১.
‘ম’ নামের শহরটা ছোটবেলা থেকে আমার ভীষণ প্রিয়। ছোট্ট ছিমছাম পরিচ্ছন্ন একটা শহর। কতো প্রাচীন নিদর্শন আছে এই শহরে! অকৃপণ হাতে কেউ যেন সাজিয়ে রেখেছে শহরটাকে। তবে আমার বিশেষ পছন্দের কারণ প্রাকৃতিক, ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক সবকিছু ছাপিয়ে অন্যকিছু। পৃথিবীতে আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষদের একজন বাস করেন এই শহরে। অনেক আগ থেকে। সম্ভবত আমার জন্মেরও আগে থেকে। আমার সবসময় মনে হয় তিনি তাঁর সন্তানদের চেয়ে আমাকে বেশি ভালোবাসেন।
না, তাঁর কথা সবিস্তারে জানাবার জন্য এই লেখা না। সময় সুযোগ বুঝে তাঁকে নিয়ে বড় একটা কাজ করার ইচ্ছে আছে। দু’হাজার আঠারোতে ‘ম’র কথা নিয়ে যে কারণে এই লেখাটায় হাত দিয়েছিলাম, তা হল– খবরের কাগজে দেখলাম ‘ম’ শহরটি এখন রণক্ষেত্র, বিশ্ববিদ্যালয়ের কল্যাণে!
এমন তো হবার কথা ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার আলো ছড়ায়, কর্মসংস্থান বাড়ায়, মানবিকতা ও সভ্যতার বিস্তার ঘটায়। অনগ্রসর জনপদে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলে আলোকিত হয়ে ওঠে সমগ্র অঞ্চল ও আশপাশের এলাকা। ধোঁয়ার কুণ্ডলী, পথচারীর প্রাণভয়ে পালানো আর ঝাপসা আকাশের ছবি দেখে আজকের গাজা কিংবা ইউক্রেনের ছবি বলে ভ্রম হতে পারে। খবরে প্রকাশ– ছাত্রদের মাঝে দলীয় উপদলীয় কোন্দল সংঘাত রক্তপাতে গিয়ে শেষ হয় কথায় কথায়। ছাত্র–শিক্ষকের মতপার্থক্য দ্বন্দ্বে রূপ নেয় অশোভনভাবে। প্রতিষ্ঠার এক যুগের পরিসংখ্যানে প্রাণহানি, অঙ্গহানি সবই আছে।
বিদ্যা চর্চায় দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তুলনায় এগিয়ে, কি পিছিয়ে আছে– সে খবর ঠিক জানা নেই। তবে অস্ত্রবাজিতে কারও চেয়ে পিছিয়ে নেই, এক যুগের মাথায় দেশের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতোই ব্যাপক দক্ষতা অর্জিত হয়েছে, এ–কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের হাত দিয়ে সভ্যতা ও আলোর পরিবর্তে তবে কি বিস্তার ঘটছে সহিংসতা ও অন্ধকারের! এক যুগ আগে শান্ত নিরিবিলি এই শহরে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত না হলে ঐসব যুবকরা হয়তো এমন বেঘোরে খরচ হয়ে যেতো না। যুদ্ধের বিভীষিকাও হয়তো ছড়িয়ে পড়তো না শান্ত এই জনপদে।
কেন তবে এই শিক্ষা? বিশ্ববিদ্যালয় কি কেবলই একটা অবকাঠামো? আকাশছোঁয়া অট্টালিকার সারি?
২.
