নতুন মাদক আইস বা ক্রিস্টাল মেথের অবাধ প্রবেশ দুশ্চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কপালে। এমডিএমএ, আইস ডিমেথ, মেথান ফিটামিন বা ক্রিস্টাল মেথ নামে পরিচিত অত্যন্ত দামি এই মাদক বাজারে ছড়িয়ে পড়ছে নিঃশব্দে। ‘সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম স্টিমুলেটিং ড্রাগস’ নামে পরিচিতি এই মাদক ইয়াবার চেয়ে শত গুণ ক্ষতিকারক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। অধিক দামে ক্রয় করে এই মাদক সেবনের ফলে ধ্বংস হচ্ছে অভিজাত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্যমতে, অল্প বিনিয়োগে অধিক লাভের লোভে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা এখন আইস পাচারে ঝুঁকছে। প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিতে দফায় দফায় হাত বদল হতে থাকে মাদকের চালান। আইসের চালান রাজধানী পর্যন্ত পৌঁছাতে চট্টগ্রাম পার হওয়ার আগেই বদল হয় পাঁচ হাত। গত দশ দিনের ব্যবধানে র্যাব ও বিজিবির হাতে প্রায় ১৮০ কোটি টাকা মূল্যের দুটি আইসের চালান ধরা পড়েছে।
সর্বশেষ গত ৬ মে র্যাবের হাতে উখিয়ায় ২৪ কেজি ২০০ গ্রাম ওজনের আইসের একটি চালান ধরা পড়েছে। এ সময় গ্রেপ্তার করা হয় ৪ মাদক চোরাকারবারিকে। এদের মধ্যে রয়েছেন পুলিশের সাবেক এক সদস্যও।
র্যাব সদর দপ্তরের পরিচালক (আইন ও গণমাধ্যম) কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানিয়েছেন, আইসের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ার পর মাদক ব্যবসায়ীরা এখন ইয়াবার ব্যবসা ছেড়ে আইস পাচারে জড়িত হয়ে পড়ছে। তেমনই একজন গ্রেপ্তারকৃত ইরান মাঝি। তার নেতৃত্বে মাদক সিন্ডিকেটের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ইরান মাঝির নেতৃত্বে চক্রটির বেশ কয়েকজন সদস্য মিয়ানমার থেকে দুর্গম সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে মাদক এনে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করে আসছে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তাদের নির্ধারিত এজেন্ট রয়েছে। প্রথমে ইরান মাঝির নেতৃত্বে চক্রের সদস্যরা মিয়ানমারের মাদক চক্রের কাছ থেকে মাদক নেয়। এসব মাদক অবৈধ পথে ঘুমধুম সীমান্ত হয়ে সীমান্তবর্তী এলাকার গোপন স্থানে জমা করে। সেখান থেকে এসব মাদক রোহিঙ্গা ক্যাম্পসহ দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে লুকিয়ে রাখে। পর্যায়ক্রমে তারা বিভিন্ন উপায়ে ঢাকাসহ চাহিদা অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠায়। ইরান মাঝিসহ অন্যরা আগে ইয়াবা নিয়ে আসত। রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে আইসের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় দুই বছর ধরে তারা মিয়ানমার থেকে আইস নিয়ে আসা শুরু করে।
এর দশ দিন আগে ২৬ এপ্রিল উখিয়া সীমান্তে অভিযান চালিয়ে ২১ কেজি ৯০ গ্রাম আইসসহ তিনজনকে আটক করে বিজিবি। বিজিবির কঙবাজার ৩৪ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, উদ্ধার হওয়া ক্রিস্টাল মেথের দাম ৬৩ কোটি টাকা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নব্বই দশকের শেষ দিকে দেশে মাদক হিসেবে ইয়াবা সেবন চললেও ২০০২ সালের দিকে তা ধরা পড়ে। শুরুর দিকে এ নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না প্রশাসনের। সেই ইয়াবা এখন মাথাব্যথার বড় কারণ। ২০১৯ সালের শুরুর দিকে দেশে ভয়ংকর মাদক আইস অস্তিত্ব মিললেও তা বন্ধ করা যাচ্ছে না।