চট্টগ্রামে প্রাপ্ত বয়স্ক (২৬ থেকে ৬০ বছর), শিক্ষিত এবং শহরের লোকজন বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন মশাবাহিত রোগ চিকুনগুনিয়ায়। নগরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কোতোয়ালী থানা এবং উপজেলার মধ্যে সীতাকুণ্ডের বাসিন্দা বেশি আক্রান্ত হয়েছেন। বিপরীতে ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী জনগোষ্ঠী। একইসঙ্গে শহরাঞ্চলের মানুষ গ্রামাঞ্চলের তুলনায় অধিক ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে রয়েছে। তবে ডেঙ্গু ও জিকার সাথে চিকুনগুনিয়ার একসাথে সংক্রমণ পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলছে।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) ও এসপেরিয়া হেলথ রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (এআরএফ)- এর যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে আসে। ‘চট্টগ্রামে ডেঙ্গু, জিকা ও চিকুনগুনিয়া সংক্রমণের সার্বিক পরিস্থিতি, জনস্বাস্থ্যে প্রভাব, চিকিৎসা পদ্ধতি এবং ভাইরাসের জিনোমের স্বরূপ উন্মোচন’ শীর্ষক গবেষণাটি পরিচালিত হয় চলতি বছরের ১ মে থেকে ১৫ ডিসেম্বর। নগর ও আশেপাশের উপজেলার ১ হাজার ১০৯ জন চিকুনগুনিয়া রোগী ও ১ হাজার ৭০৯ জন ডেঙ্গু রোগীর ক্লিনিক্যাল, জনস্বাস্থ্য, রোগতত্ত্ব ও জেনেটিক তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে গবেষণায়। গতকাল রোববার দুপুরে নগরের থিয়েটার ইনস্টিটিউটে গবেষণার সার সংক্ষেপ উপস্থাপন করেন সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হেসেন। গবেষণায় নেতৃত্ব প্রদান করেন চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক ডা. এইচ এম হামিদুল্লাহ মেহেদী, রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. আবুল ফয়সাল মোহাম্মদ নুরুদ্দিন এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. আদনান মান্নান।
চিকুনগুনিয়া পরিস্থিতি : গবেষকরা জানিয়েছেন, বর্তমানে চট্টগ্রাম অঞ্চলে চিকুনগুনিয়া দ্রুত বিস্তারমান একটি মশাবাহিত ভাইরাসজনিত রোগ হিসেবে গুরুতর জনস্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জে রূপ নিয়েছে। এই রোগ কেবল স্বল্পমেয়াদি জ্বরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং দীর্ঘস্থায়ী অস্থিসন্ধির ব্যথা, কর্মক্ষমতা হ্রাস এবং উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হয়ে উঠছে। তারা বলছেন, চিকুনগুনিয়া এখন আর কেবল একটি সাময়িক জ্বরের রোগ নয়; এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি জনস্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক সংকটে পরিণত হয়েছে। শুধুমাত্র ডেঙ্গুকেন্দ্রিক নিয়ন্ত্রণ কৌশল দিয়ে এই রোগ মোকাবিলা সম্ভব নয়।
চিকুনগুনিয়া নিয়ন্ত্রণ ও ভবিষ্যৎ প্রস্তুতি নিয়ে স্বল্পমেয়াদী (০–১২ মাস), মধ্যমেয়াদী (১–৩ বছর) এবং দীর্ঘমেয়াদী (৩–১০ বছর) বিভিন্ন সুপারিশ করা হয় গবেষণায়।
গবেষক এইচ এম হামিদুল্লাহ মেহেদী বলেন, শুধু ডেঙ্গুকেন্দ্রিক নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা দিয়ে এই সংকট মোকাবিলা সম্ভব নয়। চিকুনগুনিয়াকে সমান গুরুত্ব দিয়ে নজরদারি, সঠিক রোগনির্ণয়, জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং সমন্বিত মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম জোরদার না করলে চট্টগ্রামের জনস্বাস্থ্য ও অর্থনীতির ওপর এই রোগগুলোর চাপ আগামী দিনে আরও বাড়বে।
এদিকে গবেষণায় দেখা গেছে, চিকুনগুনিয়ায় মোট আক্রান্তের ৮০ শতাংশ শহরের বাসিন্দা। গ্রামের লোক আক্রান্ত হয়েছেন মাত্র ২০ শতাংশ। এছাড়া নিরক্ষর লোকজনের চেয়ে শিক্ষিতদের আক্রান্তের হার বেশি দেখা গেছে। নিরক্ষর লোকের আক্রান্ত হওয়ার হার ১০ শতাংশের নিচে।