প্রধান ফটকে সদ্য গোঁফ গজানো পুলিশ বালকেরা অস্ত্র হাতে ঝিমোয়। হাসি–তামাশা করে, মুঠোফোনে খেলায় মাতে, কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সময় কাটায়। সকাল– দুপুর–সন্ধ্যা। কোনো অঘটন ঘটে গেল ওরা তেমন কিছুই করতে পারে না। ঢাল তলোয়ার সমেত ওদের কুচকাওয়াজের সারি ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগেই শেষ দৃশ্য চলে আসে ঢাকাই ছবির মতো।
লাঠি–সোটা, হাতুড়ি–কুড়াল,দা–ছুরি থেকে শুরু করে মারাত্মক আগ্নেয়াস্ত্র থাকে ছাত্রদের সংগ্রহে। অনেকের নামে মামলা মোকদ্দমা থাকে। মামলা যার নামে বেশী, তার দাম ও দাপট তত বেশী। অনেকে মাঝে মাঝে হাজত সফরে যান, জামিন লাভ করে সগৌরবে ফিরে আসেন ক্যাম্পাস চত্বরে। পাইক পেয়াদা, সৈন্যসামন্ত, দেহরক্ষী সমভিবেহারে চলাফেরা করেন। দ্বিচক্রযান মোটরগাড়ি হাঁকান বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্র মাটি কাঁপিয়ে। আতংকে কেঁপে উঠে পথচারীর আত্মা। শ্রেণীকক্ষে একদিনও পায়ের ধুলো না দিয়ে পরীক্ষায় বসার প্রবেশপত্রও হাতে পেয়ে যান। অতঃপর অলৌকিক ক্ষমতাবলে পাশের সনদ নিয়ে বাড়ি ফিরে যান। না, ঠিক বাড়ি নয়। বাড়ি এখন তাঁদেরকে ধারণ করার ক্ষমতা হারিয়েছে। মা’কে আর না হলেও চলে যায়। তারা যান নতুন কোনো আস্তানায়। প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বলা যেতে পারে। নেতা হবার প্রশিক্ষণ নেন দ্রুততম সময়ে। দেশটার হাল ধরতে যে হবে তাঁদেরকেই! সনদ পেয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ের মায়া কাটিয়ে যেতে পারেন না অনেকে। অতন্দ্র প্রহরী হয়ে দেখভাল করে যান বিশ্ববিদ্যালয়ের আনাচ–কানাচ!
বেশীরভাগ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিত্য দিনের ছবি এটা। তবু প্রতি বছর সারাদেশ থেকে ঢল নামে নতুন শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয় অভিমুখে।
জাতি হিসেবে আমরা কি সত্যিই অনেক বিদ্যানুরাগী?
৩.
একে একে দেশের অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয় অর্ধশতক পাড়ি দিয়েছে, গৌরবময় সুবর্ণ জয়ন্তী পালিত হয়েছে মহাসমারোহে। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড শতবর্ষ পরিক্রমা সম্পন্ন করে ফেলেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাও অর্ধশতক ছাড়িয়ে গিয়েছে। বিভাগীয় শহরেই কেবল নয়, এখন প্রান্তিক জেলা শহরেও প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে বিশ্ববিদ্যালয়। এসব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকগণের অনেকেই বিশ্বের নানা দেশ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেছেন। আন্তর্জাতিক প্রকাশনা ছাড়াও সনদ, পদকের সঙ্গে নিয়ে এসেছেন এক জীবনের স্মৃতি। পৃথিবীর আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে ও নানা গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে ও ভবনের সামনে উর্দিধারী সশস্ত্র দ্বাররক্ষীর জটলা দেখা যায় কী না, তাঁরা ভাল বলতে পারবেন।
তাঁরা জানেন, সেসব দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে প্রাণ হারায় না কোনো শিক্ষার্থী। দলাদলিকে কেন্দ্র করে মান কিংবা প্রাণ হারায় না কোনো শিক্ষক। একইভাবে সহপাঠীর প্রাণ কেড়ে নেয় না কোনো শিক্ষার্থী, আর সহকর্মীকে অসম্মান অপদস্থও করে না কোনো শিক্ষাবিদ। প্রত্যক্ষভাবে মূলধারার রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে না শিক্ষক শিক্ষার্থী কেউই। অথচ আমাদের এখানে উন্নত দেশ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসা শিক্ষকগণও দেশে ফিরে এসে যদ্দিন যদাচারের মতো অদ্ভুত সব কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন, আর অনেক ঘাম ঝরিয়ে, কাঠ খড় পুড়িয়ে পাওয়া ড. র–এর প্রতি অবিচার করেন।
