দেশে সরকারি পর্যায়ে চালের মজুদ গত বছরের তুলনায় কমে প্রায় এক তৃতীয়াংশে নেমেছে। খাদ্য বিভাগ বলছে, চলতি বছরের কৃষি মৌসুমে চালের সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী সংগ্রহ না হওয়ায় মজুদ কমেছে। অন্যদিকে আমদানির ক্ষেত্রে নানা জটিলতায় মজুদ দ্রুত বাড়ছে না।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকারি ভুল নীতি ও সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় চালের মজুদ কমেছে। এ সুযোগে ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে চালের দাম বাড়িয়েছেন। দেশীয় চাহিদা থাকার সুযোগে আন্তর্জাতিকভাবেও চালের দাম বেড়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. নাজমানারা খানুম মঙ্গলবার সন্ধ্যায় আজাদীকে বলেন, গত বছরের তুলনায় এবার আমাদের স্টক (মজুদ) কিছুটা কম আছে। কারণ আমরা বিগত বোরো ও আমন মৌসুমে অভ্যন্তরীণ সংগ্রহের ক্ষেত্রে কাঙ্খিত পর্যায়ে অর্জন করতে পারিনি। যে কারণে আন্তর্জাতিকভাবে চাল সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছি। জিটুজি এবং আন্তর্জাতিক উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমেও চাল সংগ্রহ শুরু করেছি। বেসরকারি পর্যায়েও চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, সরকারিভাবে চাল সংগ্রহের যে চুক্তিগুলো হয়েছে বেশিরভাগই ভারতের সাথে। আমদানিকৃত চাল আসা ও খালাস শুরু হয়েছে। তবে যেভাবে আসছে, সেটাতে ধীরগতি আছে। ইতোমধ্যে প্রায় ২ লক্ষ ৩৪ হাজার টন চাল বাংলাদেশে এসে পৌঁছেছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ খালাস হয়েছে। কিছু খালাসের অপেক্ষায় রয়েছে।
তিনি আরো বলেন, আগামী জুন মাস পর্যন্ত প্রয়োজনীয় খাদ্যের মজুদ আমাদের রয়েছে। কিন্তু নিরাপত্তা মজুদের ক্ষেত্রে কিছুটা ঘাটতি রয়েছে। চালের বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য এখন খাদ্যবান্ধব এবং ওএমএস কর্মসূচি চলছে। রমজানে যাতে সাধারণ মানুষের কষ্ট না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রেখে খুচরা বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ওএমএস বাড়াব।
খাদ্য সচিব বলেন, একসাথে অনেকগুলো জাহাজ চলে আসার কারণে প্রথম পর্যায়ে খালাসে জটিলতা থাকলেও বন্দর কর্তৃপক্ষের সাথে আলাপের প্রেক্ষিতে এর সমাধান করা হয়েছে। এই সমস্যার কারণে আমরা কিছু চাল বার্জে আনার অনুমতি দিয়েছি। বার্জগুলো খুলনায় আসছে। কারণ খুলনায় খাদ্যবিভাগের নিজস্ব জেটি রয়েছে।
তিনি বলেন, বাজার নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বেসরকারি উদ্যোক্তাদের অনুমতি দিয়েছি। তবে যা এলসি (ঋণপত্র) খুলেছে, তার ৫০ শতাংশ আমদানি করেছে। তাদেরও বেশিরভাগ চাল ভারত থেকে আসছে। কিন্তু এসব চাল স্থলবন্দর দিয়ে দেশে প্রবেশে জটিলতার কারণে ১০-১৫ দিন পর্যন্ত বিলম্ব হয়ে যাচ্ছে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্টদের অনেক চিঠিপত্র লিখছি। অনেকভাবে যোগাযোগ করা হচ্ছে। তাছাড়া দেশে ধান কাটার মৌসুম শুরু হলে কৃষকরা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেজন্য আমদানিকারকদের চাপের মধ্যে রাখছিলাম। কিন্তু স্থলবন্দরগুলোতে জটিলতার কারণে তাদের বারবার সময় বাড়াতে হচ্ছে। আমরা আশাবাদী, রোজার মধ্যে খাদ্য নিয়ে কোনো অসুবিধা হবে না।
সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে আমন সংগ্রহ মৌসুমে (১৫ মার্চ শেষ হওয়া পর্যন্ত) মাত্র ৮৩ হাজার ২০২ মেট্রিকটন চাল সংগ্রহ হয়েছে। অথচ ওই মৌসুমে ৮ লক্ষ ৫০ হাজার মেট্রিক টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত ছিল। গত বছরের আমন মৌসুমে সংগ্রহ হয়েছিল ৭ লক্ষ ৯৭ হাজার ৫৭৫ মেট্রিক টন। বিগত বোরো মৌসুমে (১৫ সেপ্টেম্বর শেষ হওয়া পর্যন্ত) চাল সংগ্রহ হয়েছে ৯ লক্ষ ৯ হাজার ৯২৬ মেট্রিক টন। লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৯ লক্ষ ৫০ হাজার মেট্রিকটন। আগের বছরের বোরো মৌসুমে চাল সংগ্রহ হয়েছিল ১৪ লক্ষ ৯ হাজার ৮৮৪ মেট্রিক টন। সব মিলিয়ে চলতি বছর দুই মৌসুম মিলে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ১৮ লক্ষ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহ কম হয়েছে। এতে কমতে থাকে সরকারি চালের মজুদ।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, চলতি বছর সরকারিভাবে নির্ধারিত দামের চেয়ে বাজারে চালের দাম বেশি থাকায় কৃষক পর্যায়ে চাল সংগ্রহে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে খাদ্যবিভাগ। ব্যবসায়ীরা সরকারি মজুদ কমে যাওয়ার সুযোগ নিয়ে চালের দাম বাড়িয়েছেন বলে অভিযোগ।
খাদ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (৩১ মার্চ পর্যন্ত) মোট ৪৬ লক্ষ ৫ হাজার ৭৮০ মেট্রিন টন খাদ্যশস্য আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে ৬ লক্ষ ৯০ হাজার ৫৫০ টন চাল এবং ৩৯ লক্ষ ১৫ হাজার ২৩০ মেট্রিক টন গম। একই সময়ে সরকারিভাবে খাদ্যশস্য আমদানি হয়েছে ৪ লক্ষ ২২ হাজার ৬০ মেট্রিক টন। এতে চাল আমদানি হয়েছে ১ লক্ষ ৯৭ হাজার ৬৬০ মেট্রিক টন এবং গম আমদানি হয়েছে ২ লক্ষ ২৪ হাজার ৪০০ মেট্রিক টন। সব মিলিয়ে বর্তমানে সরকারিভাবে খাদ্যের মজুদ দাঁড়িয়েছে ৪ লক্ষ ৮৭ হাজার ৮৩০ মেট্রিক টনে। এর মধ্যে চালের মজুদ ৪ লক্ষ ১৩ হাজার ৪৯০ মেট্রিক টন এবং গমের মজুদ ৭২ হাজার ৩৬০ মেট্রিক টন। অথচ বিগত অর্থবছরের (২০১৯-২০২০) একই দিনে সরকারি খাদ্যশস্যের মজুদ ছিল ১৬ লক্ষ ৪১ হাজার ৩৯০ মেট্রিক টন। এর মধ্যে চালের মজুদ ছিল ১৩ লক্ষ ৪৭ হাজার ৭৯০ মেট্রিক টন এবং গমের মজুদ ছিল ২ লক্ষ ৯৩ হাজার ৬০০ মেট্রিক টন।
গত মৌসুমে ধানের ফলন বিপর্যয়ের কারণে এবং সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে খোলা বাজারে চালের দাম বাড়তি থাকায় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী চাল সংগ্রহ করতে পারেনি খাদ্যবিভাগ। ফলে এ বছর সরকারি খাদ্যশস্যের মজুদ আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। তাই দ্রুত খাদ্যশস্যের মজুদ বাড়ানোর জন্য সরকারিভাবে জিটুজি পর্যায়ে বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানির অনুমতি দেয় সরকার। কিন্তু আমদানির অনুমতি নিয়ে ঋণপত্র খুলে অধিকাংশ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত সময়ে চাল আমদানি করেনি। এ সুযোগে সিন্ডিকেট কারসাজির কারণে দেশের খুচরা বাজারে বেড়েছে চালের দাম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের ২০ মার্চ পর্যন্ত ১৪ লক্ষ ৫২ হাজার ৩২০ মেট্রিক টন চালের ঋণপত্র খোলা হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৩ লক্ষ ৩৬ হাজার ১০ টন চালের ঋণপত্র সমাপ্ত হয়েছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই মাসে ৩৭০ মেট্রিক টন, আগস্টে ৩৬০ মেট্রিক টন, সেপ্টেম্বরে ১৪০ মেট্রিক টন, অক্টোবরে ৬৫০ মেট্রিক টন, নভেম্বরে ৪৯০ মেট্রিক টন, ডিসেম্বরে ১ লক্ষ ১ হাজার ৭২০ মেট্রিক টন, জানুয়ারিতে ৭ লক্ষ ২০ হাজার ৫০ মেট্রিক টন, ফেব্রুয়ারিতে ১ লক্ষ ৭৬ হাজার ৮৫০ মেট্রিক টন এবং মার্চ মাসের প্রথম ২০ দিনে ৪ লক্ষ ৫১ হাজার ৬৯০ মেট্রিক টন চালের জন্য ঋণপত্র খুলেছেন ব্যবসায়ীরা।
ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য মতে, বাজারে ৪৫ টাকার নিচে কোনো চাল নেই। খুচরায় মোটা জাতের স্বর্ণা ও ইরি চাল বিক্রি হয়েছে প্রতিকেজি ৪৫ টাকা থেকে ৪৭ টাকায়। পাইজাম জাতের চাল বিক্রি হয়েছে প্রতিকেজি ৫০ টাকা থেকে ৫৬ টাকায়। উন্নত জাতের নাজির শাইল ও মিনিকেট চাল বিক্রি হয়েছে ৫৮ টাকা থেকে ৬৪ টাকা কেজিতে। তবে খুচরা বাজারে সপ্তাহের ব্যবধানে মাঝারি মানের চালের দাম কেজিতে ১-২ টাকা কমেছে।
খাদ্য মজুদের বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম বলেন, ভুল নীতির কারণে এবার খাদ্যের মজুদ কমেছে। মজুদ কমিয়ে ফেলা খুব বিপজ্জনক হতে পারে। এবার আমনের ফলন কম হয়েছে। আরও আগেই খাদ্য আমদানির পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল। পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানিতে শুল্ক কমিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু এখন আমদানির পদক্ষেপ নিয়েছে, অনেক দেরি হয়ে গেছে। এর ফলে সরকারি মজুদের বিরাট ধস নেমেছে। এর সুযোগ নিচ্ছে ব্যবসায়ীরা। যার কারণে এখন চালের দাম অনেক বেশি। প্রত্যেক বছরে এই সময়ে চালের দাম যত থাকে, এখন তা থেকে প্রতিকেজিতে ১০-১৫ টাকা বেশি হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, সরকারি নীতি পরিবর্তন কিংবা গ্রহণে দেরি করলে আন্তর্জাতিক বাজারে তার প্রভাব পড়ে। যেমন ভারত যখন বুঝতে পেরেছে বাংলাদেশ এখন অনেক বেশি আমদানি করবে, ভারত চালের দাম ইচ্ছেকৃত বাড়িয়ে মুনাফা করছে। মন্ত্রণালয়ের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে এতে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।
তবে রমজানে চালের দাম আর বাড়বে না বলে মনে করেন তিনি। কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন, এপ্রিল-মে মাসে যখন রমজান, তখন আমাদের বোরো মৌসুমে ধান কাটা শুরু হবে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় না হলে, ভালো ফলন হলে তখন চালের দাম কমে যাবে।