জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে চার দিনের অচলাবস্থায় চট্টগ্রাম বন্দর বিপুল আর্থিক ক্ষতির কবলে পড়েছে। কোটি কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে দেশের আমদানি-রপ্তানিকারকদের। চট্টগ্রাম বন্দর বেশ কিছুদিনের চেষ্টায় যে ইমেজ বিশ্বের শিপিং সেক্টরে গড়ে তুলেছিল চার দিনের পরিবহন ধর্মঘট তাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলল।
অপরদিকে করোনাকালের ধকল সামলে ঘুরে দাঁড়ানো গার্মেন্টস খাতেও ওই চার দিন ক্ষত তৈরি করে গেল। প্রায় সাড়ে তিন হাজার টিইইউএস পণ্য বোঝাই কন্টেনার রেখে বন্দর ত্যাগ করেছে ছয়টি জাহাজ। এসব রপ্তানি পণ্য সময়মতো ট্রান্সশিপমেন্ট পোর্টে না পৌঁছানোর ফলে মাদার ভ্যাসেল ধরতে পারবে না। ফলে সময়মতো পণ্য ডেলিভারি না হওয়ায় সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের বড় সংকটে পড়তে হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে শুক্রবার সকাল থেকে ধর্মঘটের কারণে গণপরিবহনের সাথে পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত গাড়িগুলোর চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সব ধরনের পণ্য পরিবহন বন্ধ হয়ে যায়। আবার বিভিন্ন কারখানায় উৎপাদিত রপ্তানি পণ্য পরিবহনও মুখ থুবড়ে পড়ে। বন্দর ও ১৯টি বেসরকারি আইসিডিতে স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়। দেশব্যাপী পণ্য পরিবহন নেটওয়ার্কও ভেঙে পড়ে।
বন্দরে জাহাজ থেকে কন্টেনার খালাসের কার্যক্রম অব্যাহত থাকলেও সেই কন্টেনার বাইরে ডেলিভারি দেয়া সম্ভব হচ্ছিল না। অপরদিকে রপ্তানি পণ্য বোঝাই কন্টেনার আইসিডি থেকে নেয়া সম্ভব হচ্ছিল না বন্দরে।
ধর্মঘট সোমবার মধ্যরাত পর্যন্ত বহাল থাকে। ওই সময়ের মধ্যে বন্দর থেকে ৩৪শ টিইইউএস পণ্য নিয়ে ছয়টি জাহাজের বন্দর ত্যাগ করার কথা ছিল। কিন্তু কন্টেনারগুলো আইসিডি থেকে বন্দরে না পৌঁছায় ওই ছয়টি জাহাজ কন্টেনার না নিয়েই নোঙর তোলে। এতে করে কন্টেনারগুলো আটকা পড়ে। এসব কন্টেনার পরবর্তী সুবিধাজনক জাহাজে ট্রান্সশিপমেন্ট পোর্টে পাঠানো হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। তবে ততদিন ট্রান্সশিপমেন্ট পোর্টে ইউরোপ-আমেরিকাগামী মাদার ভ্যাসেল অপেক্ষা করবে কিনা বা সিডিউল বিপর্যয়ের পর মাদার ভ্যাসেল এসব কন্টেনার আদৌ নিতে পারবে কিনা তা নিয়ে সংশয় ব্যক্ত করা হয়েছে। কন্টেনারগুলো সময়মতো ইউরোপ-আমেরিকায় না পৌঁছলে সংশ্লিষ্ট রপ্তানিকারকদের বিপদে পড়তে হবে।
বন্দর সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে প্রতিদিন তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টিইইউএস কন্টেনার পণ্য ডেলিভারি হয়। অপরদিকে প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই হাজার টিইইউএস কন্টেনার পণ্য আইসিডি থেকে বন্দরে প্রবেশ করে। ধর্মঘটের চার দিনে প্রায় ১২ হাজার আমদানি পণ্যবোঝাই কন্টেনার এবং প্রায় ১০ হাজার রপ্তানিবাহী পণ্যবাহী কন্টেনার সময়মতো জাহাজিকরণ সম্ভব হয়নি। চট্টগ্রাম বন্দর এবং আইসিডিগুলোতে পণ্য বোঝাই কন্টেনারের পাহাড় গড়ে উঠছে। আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের এই ক্ষতি সামলে উঠতে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের বেগ পেতে হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ব্যবসায়ীদের এই ক্ষতির পাশাপাশি চট্টগ্রাম বন্দর অপূরণীয় এক ক্ষতির শিকার হলো উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, করোনাকালে বিশ্বের বড় বড় বন্দরগুলো যখন নানা সংকটে পড়েছিল, জাহাজ এবং কন্টেনার জট সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছিল, তখন চট্টগ্রাম বন্দর সুনাম কুড়িয়েছিল। জট থেকে বের হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে দিনে দিনে বার্থিং পাওয়ার রেকর্ড বিশ্বের শিপিং সেক্টরে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। বন্দরের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। কিন্তু চার দিনের অচলাবস্থা চট্টগ্রাম বন্দরের কষ্টার্জিত সেই ইমেজের বড় ক্ষতি করল।
এদিকে গতকাল বহির্নোঙরে ৯টি কন্টেনার জাহাজ অবস্থান করছিল। এর মধ্যে ৩টি জাহাজ গত তিন দিন ধরে বার্থিংয়ের জন্য অপেক্ষা করছে। বহির্নোঙর কন্টেনার জাহাজ শূন্য এবং বহির্নোঙর থেকে সরাসরি বার্থিংয়ে চলে আসার অবস্থা থেকে চট্টগ্রাম বন্দর পিছিয়ে গেছে বলে সূত্রগুলো মন্তব্য করেছে।
ধর্মঘট প্রত্যাহারের পরপরই বন্দরের পণ্য সরবরাহ কার্যক্রম স্বাভাবিক গতিতে শুরু হয়েছে জানিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, কিছু সমস্যা হয়েছে। এগুলো কাটিয়ে ওঠার সক্ষমতা আমাদের রয়েছে। ক্ষয়ক্ষতি কী হয়েছে তার চেয়ে বড় কথা এখন দ্রুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে তোলা। আমাদের চেয়ারম্যান মহোদয়সহ শীর্ষ কর্মকর্তারা সৃষ্ট সংকটের ব্যাপারে সজাগ রয়েছেন।
তিনি জানান, কন্টেনার ডেলিভারি শুরু হওয়ায় বন্দরের ইয়ার্ডে আটকা পড়া কন্টেনারের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। গতকাল বন্দর ইয়ার্ডে ৩৭ হাজার ৩১৬ টিইইউএস কন্টেনার ছিল। আগের দিন যার পরিমাণ ছিল ৩৮ হাজার ১৬৯ টিইইউএস। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।