এছাড়া চিকুনগুনিয়ায় বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন প্রাপ্ত বয়স্করা। যা মোট আক্রান্তের প্রায় ৭০ শতাংশ। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ ২৬ থেকে ৪০ বছর বয়সী ও প্রায় ৪০ শতাংশ হচ্ছেন ৪১ থেকে ৬০ বছর বয়সী। আবার গ্রামের চেয়ে শহরের লোকজন বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন চিকুনগুনিয়ায়।
গবেষণার তথ্য অনুযায়ি, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এলাকার মধ্যে কোতোয়ালী, বাকলিয়া, ডবলমুরিং, আগ্রাবাদ, চকবাজার, হালিশহর ও পাঁচলাইশ এলাকায় সংক্রমণের হার ছিল তুলনামূলকভাবে বেশি। উপজেলা পর্যায়ে সীতাকুণ্ড, বোয়ালখালী ও আনোয়ারা এলাকায় সংক্রমণ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় পরিলক্ষিত হয়।
তিন মাসের বেশি স্থায়ী ব্যথা : চিকুনগুনিয়া রোগীদের গোড়ালি, হাঁটু, কব্জি ও হাতের অস্থিসন্ধি সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়। বহু রোগীর ক্ষেত্রে সকালে অস্থিসন্ধি শক্ত হয়ে যাওয়া ও ফোলা ভাবের লক্ষণ স্পষ্টভাবে পাওয়া গেছে।
চিকুনগুনিয়ার অধিকাংশ রোগীর ক্ষেত্রে তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী অস্থিসন্ধির ব্যথা তিন মাসের বেশি সময় ধরে স্থায়ী হয়েছে, যার হার প্রায় ৬০ শতাংশ। ভুল রোগ নির্ণয় ও পর্যাপ্ত রিপোর্টিংয়ের অভাবে প্রকৃত রোগভার অনেকাংশেই অজানা থেকে যাচ্ছে বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়। পাশাপাশি জনসচেতনতার অভাব এবং গড়ে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত চিকিৎসা ব্যয়ের চাপ রোগ ব্যবস্থাপনাকে আরও জটিল করে তুলছে। অসুস্থতার কারণে আক্রান্ত ব্যক্তিরা ৭ থেকে ৮ দিন কাজে যেতে পারেননি। চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে প্রায় ৭ দশমিক ৯ শতাংশ রোগীকে ঋণ নিতে হয়েছে।
গবেষণায় জিনগত বিশ্লেষণের মাধ্যমে ভাইরাসের উল্লেখযোগ্য জিনগত বৈচিত্র্য শনাক্ত করা হয়েছে, যেখানে দেখা যায় এই ভেরিয়েন্ট পূর্বে পাকিস্তান, ভারত ও থাইল্যান্ডে শনাক্ত হওয়া ভেরিয়েন্টের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ হলেও চট্টগ্রামে প্রাপ্ত ভাইরাসে অর্ধশতাধিক জিনগত পরিবর্তন বা মিউটেশন বিদ্যমান রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আরও গভীর গবেষণা চলমান রয়েছে।
ডেঙ্গু পরিস্থিতি :
গবেষণায় দেখা গেছে, ৬০ শতাংশ ডেঙ্গু রোগী শহরের বাসিন্দা। অর্থাৎ শহরাঞ্চলের মানুষ গ্রামাঞ্চলের তুলনায় অধিক ঝুঁকিতে রয়েছে। এছাড়া ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী তরুণ জনগোষ্ঠী ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে এবং পুরুষ রোগীর সংখ্যা নারীদের তুলনায় বেশি।
ডেঙ্গু রোগীদের সহ–রোগ বিশ্লেষণে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের উপস্থিতি তুলনামূলকভাবে বেশি পাওয়া গেছে। কিছু রোগীর ক্ষেত্রে রক্তক্ষরণ ও শরীরে তরল জমে যাওয়ার মতো জটিলতাও শনাক্ত করা হয়েছে। সামগ্রিক চিত্রে গবেষকরা বলছেন, চট্টগ্রামে ডেঙ্গু সংক্রমণ প্রধানত তরুণ, শহরাঞ্চলের পুরুষ জনগোষ্ঠীর মধ্যে বেশি দেখা যাচ্ছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে রোগটি নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে থাকলেও সতর্কতা অত্যন্ত জরুরি।
গবেষকরা বলছেন, প্রায় অর্ধেক রোগী সতর্কতামূলক লক্ষণসহ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ছিলেন এবং উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোগী গুরুতর ডেঙ্গুতে ভুগেছেন। উপসর্গ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রায় সব রোগীরই জ্বর ছিল। পাশাপাশি বমিভাব, মাথাব্যথা, মাংসপেশির ব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা, পেটব্যথা ও ডায়রিয়ার মতো উপসর্গ উচ্চ হারে উপস্থিত ছিল।