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্যমতে, ২০১৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ঢাকার মোহাম্মদপুর থেকে ৮ গ্রাম আইসসহ তিনজনকে আটক করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। এরপর ওই বছরের ২৭ জুন ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে ক্রিস্টাল মেথসহ নাইজেরীয় একজন নাগরিককে আটক করা হয়। তার কাছে ৫২২ গ্রাম এ ধরনের মাদক পাওয়া যায়।
নতুন মাদক আইস ছড়িয়ে পড়লে ইয়াবার মতো এর আগ্রাসনও থামানো কষ্টকর হবে। লেগে না থাকলে ইয়াবার চেয়েও মহামারী আকার ধারণ করবে আইস–এই অভিমত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের। তারা বলেন, অনলাইনে মাদক ব্যবসা জমে উঠেছে প্রযুক্তির ফলে। এক সময় গাঁজা বা ইয়াবা কারবারের স্পট ছিল। এখন স্মার্টফোনের কারণে মাদক মানুষের হাতে চলে যাচ্ছে। ভার্চুয়াল যোগাযোগে কারবার ঘটছে মাদকের। এসব নিয়ন্ত্রণে নতুন করে সাইবার ক্রাইম সেল গঠনে কাজ চলছে। পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে সচেতন নাগরিকদের নিয়ে একটি বৃহৎ কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের গবেষণা মতে, যেসব দেশে যুবশক্তি বেশি সেখানে মাদক কারবারিদের নজর থাকে অনেক বেশি। সেসব স্থানে মাদকের বিস্তার ঘটানোর জন্য মাদক কারবারিরা নানা কৌশল গ্রহণ করে। প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিশ্বের সব দেশের সামগ্রিক অবস্থা জানা সহজ হওয়ায় টার্গেটকৃত স্থানে মাদক বিস্তারে যোগাযোগ চালায় কারবারিরা। নেয় পাচারের নানা কৌশল।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে জনসংখ্যার বড় একটি অংশ যুবগোষ্ঠী। সেজন্য এদেশ মাদক কারবারিদের অন্যতম টার্গেট। এখানে আইসসহ অধিকাংশ মাদক আসে বিভিন্ন দেশ থেকে, যার বেশিরভাগ আসে মিয়ানমার ও ভারত থেকে। এর মধ্যে আবার সিংহভাগ আইস প্রবেশ করছে মিয়ানমার থেকে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক দুলাল কৃষ্ণ সাহা বলেন, ইয়াবা তৈরির মূল উপাদান অ্যামফেটামিন। ইয়াবায় থাকে ২০–২৫ শতাংশ অ্যামফেটামিন। আইসে অ্যামফেটামিন ব্যবহার হয় শতভাগ। তাই ইয়াবায় যে ক্ষতি তার চেয়ে বেশি ক্ষতি আইস সেবনে।
তিনি জানান, কাচের টোব্যাকো পাইপের তলায় আগুনের তাপ দিয়ে ধোঁয়া আকারে আইস গ্রহণ করে মাদক সেবনকারীরা। আবার ধোঁয়ার মাধ্যমের চেয়ে ইনজেকশনের মাধ্যমে নিলে মাত্র ১৫ থেকে ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে এর কার্যক্রম শুরু হয়। এমন পরিস্থিতিতে যে কোনো কর্মকাণ্ড ঘটাতে দ্বিধা করে না এই মাদক গ্রহণকারীরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইস লবণের মতো দানাদারজাতীয় মাদক। দেখতে কখনো চিনির মতো, কখনো মিছরির মতো। আইস উচ্চমাত্রার মাদক, যা সেবনের পর মানবদেহে উত্তেজনার সৃষ্টি করে। আইসের দাম ইয়াবার চেয়ে অনেক বেশি। ক্ষতি বা প্রভাবও বেশি। এটি সেবনে মস্তিষ্ক বিকৃতিতে মৃত্যুও হতে পারে। তাছাড়া অনিদ্রা, অতিরিক্ত উত্তেজনা, স্মৃতিভ্রম, হৃদরোগকে বেগবান করে। এই মাদক সয়লাব হলে ইয়াবার চেয়ে বেশি বিপর্যয়ের মুখে পড়বে তরুণ সমাজ। স্ক্যানিংয়ে ধরা পড়ছে না আইস। আইস গ্রহণ করলে এর নেশা সহজে ছাড়তে পারে না মাদকসেবীরা।