পিতা মাতার কাছে সবচেয়ে প্রিয় সন্তান। সবচেয়ে বেশি আদরেরও। এ সন্তানকে নিয়ে আনন্দের সীমা নেই, স্বপ্নেরও শেষ নেই। সবাই নিজের অপূর্ণ স্বপ্নগুলো সন্তানের মধ্যদিয়ে পূর্ণ করতে চায়। অনেকে নানা রকম অভাব অভিযোগ দু:খ কষ্টের ভেতর দিয়ে সন্তানকে গড়ে তুলতে চেষ্টা করে। আর্থিকভাবে যারা সচ্ছল তারা সন্তানদের চাহিদাগুলো সহজে পূরণ করতে পারে। অন্যরাও কষ্টে শিষ্টে পূরণ করতে চেষ্টা করে। বিত্তবানদেরতো কথাই নেই। তাদের সন্তানেরা না চাইতে পেয়ে যায়। তবে বিশেষ করে মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্তের ছেলে মেয়েরা মা–বাবার সুখ দুঃখের অংশীদার হয়। তাদের মাঝে একটা সহনশীল মনোভাব গড়ে উঠে। এরাই বেশি সফলকাম হয়। স্বপ্ন পূরণ করতে পারে। বাধা বিঘ্ন যত আসুক তা সহজে অতিক্রম করতে পারে। লক্ষ্যে না পৌঁছা পর্যন্ত অবিচল থাকে।
সব মা–বাবাই চায় ছেলে মেয়েকে উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে।তবে বেশির ভাগ বাবা–মা চায় তাদের সন্তান ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হোক। অনেকের ধারণা ছেলে মেয়ে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হতে পারলে মা–বাবার সম্মান বেড়ে যাবে। আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশির কাছে মুখ উজ্জ্বল হবে। এতে করে পরিবারের সামাজিক মর্যাদাও বৃদ্ধি পাবে। অবশ্য প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ হওয়ার পর ডাক্তারি পড়ার সুযোগ অনেক বেড়ে গিয়েছে। তবে এখানে আর্থিক সামর্থ্যের একটা বড় ব্যাপার রয়েছে। তাই মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্তের ছেলে মেয়েরা পাবলিক মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে। শ্রম মেধা সবকিছু দিয়ে চেষ্টা করতে থাকে। অনেকে ভর্তি পেয়ে যায়। তারা অনেকটা সৌভাগ্যবান। অন্যরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নেয়। সেখানেও প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে ভর্তি হতে হয়।
এদিক ওদিক অনেক জায়গায় চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত ছেলে মেয়েরা কোথা না কোথাও ভর্তি হয়ে যায়। সবাই যে পছন্দের জায়গায় ভর্তি হতে পারে তা নয়। বেশির ভাগ ছেলে–মেয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে লেখাপড়া শুরু করে। তবে মেডিকেলের ছেলে–মেয়েদের অনেক বেশি লেখাপড়া করতে হয়। ইঞ্জিনিয়ারিংও নিয়মিত লেখাপড়ায় থাকতে হয়। ভার্সিটিতে বেশির ভাগ ছেলে–মেয়ে কিছুটা রিলাক্স মুডে থাকে। পরীক্ষা এলে খুব মনোযোগি হয়ে পড়ে। আবার কিছু ছেলে–মেয়ে আছে প্রথম থেকে লেখা পড়ায় সিরিয়াস থাকে। এরা ফলাফলও খুব ভাল করতে পারে। অন্যরা যে খারাপ করে তা নয়। তবে খুব ভাল ফলাফলের উপর অনেক কিছু নির্ভর করে। ডিপার্টমেন্টে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেয়ার সুযোগ হয়ে যেতে পারে। অনেক ছেলে–মেয়ে বিসিএসএর উপর খুব জোর দেয়। ডিপার্টমেন্টের পরীক্ষার চেয়ে বিসিএস পরীক্ষাকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে প্রস্তুতি নিতে থাকে। অনেকে সফলকাম হয়। তখন মা–বাবারাও ছেলে–মেয়ের উপর অনেক খুশী হয়। গর্ববোধও করে।
