নগরীর কোর্টহিলের অদূরের মেথরপট্টি এলাকায় আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যা মামলায় সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় দাশসহ ৩৯ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট গ্রহণ করেছেন আদালত। গতকাল চট্টগ্রামের মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট এস এম আলাউদ্দিন মাহমুদ বাদী জামাল উদ্দিনের উপস্থিতিতে শুনানি শেষে এ আদেশ দিয়েছেন। বাদীর আইনজীবী ও সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর মো. রায়হানুল ওয়াজেদ চৌধুরী দৈনিক আজাদীকে এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, আলিফ হত্যা মামলায় পুলিশ চিন্ময়সহ ৩৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেছিলেন। তবে তদন্তে পাওয়া সুকান্তকে সেখানে রাখা হয়নি। তার অব্যাহিত চাওয়া হয়েছিল। এ জায়গায় আমাদের আপত্তি ছিল। কারণ হচ্ছে– এ সুকান্ত সিএমপির অস্ত্র, মাদক, চুরি ও ডাকাতিসহ ৮টি মামলার আসামি। তদন্ত রিপোর্টেও তাকে দুর্ধর্ষ আসামি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা আজকে (গতকাল) উক্ত সুকান্তকে চার্জশিটে যুক্ত করার জন্য আদালতের কাছে আবেদন করি। শুনানি শেষে আদালত সুকান্তসহ ৩৯ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট গ্রহণ করেছেন।
তিনি বলেন, শুনানির সময় বাদী উপস্থিত ছিলেন। তবে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় কারাগারে থাকা আসামিদের আদালতে হাজির করা হয়নি। তারা ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন। আলিফ খুনের মামলায় গত ১ জুলাই চট্টগ্রামের মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের প্রসিকিউশন শাখায় বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় দাশসহ ৩৮ জনের বিরুদ্ধে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও নগর পুলিশের সহকারী কমিশনার (কোতোয়ালী জোন) মো. মাহফুজুর রহমান চার্জশিট দাখিল করেন। চার্জশিটভুক্ত বাকী ৩৭ জন হলেন, চন্দন দাশ মেথর, রিপন দাশ, রাজীব ভট্টাচার্য্য, শুভ কান্তি দাশ, আমান দাশ, বুঞ্জা, রনব, বিধান, বিকাশ, রমিত প্রকাশ রমিত দাস, রুমিত দাশ, নয়ন দাশ, ওমকার দাশ, বিশাল, লালা দাশ, সামীর, সোহেল দাশ, শিব কুমার, বিগলাল, পরাশ, গণেশ, ওম দাস, পপি, অজয়, দেবী চরণ, দেব, জয়, লালা মেথর, দুর্লভ দাশ, সুমিত দাশ, সনু দাস, সকু দাশ, ভাজন, আশিক, শাহিত, শিবা দাস ও দ্বীপ দাশ। এদের মধ্যে চিন্ময় দাশ, চন্দন দাশ, রিপন দাশ, রাজীব ভট্টাচার্য্য, আমান দাশ, বুঞ্জা, রনব, বিধান, বিকাশ, রমিত, রুমিত, নয়ন, সামীর, শিব কুমার, ওম দাস, অজয়, দেবী চরণ, দুর্লভ, সুমিত দাশ ও সনু দাস ঘটনা পরবর্তী গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। বাকীরা পলাতক।
আদালতসূত্র জানায়, আলিফ হত্যা মামলাটি হয়েছিল ৩১ জনের বিরুদ্ধে। এর মধ্য থেকে গগন দাশ, বিশাল দাশ ও রাজ কাপুর মেথরকে চার্জশিটে রাখা হয়নি। এ তিনজনের বিষয়ে চার্জশিটে বলা হয়েছে, ঘটনার সাথে এ তিনজনের জড়িত থাকার বিষয়ে তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বাকী থাকে ২৮ জন। এ ২৮ জনের সাথে চিন্ময় দাশসহ ১০ জনকে যুক্ত করে মোট ৩৮ জনের বিরুদ্ধে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা উক্ত চার্জশিট দাখিল করেছিলেন। ঘটনার সাথে চিন্ময় দাশসহ এ ১০ জনের জড়িত থাকার বিষয়টি তদন্তেই উঠে আসে। আদালতসূত্র আরো জানায়, মামলার তদন্তকালীন সময়ে সুকান্ত নামের অপর একজনের নাম উঠে। কিন্তু তদন্তে সুকান্তের সঠিক নাম–ঠিকানা পাওয়া যায়নি। এ জন্য চার্জশিটে তাকে না রেখে অব্যাহিত চাওয়া হয়।
