চালের বাজার অস্থিতিশীলতার মধ্যে একটা সুসংবাদ হলো, ১২ হাজার ৭০০ মেট্রিক টন আতপ চাল নিয়ে ভিয়েতনাম থেকে আসা একটি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছেছে।এ বিষয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, জিটুজি চুক্তির আওতায় ভিয়েতনাম থেকে মোট এক লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানি করার কথা। চুক্তি মোতাবেক ইতোমধ্যে ৬০ হাজার মেট্রিক টন চাল দেশে পৌঁছেছে। বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজে রক্ষিত চালের নমুনা পরীক্ষার কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। খালাসের কার্যক্রম দ্রুত শুরু হবে। এ জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সরকারি মজুত বাড়াতে গত জানুয়ারিতে ভিয়েতনাম থেকে এক লাখ টন আতপ চাল কেনার এ প্রস্তাবে সায় দেয় সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি।
ভিয়েতনাম সাউদার্ন ফুড করপোরেশনের কাছ থেকে প্রতি টন ৪৭৪ দশমিক ২৫ ডলারে এই চাল আমদানি করা হচ্ছে। এতে মোট খরচ হচ্ছে ৫৭৮ কোটি ৫৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
চালের দামের সাথে অনেক বিষয় জড়িত। চাল এমন একটি পণ্য, এর দাম বাড়লে সবচেয়ে বেশি চাপে পড়ে শ্রমজীবী ও গরিব মানুষ। অতএব, চালের দাম যাতে কোনোভাবে না বাড়ে, সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। আমদানি না হলেও খাদ্য উৎপাদন বাড়িয়ে এবং সরকারি গুদামে প্রয়োজনীয় ধান–চাল মজুত করেই বাজার স্থিতিশীল রাখার ওপর জোর দিতে হবে। খোলাবাজারে কম দামে পর্যাপ্ত চাল বিক্রিও পরিস্থিতির উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে।
১৬ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশ। আর মানুষের বেঁচে থাকার অন্যতম অবলম্বন খাদ্য। বৃহৎ এই জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় স্বাধীনতা–উত্তর ৫৩ বছরে যে হারে মানুষ বেড়েছে, সে হারে খাদ্য উৎপাদনও বেড়েছে। তা না হলে ১৬ কোটি মানুষের মুখের আহার যোগান দেওয়া সম্ভব হতো না। এর পরও প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন– অতিবৃষ্টি, আগাম বন্যার কারণে ফলন বিপর্যয় হলে খাদ্য ঘাটতি হয়ে থাকে। আর খাদ্য ঘাটতি হলে বিদেশ থেকে সরকারি–বেসরকারিভাবে খাদ্যশস্য আমদানি করে তা সামাল দেওয়া হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, সঠিক নীতি ও পরিসংখ্যানের অভাবে চালের বাজার যেকোনো সময় অস্থিতিশীল হতে পারে। কিন্তু যথাসময়ে নির্ভুল পরিসংখ্যান প্রকাশে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে অনেক ঘাটতি রয়েছে। ২০২৩–২৪ অর্থবছরে চালের মোট উৎপাদন ধরা হয়েছে ৪ কোটি ৭ লাখ ৫০ হাজার টন। তাতে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত চালের সরবরাহ সংকট ও মূল্যবৃদ্ধির কোনো আশঙ্কা ছিল না। কিন্তু বাস্তবে তা–ই হয়েছে। অনেকে মনে করেন, এ পরিসংখ্যান অতিমূল্যায়িত, স্ফীত। কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে এবার আমন মৌসুমে ফলন হয়েছে ১ কোটি ৭১ লাখ টন। চলতি আমন মৌসুমে আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ৫৬ লাখ হেক্টর। দেশে ২০২৩–২৪ অর্থবছরের আমন মৌসুমে রেকর্ড ১ কোটি ৬৬ লাখ টন ধান উৎপাদন হয়েছিল। এবার সে রেকর্ড অতিক্রম করেছে বলে দাবি কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের। যদিও বিশ্লেষকরা বলছেন, আমন উৎপাদন কোনোভাবেই দেড় কোটি টন ছাড়ানো সম্ভব না। কেননা এবারের বন্যায় আমন উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। অন্যদিকে সরকারি পরিসংখ্যান বিভাগ কৃষি উৎপাদনের হালনাগাদ তথ্য দিতে প্রায়ই বেশি সময়ক্ষেপণ করে। যেমন গত বছরের মে মাসে বোরো ধান উৎপাদনের কাজ শেষ হয়েছে। তার পরিসংখ্যান এসেছে সেপ্টেম্বরের শেষ প্রান্তে। যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে নির্ভুল ও হালনাগাদ পরিসংখ্যান প্রকাশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে যথাসময়ে নির্ভুল পরিসংখ্যান প্রকাশে প্রতিষ্ঠানগুলোর আরও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত।
চাল সিন্ডিকেটের ভিত খুবই শক্ত। তারা মৌসুমের সময় কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনে মজুদ করে। অভিযোগ রয়েছে, কৃষকের হাতে সামান্য যে ধান থাকে সেগুলোর মজুদ ফুরালে শুরু হয় করপোরেট ও মজুদদারের খেলা। এরপর বাজার চলে যায় তাদের নিয়ন্ত্রণে।
চালের দাম বৃদ্ধির পেছনে অনেকেই এই ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট অতি মুনাফালোভীদের দায়ী করছেন। যতদূর জানি, সরকারের পক্ষে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। যেন কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে কেউ মূল্য বৃদ্ধি করতে না পারে। চালের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়ায়।