এখনো ঘটছে প্রতিদিন, আমাদের খুব কাছেই। এইসব কোরবান আমাদের মনে করিয়ে দেয়ত্যাগের রূপ পাল্টায়, কিন্তু তার মর্ম অটুট থাকে। কখনো তা হয় নিঃশব্দ কখনো হয় রক্তাক্ত। আজকের অস্থির, কষ্টকর বাস্তবতায় এই কোরবানি যেন হয়ে উঠুক আমাদের জাগরণ আমাদের প্রতিজ্ঞা একটি ন্যায় ভিত্তিক মানবিক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের জন্য।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকোরবান নিজ স্বার্থ বিসর্জনের শিক্ষা দেয়
পরবর্তী নিবন্ধঈদের ছুটিতে সংঘাত-সহিংসতা এড়িয়ে চলুন