চা শ্রমিকদের মানবেতর জীবন

তরুণ কান্তি বড়ুয়া | মঙ্গলবার , ১১ জুলাই, ২০২৩ at ৬:৪৮ পূর্বাহ্ণ

শ্রমিকদের জীবনযাত্রার দৈন্যদশা দক্ষিণ এশিয়ার বহুদেশে বিশেষ করে ভারতবাংলাদেশে খুবই নাজুক অবস্থানে রয়েছে। প্রেক্ষাপট বিচারে বাংলাদেশে বিভিন্ন শিল্পকারখানা, ইট ভাটা, কৃষিক্ষেত্র এবং অন্যান্য উৎপাদনশীল ক্ষেত্রে শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান নিরুপনে মজুরি ব্যবস্থা অভিন্ন এক গ্রহণযোগ্য নীতিমালার ভিত্তিতে নির্ধারণের কথা থাকলেও বস্তুতপক্ষে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ভিন্ন ভিন্ন নীতিমালার নিরিখে মজুরি ব্যবস্থা ও অন্যান্য সুবিধাদি বিবেচনা করা হয়ে থাকে। চা শ্রমিকদের ক্ষত্রে এসব নীতিমালা ব্যতিক্রম কিছু নয়। ফলে এসব ক্ষেত্রে শ্রমিকরা বৈষম্যমূলক নীতিমালা এবং অনেক ক্ষেত্রে নির্যাতন নিপীড়নের শিকারে পরিনত হয়। উৎপাদনশীল অনেক ক্ষেত্রে মালিকপক্ষ কাজ বেশি মজুরি কম নীতির ভিত্তিতে শ্রমিকদের অবস্থান, জীবন প্রণালী নিয়ন্ত্রণ করে আসছে।

চা শ্রমিকরা বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসন পরবর্তীতেও চা শিল্পের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি এবং মালিক পক্ষের সন্তুষ্টি নিশ্চিত করেও বংশপরম্পরায় নিজেরা খুবই মানবেতর জীবনযাপন করে আসছে। অবিভক্ত পাক ভারত উপমহাদেশে বৃটিশ শাসনামলে ১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে বৃটিশরা বর্তমান ভারতের বিহার, মাদ্রাজ, উত্তর প্রদেশ, ওড়িশা ও ঝাড়খণ্ড সহ অন্যান্য অঞ্চল থেকে বিভিন্ন গোত্র ও বর্ণের আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে চা শ্রমিক হিসেবে ভারতের চা সমৃদ্ধ অঞ্চল সহ আমাদের বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেট ও চট্টগ্রামে নিয়ে আসে। অনেক রঙিন স্বপ্নের প্রলোভন দেখিয়ে তাদের আনা হলেও রুটি ভাত খেয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে সাধারণভাবে বেঁচে থাকাটাই তাদের সামনে ছিল প্রধান লক্ষ্য। যে স্বপ্ন মাথায় নিয়ে এসব শ্রমিকদের পূর্ব পুরুষরা তাদের পৈর্তৃক ভিটেমাটি ছেড়ে এদেশে আসে তাদের বংশধরদের করুণ অবস্থার সামান্যতম পরিবর্তন ঘটেনি বরং তাদের অবস্থা যে তিমিরে ছিল সে তিমিরেই পড়ে আছে। বৃটিশ কোম্পানি বৃটিশ প্রশাসকরা চলে যায়, পশ্চিমারা আসে পশ্চিমারা চলে গেছে, এখন অনেক ক্ষেত্রে বাঙালিরা মালিকপরিচালক। অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতার হাত বদল দৃশ্যনীয় হলেও জীবন মান, শ্রমিকদের মজুরি ও অন্যান্য সুবিধা বৃদ্ধির মাধ্যমে শ্রমিকদের আর্থ সামাজিক অবস্থার তেমন পরিবর্তন হয়নি। পাতা প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বাজারজাতকরণের মাধ্যমে দেশ বিদেশের অভিজাত হোটেল রেস্টুরেন্ট, পারিবারিক আসর থেকে শুরু করে অজপাড়াগাঁ এর আড্ডার টেবিলে চা পরিবেশন করা হয় আধুনিকতা ও আভিজাত্যের নমুনা হিসেবে। অথচ যাদের শ্রম ও নিরবচ্ছিন্ন কাজের ফলস্বরূপ চা মানসম্মত পানীয় হয়ে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে মিশে আছে তাদের জীবন মান কিভাবে পরিচালিত হয় তার খবর আমরা ক’জনই রাখছি। অনেক ক্ষেত্রে দিনের পর দিন মালিকদের অগ্রহণযোগ্য ও সাজানো যৎসামান্য বেতন কাঠামোর উপর ভিত্তি করে তাদের জীবন নির্বাহের নীতি নির্ধারণ করা হয়। এককথায় চা শ্রমিকদের জিম্মি করে মালিকরা ব্যবসা পরিচালনা করেন নিজেদের ভাগ্যোন্নয়নের চাবিকাঠি হিসেবে, যেখানে থাকে না শ্রমিকদের আর্থ সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন নিশ্চয়তার সামান্যতম আশ্বাস।

