প্রতিনিয়তই দেশের বাজারে বাড়ছে চালের দাম। সম্প্রতি খুচরা পর্যায়ে কেজিতে চালের দাম পাঁচ টাকা থেকে আট টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। কোনোভাবেই বাগে আনা যাচ্ছে না চালের বাজার। অথচ বিশ্ব বাজারে চালের দাম খুব কম। পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, বিশ্ববাজারে চালের দাম গত আট বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে গেছে–এই ঘটনা এশিয়ার অনেক কৃষকের জন্য বড় ধাক্কা। রেকর্ড উৎপাদন ও ভারতের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ায় বাজারে সরবরাহ বেড়ে গেছে। তাতেই কমেছে চালের দাম। থাইল্যান্ডের ৫ শতাংশ ভাঙা সাদা চালের রপ্তানি মূল্য বিশ্ববাজারের মানদণ্ড হিসেবে পরিচিত। এই চালের দাম সমপ্রতি টনপ্রতি ৩৭২ দশমিক ৫০ ডলারে নেমে গেছে। গত বছরের শেষ ভাগের তুলনায় এই দাম ২৬ শতাংশ কম। সেই সঙ্গে ২০১৭ সালের পর সর্বনিম্ন। কিন্তু বিশ্ববাজারে চালের দাম কমলেও দেশের বাজারে তার প্রভাব নেই। বিশ্ব বাজারে চালের দামের এই পতন শুরু হয় ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ চাল রপ্তানিকারক দেশ ভারত ধাপে ধাপে রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে শুরু করে তখন। এই ঘটনা চালের বাজারে বড় প্রভাব ফেলে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, এ বছর সব ধরনের চালের মূল্যসূচক ১৩ শতাংশ কমেছে।
এদিকে বিশ্ববাজারে চালের দাম কমলেও দেশের বাজারে বেশ অনেক দিন ধরেই চালের দাম বাড়তি। জুলাই মাসে বাজারে সব ধরনের চালের দাম কেজিতে ৫–৬ টাকা বেড়েছে। এমনকি চালের ভরা মৌসুমেও দেশের বাজারে দাম বেড়েছে। সরকারি তথ্যে দেখা যায়, ২০২৪ সালের ১৭ নভেম্বর চাল আমদানির অনুমতি দেওয়ার পর ২০২৫ সালের ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত চাল আমদানি হয়েছে ১০ লাখ ৩৪ হাজার ৮৭৯ মেট্রিক টন। এ ছাড়া বোরো মৌসুমে ফলনও ভালো হয়েছে। কিন্তু তাতেও চালের দাম কমেনি, বরং বাড়ছে।
বিশ্লেষকেরা বলেন, চাল উৎপাদনে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। সে ক্ষেত্রে ঠিক সময় আমদানি করতে হবে, যেন চাহিদাজনিত চাপ চালের বাজারে আলাদা সংকট সৃষ্টি করতে না পারে। সরবরাহ ঠিক থাকলে বাজারে কারসাজির সুযোগ কমে যায়। কিন্তু বাংলাদেশে চাল আমদানি সাধারণত নিষিদ্ধ থাকে। সরকার বিশেষ অনুমতি দিয়ে চাল আমদানি করে। সময়মতো আমদানি না হলে বাজারে কারসাজির সুযোগ সৃষ্টি হয় বলে জানা যায়। চাল দেশের মানুষের প্রধান খাদ্যশস্য। চালের দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতির ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে। দরিদ্র পরিবারে ব্যয়ের বড় খাত হলো চাল। সে কারণে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা গুরুত্বপূর্ণ।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের নানামুখী উদ্যোগেও কমেনি চাঁদাবাজি। হাতবদলের পরে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে চাঁদাবাজরা। যার প্রভাব পড়ছে বাজারগুলোতে। ফলশ্রুতিতে বাড়ছে চালের দাম। হাসিনা সরকারের পতনের পর মাসখানেক বন্ধ থাকলেও চাঁদাবাজরা ভোল পাল্টে আবার মাঠে সক্রিয় হয়েছে। এ কারণে চালসহ প্রায় সব ধরনের পণ্যই চড়া দামে বাজারে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে ব্যবসায়ীরা। একজন ব্যবসায়ীকে হাটে, বাজারে, সড়কে, মহাসড়কে, আড়তে, পাইকারি বাজারে, খুচরা বাজারে এবং মহল্লার দোকানে পর্যন্ত বিভিন্ন কায়দায় চাঁদা দিতে হচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলেন, বাজার সিন্ডিকেট ও চাঁদাবাজির কারণে পণ্যের দাম ৩০ শতাংশ বাড়ে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেশে নির্বাচিত সরকার না থাকায় সরকারের মজুত নীতিমালার তোয়াক্কা করছেন না অসাধু মজুতদাররা। যার প্রভাবে গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে মানভেদে প্রতি কেজি চালের দাম পাইকারি পর্যায়ে ২–৬ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। ক্রেতারা বলছেন, একদিকে আয়ের চাপ, অন্যদিকে প্রতিদিনের নিত্যপ্রয়োজনীয় এই পণ্যের দাম বৃদ্ধিতে তাদের নাভিশ্বাস উঠছে। তাঁরা বলেন, চালের বাজার ফের অস্থির করার পাঁয়তারা চলছে। হঠাৎ করে এভাবে চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ ভোক্তাদের কষ্ট আরও বাড়বে। এ অবস্থায় সরকারের পক্ষ থেকে বাজার মনিটরিং জোরদার ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমানোর উদ্যোগের দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।
চালের দাম স্থিতিশীল রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। গবেষকদের মতে, চাল এমন একটি পণ্য, এর দাম বাড়লে সবচেয়ে বেশি চাপে পড়ে শ্রমজীবী ও গরিব মানুষ। অতএব, চালের দাম যাতে কোনোভাবে না বাড়ে, সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। আমদানি নয়, বরং খাদ্য উৎপাদন বাড়িয়ে এবং সরকারি গুদামে প্রয়োজনীয় ধান–চাল মজুত করেই বাজার স্থিতিশীল রাখার ওপর জোর দিতে হবে। দেশের নিম্ন আয়ের মানুষের সংখ্যা বেশি। চালের বাজার বৃদ্ধি হলে সাধারণ ভোক্তার কষ্ট বাড়ে। তাই আমরা মনে করি, চালের বাজারদর যে কোনো মূল্যেই স্থিতিশীল রাখতে হবে।