চার কারণ, সাত সুপারিশ

নালায় পড়ে শিশুর মৃত্য, তদন্ত প্রতিবেদন ‘ভবনে ছিল না দারোয়ান, মূল ফটক উন্মুক্ত থাকায় তিন বছরের শিশুটি বাইরে চলে যায়, পড়ে যাওয়া ড্রেনটি ছিল প্রাইভেট, দায় আছে পরিবারেরও’

মোরশেদ তালুকদার | শুক্রবার , ১১ জুলাই, ২০২৫ at ১০:৫৯ পূর্বাহ্ণ

দুর্ঘটনার দিন ভুলবশত ভবনের মূল ফটক খোলা ছিল। ভবনের মূল ফটক উন্মুক্ত থাকায় এবং কোনো প্রহরী বা দারোয়ান না থাকায় শিশুটি অনায়াসে ভবনের বাইরে যাওয়ার সুযোগ পায়। যদি মূল ফটক বন্ধ থাকতো এবং দারোয়ান বা প্রহরী সবসময় উপস্থিত থাকত তাহলে শিশুটি বাইরে যাওয়ার সুযোগ পেত না এবং এ দুর্ঘটনা সংঘটিত হতো না। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, ভবনের মূল ফটক উন্মুক্ত ছিল এবং কোনো দারোয়ান কিংবা প্রহরী দুর্ঘটনার সময়ে সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। সরেজমিনে তদন্তেও জানা যায়, উক্ত ভবনে কোনো প্রহরী বা দারোয়ান নেই, শুধুমাত্র আশরাফ হোসেন নামে একজন কেয়ারটেকার ভবনটি দেখাশোনা করেন। তার দাবি, সবসময় ভবনের মূল ফটক বন্ধ রাখা হয়। গত মঙ্গলবার বিকেলে নগরের হালিশহরের আনন্দিপুরে নালায় পড়ে তিন বছরের শিশু হুমায়রার মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) গঠিত তদন্ত প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে আসে। অর্থাৎ যে ভবন (নিয়াজ খানের ভবন) থেকে বের হয়ে শিশু হুমায়রা নালায় পড়ে যায় ওই ভবনের অব্যবস্থাপনাকে দায়ি করে তদন্ত কমিটি। এটিসহ প্রতিবেদনে শিশু হুমায়রা নালায় পড়ে যাওয়াজনিত দুর্ঘটনার জন্য চারটি কারণ বলা হয়। এছাড়া ভবিষ্যতে এই ধরনের দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সাতটি সুপারিশ করা হয়। প্রতিবেদনে চারটি পর্যবেক্ষণও রয়েছে।

চসিক সূত্রে জানা গেছে, গত রাত সাড়ে ১১ টার দিকে চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে তদন্ত প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন কমিটির প্রধান ও সংস্থাটির প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা কমান্ডার ইখতিয়ার উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। এর আগে মঙ্গলবার দুর্ঘটনার পর ৩ সদস্যের কমিটি গঠন করে এক কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেন প্রধান নির্বাহী। কমিটির অন্য দুই সদস্য হচ্ছেন নির্বাহী প্রকৌশলী আনোয়ার জাহান (সদস্য সচিব) ও ম্যালেরিয়া ও মশক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা মো. সরফুল ইসলাম। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার বিষয়টি আজাদীকে নিশ্চিত করেন চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম।

দুর্ঘনার সম্ভাব্য চার কারণ : প্রতিবেদনে দুর্ঘটনার সম্ভাব্য চার কারণ হিসেবে কর্মস্থলে অপর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা, পরিবারের দায়িত্বহীনতা, ভবনের মূল ফটক উন্মুক্ত থাকা এবং প্রহরী বা দারোয়ান না থাকা, সড়কের অবস্থান এবং উচ্চতার তারতম্যকে চিহ্নিত করা হয়।

প্রতিবেদনে কর্মস্থলে অপর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা তুলে ধরে বলা হয়, কর্মস্থলে কর্মরত কর্মীদের শিশু সন্তানদের রাখার মতো কোনো ব্যবস্থা উক্ত প্রতিষ্ঠানে ছিল না। যার ফলে শিশুটিকে তার মায়ের কর্তব্যকালীন সময় দীর্ঘক্ষণ ধরে অরক্ষিতভাবে বাইরে অবস্থান করতে হয় এবং এই দুর্ঘটনা ঘটে।

