বছরে বিশ্বজুড়ে প্রায় ১০০ কোটি মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রদান করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এই ১০০ কোটির মধ্যে প্রায় ১৫ কোটি মানুষ স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় মেটাতে গিয়ে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে, দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশে চার কোটি ৮০ লাখ মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে অবস্থান করছে এবং প্রতি বছর অসুস্থতার কারণে নতুন করে ৬৪ লাখ মানুষ দরিদ্রতার শিকার হচ্ছে। সম্প্রতি স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের এক গবেষণায় দেখা যায়, স্বাস্থ্য ব্যয়ভার বহন করতে গিয়ে প্রতি বছর ৮৬ লাখের বেশি মানুষের আর্থিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে। অতিরিক্ত ব্যয়ের কারণে ১৬ শতাংশ মানুষ স্বাস্থ্যসেবা নেন না। এ হিসাবে প্রায় তিন কোটি মানুষ প্রয়োজন হলেও চিকিৎসা নিচ্ছেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের সাবেক এক পরিচালক বলেছেন, প্রকৃত অর্থে প্রতি বছর বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে সরকারি বরাদ্দ হ্রাস পাচ্ছে। করোনা মহামারির কারণে বাজেটে বরাদ্দ কিছুটা বাড়ানো হলেও তা প্রত্যাশিত পর্যায়ের নয়। ব্যক্তির ব্যয় কমাতে হলে স্বাস্থ্য, অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়কে একযোগে কাজ করতে হবে। অন্যথায় প্রত্যাশিত ফল মিলবে না। বস্তুত সংসারে ব্যয়ের একটি অংশ যায় চিকিৎসার পেছনে। আজকাল প্রতিটি পরিবারেই কোনো না কোনো সদস্যের জন্য বা একাধিক সদস্যের জন্য ওষুধপত্র কিনতে হয়। আর প্রতিনিয়ত এ ব্যয় বেড়ে চলেছে। ফলে অন্যান্য খরচের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারকে। এমনকি উচ্চ–মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোও এ নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে।
সম্প্রতি এক গবেষণা রিপোর্টে বলা হয়েছে, সরকারি হাসপাতালে ৩ শতাংশ রোগী ওষুধ পায়। বাকি ৯৭ ভাগ রোগীই ওষুধ পায় না। এসব কারণে রোগীরা বেসরকারি হাসপাতালে ছুটে ও দরিদ্র হয়ে পড়ে। এ সংখ্যা প্রতিবছর প্রায় ৮৬ লাখ। আরও জানা যায়, ২০১২ সালে রোগীর স্বাস্থ্যসেবার খরচ কমিয়ে আনতে ২০ বছর মেয়াদি একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এটি বাস্তবায়ন হবে ২০৩২ সালে। সেখানে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্যসেবায় মানুষের খরচ বর্তমান শতকরা ৬৪ ভাগ থেকে ৩২ ভাগে নামিয়ে আনতে হবে। কারণ একজন প্রাইভেট চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা নেওয়া এবং একাধিক টেস্ট করা সবার পক্ষে সম্ভব হয় না। প্রাইভেট চিকিৎসকের আবার আলাদা আলাদা ফি। রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। আজকাল আবার টেস্ট ছাড়া চিকিৎসা করার রীতি প্রায় উঠে গেছে! তারপর ওষুধের প্রশ্ন। এত বিশাল খরচ সবাই বহন করতে পারে না। চিকিৎসার জন্য দেশে সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি অসংখ্য প্রাইভেট ক্লিনিক গড়ে উঠেছে। এসব ক্লিনিকে চিকিৎসা নিতে আসে অসংখ্য মানুষ। কিন্তু ব্যয়বহুল হওয়ায় দরিদ্র রোগীদের হিমশিম খেতে হয়। ডাক্তার দেখানো থেকে শুরু করে মেডিকেল টেস্ট পর্যন্ত এই ব্যয় বহন করা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয় না। ফলে কখনো অন্যের কাছ থেকে ধার নিয়ে, আবার কখনো পরিবারের সম্পদ বিক্রি করে তারা চিকিৎসা করে। এভাবে চিকিৎসা ব্যয় মানুষের আর্থিক সামর্থ্যকে সীমাবদ্ধ করছে।
চিকিৎসা ব্যয় কেন বাড়ছে তার কয়েকটি প্রধান কারণ হলো সরকারি হাসপাতালের সীমিত সুযোগ–সুবিধা। বিশেষজ্ঞরা বলেন, সরকারি হাসপাতালে সেবা থাকলেও পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি, ডাক্তার, নার্স ও বেডের সংকট থাকে। এতে রোগীরা বাধ্য হয়ে বেসরকারি হাসপাতালে যায়, যেখানে খরচ কয়েকগুণ বেশি। অনেক ওষুধ দেশীয়ভাবে উৎপাদিত হলেও, বিশেষ করে ক্যানসার, হার্ট ও কিডনির ওষুধগুলো বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এতে দাম বেড়ে যায়। তা ছাড়া অনেক ফার্মেসি অতিরিক্ত দামে ওষুধ বিক্রি করে। বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের খরচে প্রতিদিনই নতুন নতুন টেস্টের নাম যুক্ত হচ্ছে। রোগ নির্ণয়ে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহৃত হলেও এর ব্যয় বহন করা সাধারণ মানুষের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। অনেক ডাক্তার ও হাসপাতাল কমিশনভিত্তিক চিকিৎসা বা টেস্টে পাঠান, যার ফলে খরচ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। চিকিৎসা ব্যয় সহজসাধ্য করতে হলে কয়েকটি বিষয় গুরুত্ব দিয়ে বাস্তবায়ন করতে হবে। তাদের মধ্যে রয়েছে, সরকারি স্বাস্থ্যসেবায় বিনিয়োগ বাড়ানো, ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণ, ডায়াগনস্টিক টেস্টে নীতিমালা, স্বাস্থ্য বীমার প্রসার, প্রতিরোধমূলক চিকিৎসার ওপর জোর দেয়া, কমিশন ব্যবসা বন্ধ, টেলিমেডিসিন সেবা শুরু করা প্রভৃতি।
স্বাস্থ্যসেবাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে পরিকল্পনা নিতে হবে। কোনো মানুষ যেন অর্থের অভাবে চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত না হয়, সেটি রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব। আমরা যদি ওষুধ ও টেস্টের দাম নিয়ন্ত্রণ করি, তাহলে চিকিৎসা ব্যয় সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে থাকবে।