ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দুর্নীতি না করতে সরকারি কর্মচারীদের ‘কড়া বার্তা’ দিয়েছেন। বলা হয়েছে, এই প্রশাসনে দুর্নীতিবাজ কারও ঠাঁই হবে না। সুশাসন নিশ্চিতে প্রত্যেককে কাজের ক্ষেত্রে সৎ থাকতে হবে। সরকারি কেনাকাটায় পরিচয় দিতে হবে নৈতিকতা ও সর্বোচ্চ দেশপ্রেমের। নিজের পাশাপাশি অধীনস্থদের দুর্নীতিমুক্ত রাখতে না পারার দায় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার ঘাড়েও বর্তাবে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্রের বরাত দিয়ে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কর্মচারীদের প্রতি ইতোমধ্যে এমন কড়া বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে হবে দুর্নীতিবিরোধী সমন্বিত অভিযান। দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গঠনের অংশ হিসেবে কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব নেওয়া, গাড়িবিলাস পরিহার ও অনিয়ম–দুর্নীতি করলে তাকে কঠোর শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এখানে উল্লেখ্য যে, ১ সেপ্টেম্বর সব কর্মচারীর সম্পদের হিসাব বিবরণী জমা দিতে বলেছে সরকার। বর্তমানে জনপ্রশাসনে এটিই সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। বেশির ভাগ কর্মকর্তা এটিকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন। তাঁরা বলছেন, ১৫ লাখ সরকারি কর্মচারীর মধ্যে অপকর্মে জড়িত গুটি কয়েক। তাদের কারণে সবার দুর্নাম হয়। এ পদক্ষেপের মাধ্যমে সৎ ও নিষ্ঠাবান কর্মকর্তাদের মর্যাদা সমুন্নত হবে। অতীতে দুর্নীতিতে অভিযুক্ত কিংবা বিভাগীয় মামলায় শাস্তিপ্রাপ্তদের মধ্যে ভয় কাজ করছে। যদিও প্রকাশ্যে সরকারের পদক্ষেপকে তারাও সাধুবাদ জানাচ্ছেন। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, কোনো সরকারি কর্মচারী নিজ পদপদবির ব্যবহার করে প্রভাব খাটিয়ে আগামীতে দুর্নীতি বা অপকর্মে জড়ালে, তাকে কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হবে। সিদ্ধান্ত হয়েছে, সুশাসন বিঘ্নকারী এসব কার্যকলাপের বিরুদ্ধে উপযুক্ত আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মুখ চিনে কোনো সিদ্ধান্ত দেবে না সরকার। সম্পদের মতো সরকারি কর্মচারীর যথেচ্ছ গাড়ি ব্যবহারের লাগাম টানা হচ্ছে। বেশির ভাগ মন্ত্রণালয়ের সচিব অধীনস্থ দপ্তরগুলোর একাধিক গাড়ি, জ্বালানি ও চালক ব্যবহার করেন। স্ত্রী, ছেলে–মেয়েও একাধিক গাড়ি ব্যবহার করেন। এতে সরকারের ব্যয় বেড়ে যায়। অনেকে প্রকল্পের গাড়িও ব্যবহার করেন। এ অবস্থায় গত সোমবার বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এবং আওতাধীন দপ্তর ও সংস্থার কর্মকর্তাদের প্রাধিকারবহির্ভূত গাড়ি ব্যবহার বন্ধের নির্দেশনা দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দুর্নীতি প্রতিরোধ ও দুর্নীতি দমনের অভিযানকে সফল করতে হলে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ–উদ্যমকে একযোগে কাজে লাগাতে হবে। তবে এই কঠিন লক্ষ্যে সফলতা অর্জনের একটি পূর্বশর্ত হচ্ছে দুর্নীতি সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা। যদি সংঘবদ্ধ ও সমন্বিতভাবে দুর্নীতির কদর্য চেহারাকে পরিচিত করে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে এবং জনস্বার্থে এর কুফল সম্পর্কে তথা জনসচেতনতা সৃষ্টি করা যায়, তাহলে দেশ আরও এগিয়ে যাবে।
সাধারণ মানুষের মধ্যে দুর্নীতিবিরোধী সচেতনতা তৈরির ওপর জোর দিচ্ছেন বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ। তাঁরা বলেন, দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার মাধ্যমেই কেবল দুর্নীতিকে সহনশীল মাত্রায় কমিয়ে আনা সম্ভব। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বব্যাপী প্রতিরোধ গড়ে তোলার বিকল্প নেই। কোনো মানুষ দুর্নীতিবাজ হিসেবে জন্মগ্রহণ করে না। পারিবারিক, সামাজিক ও আশপাশের পরিবেশই মানুষের জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে। তাই দুর্নীতিবিরোধী অভিযান নিজের ঘর থেকেই শুরু করতে হবে। দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। সৎ, আন্তরিক ও নিষ্ঠাবানদের সামাজিকভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। তাহলেই দুর্নীতি হ্রাস পাবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, দুর্নীতির কারণে দেশের সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। তবে কেবল আইন প্রয়োগ ও শাস্তির মাধ্যমে দুর্নীতি রোধ সম্ভব নয়। সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলে সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে দুর্নীতির মূলোৎপাটন করা হবে। বিগত সরকারের আমলে যে পরিমাণ দুর্নীতি ও অনিয়ম হয়েছে, তার প্রভাব যেন বর্তমানে না পড়ে, তারজন্য সতর্ক আছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। তাঁরা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে একমত হয়েছেন যে, নাগরিক সচেতনতা সৃষ্টি না হলে এবং সামাজিকভাবে দুর্নীতিবাজদের বয়কট না করলে শুধু আইন দিয়ে দুর্নীতি কমানো সম্ভব নয়। দুর্নীতি বাঁচিয়ে রেখে দেশের উন্নয়নও সম্ভব নয়, হলেও সে উন্নয়ন টেকসই হবে না। দুর্নীতি সহনীয় পর্যায়ে আনতে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।