চা শ্রমিকরা আসলে যে অবর্ণনীয় দুঃখ কষ্টে জীবন যাপন করে আসছে তা সাধারণ জনগণের ধারণাতীত। তারা অস্বাস্থ্যকর, রুগ্ন পরিবেশে জন্মগ্রহণ করে এবং বেড়ে ওঠে, বছরের পর বছর একই পরিবেশে থেকে জীবন জীবিকার সংগ্রামে ব্যস্ত থাকে। সুস্থ পরিবেশের কথা ভাবা তাদের জন্য দুঃস্বপ্নের মতো। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে রাজা, বাদশাহ এবং রাষ্ট্রনায়করা বিদেশ থেকে এনে কিংবা সমাজের পিছিয়ে পড়া লোকদের দাস হিসেবে ব্যবহার করতেন, তাদের উপর নির্যাতন নিপীড়ন চালিয়ে যেতেন। ঠিক একই রীতিতে মালিক বা কর্তা ব্যক্তিরা চা শ্রমিকদের সাথে অনুরূপ আচরণ করতেন। ‘ভাগ কর শাসন কর’ নীতি সম্পর্কে শ্রমিকরা সচেতন ছিল বলে সুস্পষ্ট করে বলা যায় না। তবে পরিবেশগত কিছু কারণে আর্ত সামাজিক অসচ্ছলতার শিকার হয়ে এসব শ্রমিকরা মানসিক সাহস হারিয়ে প্রতিবাদ করার কোনো ভাষা জানত না। অনিয়ম, বৈষম্যমূলক নিয়ম নীতির চাপে অধিকাংশ চা শ্রমিকরা তাদের নিজেদের জগতের বাইরে যে অন্য কোনো জগত আছে সে সম্পর্কে তারা ধারণা রাখে না। তারা মনে করে দীর্ঘদিন থেকে যে জীবন প্রবাহের সাথে পরিচিত সেই বাপদাদার পেশাই তাদের পেশা, কর্ম এবং জীবন যৌবনের শেষ ঠিকানা। তারা তো জানে, যেহেতু চা বাগানেই তাদের জন্ম, এসব চা বাগানেই তাদের মৃত্যু। অবর্ণনীয় দমননীতি সহ্য করতে না পেরে বাংলাদেশের চা শ্রমিকরা একসময় প্রতিবাদী হয়ে উঠে। ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে সিলেট অঞ্চলের হাজার হাজার শ্রমিক আন্দোলনে নেমে পড়েছিল। তাদের স্লোগান ছিল ‘চল মুল্লুকে চল’। সে বছরে ২০ মে নিজ মাতৃভূমিতে ফিরে যাওয়ার লক্ষ্যে সিলেটের প্রায় ৩০ হাজার চা শ্রমিক সিলেট রেল স্টেশন থেকে পদব্রজে চাঁদপুর মেঘনা স্টিমারঘাটে পৌঁছে। ঘাটে পৌঁছামাত্র বৃটিশ শাসকদের সিপাহীরা গুলি চালালে কয়েকশো চা শ্রমিক নিহত হয়। এরপর থেকেই এ দিবসটিকে চা শ্রমিক দিবস হিসেবে পালন করে আসছে চা শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত শ্রমিকরা।

