৩০ বার চিঠি লিখেও সচল হয়নি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের রেডিওলজি বিভাগের একমাত্র এমআরআই মেশিনটি। বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগের। চিকিৎসাসেবায় এতো অবহেলা কাম্য হতে পারে না। গত ৩০ জুলাই দৈনিক আজাদীতে এ বিষয়ে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের রেডিওলজি বিভাগের একমাত্র এমআরআই মেশিনটি গত দুই বছরেরও বেশি সময় নষ্ট পড়ে আছে। মেশিনটি মেরামতে চমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এই সময়ের মধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, কেন্দ্রীয় ঔষধাগার (সিএমএসডি), ন্যাশনাল ইলেকট্রো মেডিক্যাল ইক্যুইপমেন্ট মেইনটেন্যান্স ওয়ার্কশপ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার (নিমিইউ অ্যান্ড টিসি) এবং মেশিনটির সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মেডিটেল প্রাইভেট লিমিটেডকে ৩০ বার চিঠি লিখে।
গত দু্ই বছর ধরে কেবল চিঠির সংখ্যা বাড়লেও মেশিনটি সচল করা যায়নি। তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, এমআরআই মেশিনটি ওয়ারেন্টি পিরিয়ড শেষ হয়ে যায় গত ২০২১ সালের জুনে। এরপর থেকে মেশিন রক্ষণাবেক্ষণ চুক্তি (সিএমসি) নিয়ে সরবরাহ প্রতিষ্ঠানের সাথে টাকার অংক নিয়ে মতপার্থক্য তৈরি হয়। তবে সমপ্রতি নিমিইউ অ্যান্ড টিসি’তে একটি বৈঠকে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান এমআরআই মেশিনটির মেরামত এবং ৩ বছরের সিএমসির জন্য প্রায় সাড়ে ৭ কোটি টাকার প্রস্তাব দাখিল করে। বিষয়টি নিয়ে এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।
সংবাদে উল্লেখ করা হয় যে, হাসপাতালের একমাত্র এমআরআই মেশিনটি দীর্ঘ সময় ধরে নষ্ট পড়ে থাকায় দরিদ্র রোগীরা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অনেক রোগী উপায় না দেখে ধার–দেনা করে বেসরকারি বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে এমআরআই পরীক্ষা করছেন। চমেক হাসপাতালে এমআরআই পরীক্ষা–নিরীক্ষায় ক্ষেত্র বিশেষে তিন হাজার ও চার হাজার টাকা ফি দিতে হলে বাইরের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে খরচ পড়ছে ৮ থেকে ১৫ হাজার টাকা। চিকিৎসকরা বলছেন, মস্তিস্কের বিভিন্ন স্নায়ু, টিউমার, স্ট্রোকসহ শরীরের বিভিন্ন অংশের সঠিক রোগ নির্ণয়ের জন্য এমআরআইয়ের প্রয়োজন পড়ে। হাসপাতালে এমআরআই মেশিন সচল থাকলে দ্রুত সময়ের মধ্যে রোগ নির্ণয় করে রোগীদের দ্রুত সেবা দেয়া সম্ভব হতো। তবে এখন আমাদের রোগীরা সেই সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক, ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. প্রাণগোপাল দত্ত বলেছেন, চিকিৎসাসেবা পাওয়া জনগণের একটি মৌলিক অধিকার। তাই পথঘাটের ছিন্নমূল মানুষ থেকে শুরু করে শত কোটি টাকার মালিক–সবার জন্যই যথাযথ চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে হবে। যাদের আয় সীমিত, নিম্ন মধ্যবিত্ত বা যারা দিন এনে দিন খায়, তাদের একজনও যেন বিনা চিকিৎসায় ধুকে ধুকে এ সুন্দর পৃথিবী থেকে বিদায় না নেয়, তা নিশ্চিত করার দায় আমাদেরই। এ বিষয়টা উপলব্ধি করে তা নিশ্চিত করা খুব জরুরি। শুধু সরকার অথবা ডাক্তার নয়, প্রাইভেট হাসপাতাল এবং ক্লিনিকের মালিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি, ফার্মেসি, চিকিৎসা সহকারী, নার্স, থেরাপিস্ট সকলের সমন্বিত চেষ্টার মাধ্যমেই চিকিৎসা সেবাকে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া সম্ভব।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেশের সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোয় গত কয়েক দশকে অবকাঠামোগত আধুনিকায়ন হলেও রোগীদের আস্থা বাড়েনি। ভুল রোগ নিরীক্ষা, বিশেষায়িত চিকিৎসা না পাওয়া, প্রতারিত হওয়ার পাশাপাশি চিকিৎসা অবহেলার অভিযোগও দীর্ঘদিনের। অথচ বছরে স্বাস্থ্যসেবার পেছনে যে খরচ হচ্ছে তার ২৪ শতাংশই হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিতে গিয়ে ব্যয় করছে রোগীরা। দেশে চিকিৎসা ব্যয় আগের চেয়ে অনেক বৃদ্ধি পেলেও রক্ষা হচ্ছে না রোগীর অধিকার। যেভাবেই হোক চিকিৎসা–ব্যয়ও কমাতে হবে। তাঁরা বলেন, শতভাগ সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃৃপক্ষের উচিত দেশের প্রতিটি হাসপাতালে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা, চিকিৎসকদের সব সুবিধা নিশ্চিত করে রোগীদের যথাযথ সেবা প্রদানের ব্যবস্থা করা।
চিকিৎসকরা বলেন, বৃহত্তর চট্টগ্রামের প্রায় ৪ কোটি মানুষের একমাত্র ভরসাস্থল এই হাসপাতাল। দীর্ঘ সময় হাসপাতালের একমাত্র এমআরআই মেশিনটি নষ্ট থাকার কারণে গরীব রোগীরা কম খরচের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এ বিষয়ে চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ তসলিম উদ্দিন দৈনিক আজাদীকে বলেন, এমআরআই মেশিন সচল করার বিষয়ে মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের ৩০ বার চিঠি লেখা হয়েছে। আমাদের অবস্থান থেকে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কারণ মেশিনটি চালু হলে গরীব রোগীরা কম খরচে সেবা পাবেন। এতোবার চিঠি লেখা হলেও মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি নিবদ্ধ না হওয়ার কারণ বোঝা গেলো না। এ অবহেলা কখনো কাম্য নয়।