যে যেখানে পড়ুক না কেন বিশেষ করে ছেলেরা কোথাও না কোথাও একটা দুইটা টিউশনি করে। টিউশনির আয় থেকে তাদের মাসিক খরচ চলে যায়। এতে পরিবারের উপর খুব একটা চাপ পড়ে না। এখনকার ছেলে–মেয়েদের এটা একটা ভাল উদ্যোগ। তারা লেখাপড়ার বিনিময়ে কিছু উপার্জন করতে পারে। এটা না হলে নিম্নবিত্তের ছেলে–মেয়েরা সহজে লেখাপড়া করতে পারতো না। আবার কিছু কিছু ছেলে–মেয়ে বেশ কয়েকটি টিউশনি করে থাকে। পরিবারকেও সাহায্য সহায়তা করার চেষ্টা করে। কোথাও না কোথাও একটা চাকুরী না পাওয়া পর্যন্ত তারা টিউশনির উপর নির্ভর করে থাকে। টিউশনি করা এসব ছেলে–মেয়েরা চাকরির পরীক্ষায়ও ভাল করে। ইন্টারভিউতেও টিকে যায়।
সবাই যে চাকরি করে তা নয়। কেউ কেউ ব্যবসার দিকে যায়। কোন না কোন পেশার সাথে যুক্ত হয়ে যায়। মা–বাবাও ভাবেনি, এরা ছাত্র জীবনেও কখনো ভাবেনি এমন পেশায় কেউ যুক্ত হয়। কেউ আবার উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখে। ছোটখাট কিছু শুরু করে। পথটা তেমন মসৃন নয়, তারপরও আকড়ে ধরে থাকে। এতে এক সময়ে সাফল্য আসতে শুরু করে। তখন শুধু সামনের দিকে এগিয়ে যায়। আগের বাধাগুলো অতিক্রম করতে সহজ হয়ে যায়। তবে অনেক সময় নতুন ধরনের বাধা আসে। এসব বাধা অতিক্রম করতে না পারলে টিকে থাকা যায় না। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে এসব বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করার সক্ষমতা অর্জন করতে হয়। এভাবে অনেকে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়। সমাজে নিজের অবস্থান সম্মানজনক অবস্থায় নিয়ে যেতে পারে। এসব ক্ষেত্রে অনেকটা ঝুঁকি থাকে বলে অনেকে আসতে চায় না। ঝুঁকি মোকাবেলা করার সাহস ও সামর্থ্য অনেকের থাকে না।
কেউ কেউ আবার দেশের বাইরে চলে যায়। লেখাপড়ার এক পর্যায়ে চলে যায়। ওখানে গিয়ে আবার ডিগ্রী নেয়। চাকরিও পেয়ে যায়। এদের বেশির ভাগ আর দেশে ফিরে আসতে চায় না। ওখানে তারা ভাল জীবন যাপন করে। আয় রোজগার যা করে একটা অংশ মা–বাবার কাছে দেশে পাঠিয়ে দেয়। এতে মা–বাবা খুশী থাকে। আবার অনেকে আছে যারা তেমন একটা লেখাপড়ার সুযোগ পায়নি। তারা বিদেশে গিয়ে ভাল রোজগার করতে পারে। যে কোন একটা কাজে যুক্ত হয়ে যায়। দেশে থাকলে হয়ত বেকার পড়ে থাকতো। ওখানে রাতদিন পরিশ্রম করতে থাকে। আয় রোজগার কিভাবে বাড়াতে হয় সে চেষ্টা চালায়। বাবা–মা সহায় সম্বল বিক্রি করে পাঠিয়েছে। তাদের কাছেতো মাসে মাসে টাকা না পাঠালে চলবে কি করে? এসব সন্তানেরা এক সময়ে পরিবারের অভাব অনটন দুর করে আর্থিক সচ্ছলতা নিয়ে আসে। বাড়ির পুরনো বাপ দাদার মাটির ঘরটা ভেঙে পাকা দালান গড়ে তোলে। এলাকায় তারা সম্মানিত হতে থাকে। শুধু তা নয় বিদেশে যারা থাকে তাদের পাঠানো অর্থ দেশের ফরেন কারেন্সী রিজার্ভে এসে যোগ হয়। এর মধ্য দিয়ে দেশেরও বড় উপকার হয়।
এভাবে মা–বাবার আদর যত্নের সন্তানেরা বড় হয়ে কোন না কোন পেশায় যুক্ত হয়ে যায়। আয় রোজগার করে নিজেদের চলার পথ সুগম করে। আবার মা–বাবার ভরণ পোষণও করে। প্রায় ক্ষেত্রে এরকম হওয়ার কথা থাকলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হয়ে যায়। তবে ব্যতিক্রমের সংখ্যাটা যখন ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে তখন তা ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এক সময়ে পরিবারে মা–বাবার সাথে সন্তানদের যে অকৃত্রিম বন্ধন ছিল তা যেন ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে যায়। সন্তানেরা যত বড় হতে থাকে তত দূরত্ব বাড়তে থাকে। বিশেষ করে শিক্ষিত ছেলে মেয়েদের মধ্যে এ প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা যায়। মেয়েরাতো একটা পর্যায়ে বিয়ে হয়ে গেলে স্বামীর কাছে চলে যায়। আবার ছেলেরাও বিয়ে শাদী করে ধীরে ধীরে মা–বাবার কাছ থেকে দূরে সরে যায়। অনেক ছেলে বউ নিয়ে আলাদা থাকে। কেউ দূরবর্তী স্থানে চাকরি করার সুবাধে দূরে থাকে। আবার কেউ একই সাথে থাকলে ঝামেলা হয়ে যাবে ভেবে আলাদা থাকে। একসাথে না থাকলেও অনেকে মা–বাবার খোঁজখবর রাখে। আবার কেউ কেউ মা–বাবাকে বোঝা মনে করে।