আমার শহীদ পিতার চাকরির সুবাদে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী চা বাগান এবং বর্তমান মৌলভীবাজার জেলার মির্জাপুর চা বাগানে থাকায় দীর্ঘসময় চা শ্রমিকদের জীবন যাপন পদ্ধতি খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল। শ্রমিক সর্দারদের ডাকে কাক ডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠে শ্রমিকদের নিজ নিজ কাজে ছুটতে দেখেছি। দুপুর গড়িয়ে সূর্য পশ্চিম দিকে ঢলে পড়লে শ্রমিকরা কাজ থেকে ফিরে গৃহস্থালি নিত্যদিনের কাজ সেরে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। ভাত রুটি, সামান্য লাল চা পান ছাড়া কোনো উন্নত খাবার বা জীবন নিয়ে ভাবার সময় তারা খুঁজে পায় না। সকালে ঘুম থেকে উঠে আবার চিরাচরিত নিয়মে বাগানের কাজে ছুটতে হবে এই বোধটুকু মাথায় রেখে তারা রাতে ঘুমাতে যায়।

কাজ করলে মজুরি মিলবে এ নিয়ম নীতির নিরিখে চা শ্রমিকদের জীবনকাল অতিবাহিত হয়। শারীরিক কোনো সমস্যা হলেও কাজের বাধ্যবাধকতার কারণে তাদের কাজে অনুপস্থিত থাকার কোনো সুযোগ নেই। ইচ্ছাকৃতভাবে কাজে অনুপস্থিত থাকলে মজুরি পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়। নৈতিকতা ও মানবিকতার দিক থেকে এখনো পর্যন্ত তাদের যৌক্তিক নিয়মে ছুটি ভোগের কোনো ব্যবস্থা হয়নি। তাছাড়া দুর্মূল্যের বাজারদর ও অন্যান্য বিষয় চিন্তা ভাবনা করে সবক্ষেত্রেই শ্রমের মূল্য ও শ্রমিকদের মজুরি যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে সেক্ষেত্রে চা শ্রমিকদের শ্রমের মূল্য ও মজুরি খুবই অপ্রতুল, নগণ্য বললেও অত্যুক্তি হবে না। অন্যান্য ক্ষেত্রে শ্রমিকদের মজুরি যেখানে দৈনিক চার থেকে পাঁচশত টাকা কিংবা তারও উপর সেক্ষেত্রে চা শ্রমিকদের জন্য প্রদেয় মান্ধাতার আমল থেকে চলে আসা দৈনিক মজুরির হার খুবই ন্যাক্কারজনক ও অমানবিক। কাজেই ন্যায্যতার ভিত্তিতেই চা শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণ ও বাস্তবায়নের বিষয়টি খুবই প্রাসঙ্গিক ও যুগোপযোগী। চা শ্রমিকদের জীবন মান উন্নত করে তাদের বেঁচে থাকার প্রয়াসকে ঢেলে সাজাতে হলে এ ধরনের অমানবিক ও অবহেলিত নিয়মের পরিবর্তন করা খুবই জরুরি। চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১২০/১৩০ টাকা বর্তমান অর্থনৈতিক দুর্মূল্যের বাজারের সাথে সঙ্গতি রাখতে নিতান্তই দু:সাধ্যকর ব্যাপার। অপরদিকে বাগান মালিকদের অভিমত হলো যেহেতু শ্রমিকরা মালিকদের জায়গায় বসবাস করে, তাদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা আছে, চা শ্রমিকদের সন্তানদের পড়ালেখার জন্য স্কুলের ব্যবস্থা আছে, সেক্ষেত্রে শ্রমিকদের বর্তমান মজুরি যথার্থ বলা চলে। বাস্তবে দেখা যায় অনেক বাগানে চিকিৎসা ব্যবস্থা খুবই শোচনীয় পর্যায়ে। জটিল রোগের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ঔষধ পত্র অপ্রতুল। স্কুলও আছে নামমাত্র। অনেক ক্ষেত্রে একজন মাত্র শিক্ষক দিয়ে সব বিষয় পড়ানো হয়। হাসপাতালগুলোতে ভালো চিকিৎসক না থাকার কারণে জরুরি প্রয়োজনে শ্রমিকদের উন্নত চিকিৎসা দেওয়া দুরূহ হয়ে উঠে। কিছু সুনির্দিষ্ট রোগের ঔষধ ছাড়া হাসপাতালগুলোতে ভালো কোনো ঔষধ থাকে না। এসব কারণে সেখানে মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর হার অনেক বেশি। গর্ভাবস্থায় কিংবা শিশু জন্মের সময় অনেক নারী মৃত্যু বরণ করে থাকে।