প্রতিদিন, প্রতিঘণ্টার খবরে বিশ্ববিদ্যালয়; কি খবরের কাগজে, কি টেলিভিশনে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সয়লাব খবর ও ছবিতে। না, জ্ঞান–বিজ্ঞানে অগ্রগতির খবর নয়, শিল্প চর্চার খবরও নয়। কেবলই খণ্ডযুদ্ধের খবর, ছাত্রে–ছাত্রে, শিক্ষকে– শিক্ষকে, ছাত্রে–শিক্ষকে। শিক্ষকের সরাসরি তত্ত্বাবধানেও অনেক ছাত্র ব্যবহৃত হয়, খণ্ড যুদ্ধের রসদ হিসেবে। কোমলপ্রাণ শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন না দেখিয়ে ওদেরকে আমরা অবলীলায় ব্যবহার করি উপরে ওঠার সিঁড়ি হিসেবে। কত ওপরে! এই ওপরে ওঠার নেই কোনো সীমা–পরিসীমা।
দরিদ্র অসহায় অশিক্ষিত জনগোষ্ঠী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে সীমাহীন বিস্ময় নিয়ে। তাদের ভাষায়– ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের’র অর্থই ‘মারামারি হয় যেখানে’। পঞ্চাশ বছরে দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছে। বিকলাঙ্গ হয়েছে কতজন তার পরিসংখ্যান জানা নেই। ডিগ্রি নিতে এসে যুবকদের অঙ্গহানি ও প্রাণদানের ঘটনা বিশ্ব–ইতিহাসে বিরল। আর জ্ঞান অর্জনের কথাতো বলাই সার। অথচ, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বমান রক্ষা নিয়ে হাজারটা কথা বলা হচ্ছে। যেখানে প্রাণহানি, নিদেনপক্ষে মানহানির ভয়ে আতঙ্কিত থাকতে হয়, সেখানে বিশ্বমান রক্ষার স্বপ্ন অলীক স্বপ্ন বলেই প্রতীয়মান হয়।
কে না জানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্ররাজনীতিই দায়ী সকল হতাহতের পেছনে! কোনো রাজনৈতিক দলের খাতায় লাশের সংখ্যা কত, সে হিসেবে না গিয়ে দেড় শতাধিক মা সন্তান হারালেন পাঁচ দশকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্র প্রাঙ্গণে– সেভাবে দেখতে হবে আমাদের। আমাদের শিক্ষার্থীদের বোঝাতে হবে–যেই দলেই নাম লিখিয়ে নিবেদিতপ্রাণ কর্মী হয়ে অমুক তমুক ভাইয়ের পক্ষ নিয়ে কাজ করো না কেন, তুমি মরে গেলে তোমার দল বা সেই বড় ভাইদের কিছুই আসবে যাবে না, বরং তারা উপকৃত হবে। কেবল তোমার মায়ের বুকটাই খালি হবে, নিঃস্ব হয়ে যাবে তোমার পরিবার।
বাংলাদেশের জন্মাবধি যে দেড় শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী প্রাণ হারিয়েছে তাদের মায়েদের চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে মুখের হাসি ফিরিয়ে আনতে পারবো না আমরা। তবে আর যেন কোনো মায়ের সন্তান বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনা থেকে হারিয়ে না যায়, তা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে, এখনই। আমাদের ছেলেমেয়েদের বাঁচাতে হবে। বাঁচাতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে। কেউ মার খাবে, কেউ মেরে যাবে– এই ধারা বন্ধ করতে হবে। ঢাকঢোল অনেক পেটানো হয়েছে। উচ্চ শিক্ষার নামে অন্ধকার খাদের কিনারে চলে এসেছি আমরা। মঞ্চ কাঁপিয়ে বক্তৃতা ভাষণ দিয়ে শেষ রক্ষা হবে না। আমাদের শিক্ষার্থীদের মাঝে সততা, নৈতিকতা, মানবিকতা, পরার্থপরতার বীজ বুনে প্রকৃত শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে হবে সমাজে। তবেই আসতে পারে কাঙ্ক্ষিত সেই সুদিন।
অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়