ছেলে–মেয়েরা এরকম আলাদা কেন থাকে তার যুক্তিও অনেক। সবচেয়ে বড় কথা সবাই স্বাচ্ছন্দে থাকতে চায়। ঝামেলায় কেউ জড়াতে চায় না। বাবা–মা যে ছোট বেলায় তাদেরকে আদর যত্ন করে বড় করেছে তা সহজে মনে করতে পারেনা। তাদের জন্য যে অনেক কষ্ট স্বীকার করেছে তাও ভাবতে পারেনা। তা না হলে নিজের সুখ স্বাচ্ছদের জন্য বাবা–মাকে কিভাবে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাতে পারে। সত্যিকার অর্থে ছেলে মেয়েরা কি সুখে আছে? নাকি শান্তিতে আছে? এদের দু’জনের মধ্যে অনেক দ্বন্দ্ব। স্বামী স্ত্রীর মাঝে যে বুঝাপড়া সেটাও অনেকের মাঝে নেই। একটা বা দুইটা সন্তান তারাও আবার মা–বাবার রেশারেশি দেখে, ঝগড়া বিবাদ দেখে বড় হতে থাকে। যে সুখ শান্তির জন্য তারা বাবা–মাকে দূরে সরিয়ে রেখেছে তার নাগাল কি তারা পেয়েছে। তাদের দাম্পত্য জীবন কি মায়ামমতা আর আন্তরিকতায় পরিপূর্ণ? তাদের সন্তানেরাও একসময় বড় হবে। সেসময় সন্তানেরা কি তাদের সাথে এরকম আচরণ করবে না। তখন তারা কোথায় যাবে? এসব ভাবার কারো সময় নেই। স্বামী স্ত্রী দু’জনই চাকরি করে হয়তো। যে যার মত করে অফিসে চলে যায়। মা–বাবারা তাদেরকে যেভাবে অদর যত্নে বড় করেছে তারা কিন্তু তাদের সন্তানদের সেভাবে বড় করতে পারছে না। সন্তানেরা তাদের মত করে ঘরে থাকতেছে। স্নেহ মায়া মমতার সংস্পর্শ থেকে এসব সন্তানেরা দূরে সরে যাচ্ছে। শিথিল হয়ে যাচ্ছে পারিবারিক বন্ধন। বাবা–মা, ভাই–বোন, দাদা–দাদী সবাইকে নিয়ে যে পারিবারিক বন্ধন তা যেন দিনের পর দিন হারিয়ে যাচ্ছে। আর্থিক সচ্ছলতা কিছুটা বাড়লেও পরিবারের যে আসল ভিত্তি সুখ–শান্তি তা আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
আগের মত পরিবার হয়ত আর গঠন করা যাবে না। একজন আরেক জনের প্রতি সহনশীল মনোভাব আর পরস্পরের শ্রদ্ধাবোধের মধ্য দিয়ে পরিবার টিকে থাকে। বর্তমান সময়ে এ দু’টির কোনটির অনুশীলন তেমন একটা নেই। কেউ কাউকে মানতেও চায় না। নিজের যুক্তিটা অনেক বড় করে দেখে। সমঝোতার মনোভাবটাও অনেকের কাছে নেই বললে চলে। পারস্পরিক বুঝাপড়ার বিষয়টাকে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। এটা না থাকলে একজন আরেক জনের কাছে যাওয়া যায় না। সমস্যার সহজ সমাধান পাওয়া যায় না। দিনের পর দিন ছোটখাট সমস্যাগুলো বড় হতে থাকে। এক সময়ে জটিল আকার ধারণ করে। তখন আর সহজে সমস্যা থেকে বের হওয়া যায় না। একসাথে থাকলেও সেখানে আন্তরিকতা থাকে না, অপার ভালবাসা থাকে না। তবে এর থেকে বের হতে চাইলে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সহনশীলতা, একজনের প্রতি আরেক জনের বিশ্বাস ও শ্রদ্ধাবোধ গড়ে তোলা। এক্ষেত্রে অকৃত্রিম ভালবাসার ক্ষমতা অসীম। সত্যিকার অর্থে একজন আরেকজনকে পরিপূর্ণভাবে ভালবাসতে পারলে এসব দ্বন্দ্ব সংঘাতের অবসান ঘটতে পারে এবং মানসিক যন্ত্রণারও অনেকটা লাঘব হবে। একইসাথে ভারসাম্যপূর্ণ ও সৌহার্দময় একটি পারিবারিক জীবন অতিবাহিত করা যেতে পারে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও বিশিষ্ট ব্যাংকার