পরিবারের দায়িত্বহীনতা প্রসঙ্গে বলা হয়, তিন বছরের একটি ছোট শিশুর একা একা এই ধরনের প্রবল বর্ষণের সময়ে বাইরে অবস্থান এবং খেলাধুলা করার ক্ষেত্রে পরিবারের উচিত ছিল তার দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা। শিশুটির নালায় পড়ে মৃত্যুর পিছনে এটি একটি অন্যতম কারণ।

সড়কের অবস্থান এবং উচ্চতার তারতম্য হিসেবে বলা হয়, ঘটনাস্থলের বাইলেন অপেক্ষা মূল সড়কের উচ্চতা বেশি। বাইলেনটির পেছনে অত্যাধিক বড় বিল বা খালি জায়গার জলাবদ্ধ পানি বাইলেনটি দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় উক্ত সড়কে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। সড়ক দুইটির মাঝে উচ্চতার তারতম্যের জন্য দুইটি নালার সংযোগ স্থলে ছোট নালার গভীরতা বৃদ্ধি পায় (২ ফুট ১০ ইঞ্চি) এবং পানি নিষ্কাশনের সময় প্রবল স্রোত সৃষ্টি হয়, যা শিশুটির ছোট নালায় পড়ে বড় নালায় ঢুকে যাওয়ায় কারণ ছিল।

দুর্ঘটনা এড়াতে সাত সুপারিশ : ভবিষ্যতে দুর্ঘটনা এড়াতে কর্মস্থলে কর্মীদের শিশুদের নিরাপত্তা ও নিরাপদে রাখার ব্যবস্থা করাসহ সাতটি সুপারিশ করা হয়।

অন্য সুপারিশগুলোতে বলা হয়, ভৌগোলিকভাবে চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন স্থানের উচ্চতা বিভিন্ন রকম হওয়ায় ও নগরায়ন দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ায় বিভিন্ন স্থানে কিছু সময়ের জন্য জলাবদ্ধতা হতে পারে। তাই নগরবাসী তাদের চলাচলে নিজের ও পরিবারের সদস্যদের বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের ক্ষেত্রে অধিক মনোযোগী ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য এলাকার আয়তনের ভিত্তিতে পর্যাপ্ত ড্রেইনেজ সিস্টেমের ব্যবস্থা করতে হবে। ভবন নির্মাণ ও ব্যবহারের অনুমোদিত নীতিমালা যথাযথভাবে মেনে চলতে হবে এবং ড্রেইনেজের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা সংরক্ষণ করতে হবে।

ঝুঁকিপূর্ণ নালা সমূহের উপর পর্যাপ্ত স্ল্যাব স্থাপন করতে হবে। এক্ষেত্রে ব্যক্তি মালিকানাধীন সড়ক ও ড্রেইনেজের জন্য মালিকগণকে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে উন্নয়ন কাজের জন্য যথাযথ প্রক্রিয়ায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে হস্তান্তর করতে হবে।

আবাসিক এলাকায় কারখানা অথবা গার্মেন্টস জাতীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ পরিচালনার ক্ষেত্রে আইনগত বিধান নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া চট্টগ্রামবাসীকে এ ধরণের নিরাপত্তামূলক সচেতনতার জন্য প্রচারণার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে বলেও সুপারিশ করা হয়।