প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে শ্রমিকদেরকে উন্মুক্ত আকাশ তলে বা ঝোপঝাড়ে আশ্রয় নিতে হয়। এসব কারণেই চা বাগান এলাকায় পানি বাহিত ও বায়ু বাহিত রোগের মারাত্মক প্রাদুর্ভাব ঘটে। অর্থাৎ মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যে ন্যুনতম বস্তুর প্রয়োজন অধিকাংশ চা বাগানে এসবের সরবরাহ নেই বললেই চলে। নামমাত্র রেশন ব্যবস্থা চালু থাকলেও বাস্তবে এ ব্যবস্থা উল্লেখ করার মতো কোনো বিষয় নয়।

দাসপ্রভু প্রথার ধারণা বাতিল করে শ্রমিকদের আর্ত সামাজিক ও মানবিক উন্নয়নে অগ্রগামী করাতে মালিক কর্তৃপক্ষকে উদার মনোভাবাপন্ন হতে হবে বিবেকবোধ, সৌজন্যবোধ ও মানবতাবোধের প্রসার ঘটানোর লক্ষ্যে। অস্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা, অপুষ্টির শিকারে পরিণত অধিকাংশ শ্রমিক দীর্ঘসময় রোগাক্রান্ত থেকে শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। তখন তারা মালিক কিংবা তাদের কর্মকর্তাদের কাছে নতজানু মনোভাব নিয়ে কঠিন দুরবস্থার মধ্য দিয়ে দিনযাপন করে। চা শ্রমিকদের প্রতি যেকোনো নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হওয়া দরকার। তাদের জন্য সুষ্ঠু সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে যাতে সপ্তাহব্যাপী দুবেলা দুমুঠো খেয়ে স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে পারে এবং তাদের সন্তান সন্ততিরা সমাজের অন্যদের মতো শিক্ষার আলো লাভ করে সুস্থ সুন্দর স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনে অভ্যস্ত হতে পারে। মনস্তাত্ত্বিক বিকাশ ও মনের প্রশান্তি আনয়নে শিশুদের জন্য খেলাধুলার মাঠ ও বিনোদন কেন্দ্র স্থাপন করা খুবই প্রয়োজন। চা শ্রমিকদের সন্তানরা যেন কোন ধরনের হীনম্মন্যতায় না ভুগে যাতে তারা ভাবতে পারে তাদের মতো মানুষ নামের প্রাণীগুলো আলোকিত বিশ্বের বাইরে অন্য কোনো জগতের বাসিন্দা। মানবতার স্বার্থে, মনুষ্যত্ব বোধ জাগ্রত করার লক্ষ্যে এ ধরনের অমানবিক পরিস্থিতি থেকে চা শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন করার এখন উপযুক্ত সময়।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও প্রাক্তন অধ্যক্ষ, রাঙ্গুনিয়া সরকারি কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদ্রোহের খাম
পরবর্তী নিবন্ধভূগোলের গোল