চার্জশিটে বলা হয়, নগরীর নিউমার্কেট মোড়ে জাতীয় পতাকা অবমাননার অভিযোগে গত বছরের ৩১ অক্টোবর চিন্ময় দাশের বিরুদ্ধে একটি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হয়। দণ্ডবিধির ১২০(খ)/১২৪(ক)/১৫৩(ক)১০৯/৩৪ ধারায় মামলাটি দায়ের হয়েছিল। এ মামলায় গত বছরের ২৫ নভেম্বর ঢাকা থেকে চিন্ময়কে গ্রেপ্তার করা হয়। পরদিন তথা ২৬ নভেম্বর তাকে চট্টগ্রামের আদালতে হাজির করা হয়। তার পক্ষের আইনজীবীরা তার জামিন চেয়ে সেদিন একটি আবেদন করেন। সেখানে জামিন না–মঞ্জুর হলে তিনি সমর্থকদের উত্তেজিত করেন এবং যে সকল আইনজীবী তার জামিনের বিরোধিতা করেছেন তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি।
প্রিজন ভ্যানের ভেতর থেকে উত্তেজনা মূলক বক্তব্য দিয়েছেন তিনি। এরই ধারাবাহিকতায় ৬০০ থেকে ৭০০ সমর্থক আদালত পাড়ায় নৈরাজ্য সৃষ্টি করেন। ইসকন সদস্যরা তাকে চিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন উল্লেখ করে চার্জশিটে বলা হয়, পুলিশ সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশের উপর আক্রমণ করা হয়। এরপর লাঠি চার্জ করলে ত্রাস সৃষ্টি করে আদালত পাড়া ত্যাগ করার সময় চিন্ময়ের সমর্থকরা আইনজীবী, বিচারপ্রার্থী ও বিচারকের গাড়িসহ ২০ থেকে ২৫ টি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। আদালত পাড়ার মসজিদে আক্রমণ করা হয়। মুসল্লিদের আহত করা হয়। দোকানপাট ভাঙচুর করা হয়। এমনকি সাধারণের উপর হামলা করা হয় বলেও চার্জশিটে বলা হয়।
চার্জশিটে বলা হয়, একপর্যায়ে ইসকন সন্ত্রাসীদের ধাওয়া দিলে ত্রাস সৃষ্টিকারী ও হামলাকারীরা আদালত পাড়ার অদূরের রঙ্গম হলের গলির মুখে চলে যায়। ওই সময় তথা বিকাল সাড়ে ৩ টা কিংবা ৪ টার দিকে আদালতের কার্যক্রম শেষে বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে রঙ্গম হলের গলির মুখে দাঁড়িয়েছিলেন আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ। সেখান থেকে তাকে ৩০ থেকে ৪০ জন ইসকন সন্ত্রাসী অতর্কিতভাবে আলিফকে হত্যার উদ্দেশ্যে টেনে হেঁচড়ে মেথর পট্টির দিকে নিয়ে যায়। তখন আইনজীবীসহ সাধারণরা আলিফকে উদ্ধার করার জন্য সেখানে গিয়ে ধাওয়া দিলে তারা আলিফকে ছেড়ে দিয়ে মেথরপট্টির ভেতরে চলে যায়। এসময় আলিফকে নিয়ে আসার সময় ইসকন সদস্যরা কিরিচ, রামদা, বটি, ক্রিকেট খেলার স্ট্যাম্প, গাছের বাটাম, লাঠি, লোহার রড, ছুরি, পাথর হকস্টিক ও ত্রিশূল দিয়ে আলিফসহ সবাইর উপর আক্রমণ করা হয় এবং আলিফকে পায়ে আঘাত করে ফেলে দেওয়া হয়। আলিফ উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলে আসামি রিপন দাশ তার হাতে থাকা ধারালো বটি দিয়ে ঘাড়ে পরপর দুটি কোপ মারেন। চন্দন দাশ মেথর কিরিচ দিয়ে পেটে ও ঘাড়ে কোপ মারেন। রাজীব ভট্টাচার্য্যও কিরিচ দিয়ে আলিফের শরীরে কোপ মারেন। শিবা, সুমিত, সোহেল, অজয়, ওমকার, রুমিত, দেবী, বিকাশ লাঠ দিয়ে আলিফকে আঘাত করেন। বুঞ্জা বাটাম দিয়ে আলিফকে আঘাত করেন। অন্যান্য আসামিরাও বিভিন্নভাবে আলিফকে আঘাত করেন উল্লেখ করে আরো বলা হয়, এসবের ফলে আলিফের দেহ যখন নিথর হয়ে আসছিল তখন ধারালো অস্ত্রধারী হামলাকারী নারকীয় উল্লাস প্রকাশ করেন।
আদালতসূত্র জানায়, আলিফ হত্যার ঘটনায় মোট সাতটি মামলা দায়ের হয়েছে। এর মধ্যে কোতোয়ালী থানায় ৬টি ও আদালতে একটি মামলা দায়ের হয়। কোতোয়ালী থানায় দায়ের হওয়া মামলাগুলোর মধ্যে পুলিশ বাদী হয়ে ৭৯ জনের নামে তিনটি, আলিফের বাবা জামাল উদ্দিন বাদী হয়ে ৩১ জনের নামে একটি (হত্যা মামলা) ও তার ভাই বাদী হয়ে ১১৬ জনের নামে একটি ও মোহাম্মদ উল্লাহ নামের এক ব্যবসায়ী ২৯ জনের নামে একটি মামলা দায়ের করেন। এছাড়া মো. এনামুল হক নামের একজন বাদী হয়ে ১৬৪ জনের নামে আদালতে আরো একটি মামলা দায়ের করেন।