কমিটির পর্যবেক্ষণ : প্রতিবেনে কমিটি চারটি পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে। এতে বলা হয়, হুমায়রার মা আসমা বেগম আনন্দিপুর জামে মসজিদ সংলগ্ন পাঁচ তলা বিশিষ্ট নিয়াজ খানের ভবনের নীচ তলায় অবস্থিত সাবরিনা এ্যাপারেলসে কাজ করতে আসেন। কর্মস্থলে থাকাকালীন তার শিশু সন্তান হুমায়রা অরক্ষিতভাবে ভবনের পার্কিং এরিয়াতে একা খেলাধুলা ও ঘোরাঘুরি করতে থাকে। ভবনের মূল ফটক খোলা থাকা এবং কোনো প্রহরী না থাকায় একপর্যায়ে শিশুটি খেলতে খেলতে বাইরের রাস্তায় চলে আসে। চলমান ভারী বৃষ্টির ফলে মসজিদের দক্ষিণ এবং মূল সড়কের পূর্ব পাশের অংশ আনন্দিপুর মসজিদ গলিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। শিশুটি বল নিয়ে খেলার সময় আনন্দিপুর মসজিদ গলির ছোট ড্রেইনে জমে থাকা পানিতে বলটি পড়ে গেলে সে বলটি তুলতে গিয়ে অতিরিক্ত পানির স্রোতে উক্ত সড়কের পাশের ছোট ড্রেনটিতে পড়ে যায় এবং স্রোতের তোড়ে ভেসে পার্শ্ববর্তী বড় ড্রেনে চলে যায়। পরবর্তীতে স্থানীয় জনগণের সহায়তায় শিশুটির নিথর দেহ উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গত কয়েকদিন যাবত বঙ্গোপসাগরের নিম্নচাপজনিত কারণে চট্টগ্রাম শহরে ভারী বর্ষণ হয়। উক্ত বর্ষণের দরুন শহরের নিচু জায়গা সমূহ যেমনবিভিন্ন খালি জায়গা, বিল, নিচু সড়ক ইত্যাদি স্থানসমূহে পানি জমে যায় এবং এ পানি শহরের সড়ক, উপসড়ক সংলগ্ন ড্রেন, বাড়ির আঙিনা ইত্যাদি দিয়ে প্রবল স্রোতে পার্শ্ববর্তী বড় ড্রেন বা খালে পতিত হয়। চট্টগ্রাম শহরে বিভিন্ন ধরনের সার্ভিস ড্রেন রয়েছে যা দিয়ে শহরের পানি নিষ্কাশিত হয়। এক্ষেত্রে যে সকল সড়ক সংলগ্ন ড্রেন আকারে ক্ষুদ্র এবং স্ল্যাব দিয়ে ঢাকার অনুপযোগী সেগুলোতে অনেক ক্ষেত্রে সহজে পরিষ্কারের উদ্দেশ্যে উন্মুক্ত থাকে এবং এগুলো সাধারণত প্রাইভেট ড্রেন হিসেবে বিবেচিত হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, হুমায়রা যে ড্রেনটিতে পড়ে সেটি মূল সড়কের সাথে লাগানো ব্যক্তি মালিকানাধীন একটি বাড়ির পার্শ্বস্থ ছোট আকারের প্রাইভেট ড্রেন, যার প্রস্থ ১৫ ইঞ্চি, গভীরতা শুরুর দিকে ১ ফুট ৮ ইঞ্চি এবং যেখানে মূল সড়কের ড্রেনের সাথে সংযুক্ত হয়েছে সেখানে ২ ফুট ১০ ইঞ্চি। এ সড়ক ও ড্রেনটি ব্যক্তি পর্যায়ে এলাকার বাসিন্দাদের তৈরি। তবে ১২১৩ বছর আগে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন জনস্বার্থে উপসড়কটি কিছুটা সংস্কার করে। উক্ত সড়কের পেছনে ব্যক্তি মালিকানাধীন বড় একটি খোলা জয়গা রয়েছে (বসুন্ধরা আবাসিক সংলগ্ন) যেখানে প্রবল বর্ষনের কারণে জমাকৃত পানি উক্ত সড়ক ও ড্রেন উপচে প্রবল স্রোতে পার্শ্ববর্তী মূল সড়কের ড্রেনে প্রবেশ করে।

তৃতীয় পর্যবেক্ষণে বলা হয়, শিশুটি বল নিয়ে খেলার সময় উক্ত স্রোতে পতিত হয় এবং দৈহিক গড়নে ছোট হওয়াতে শিশুটি স্রোতের বেগ কাটিয়ে উপরে উঠতে না পেরে মূল সড়কের ড্রেনের ভেতর চলে যায়। মূল সড়কের ড্রেনটি স্ল্যাব দেওয়া থাকায় ওই সময়ে উপস্থিত স্থানীয় লোকজন সহজে শিশুটিকে ড্রেন থেকে উদ্ধারে সমর্থ হয়নি। পরবর্তীতে কিছুক্ষণ পর দুর্ঘটনার স্থান থেকে আনুমানিক ১৫০ ফুট দূরত্বে স্ল্যাব উঠিয়ে শিশুটিকে উদ্ধার করা হয়। উল্লিখিত প্রাইভেট ড্রেনটি আকারে ছোট হওয়ায় ড্রেনের উপরে স্ল্যাব দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়নি বলে এলাকাবাসীর সাথে আলোচনায় প্রতীয়মান হয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকমেছে পাশের হার, বেড়েছে জিপিএ-৫
পরবর্তী নিবন্ধ১০ বছরে এবার সর্বনিম্ন পাশের হার কম পাশ গণিতে