চার্জ গঠন হলেও এখনো শুরু হয়নি সাক্ষ্যগ্রহণ কার্যক্রম

ইমন ও অমিত খুনের মামলা বারবার প্রসেস ইস্যু করার পরও সাক্ষী হাজির হয়নি : রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী

হাবীবুর রহমান | মঙ্গলবার , ২ জুলাই, ২০২৪ at ১০:৩৪ পূর্বাহ্ণ

প্রায় ৭ বছর আগের ১৩ আগস্ট সকালে নগরীর এনায়েত বাজারের রানির দিঘির পাড়জুড়ে ছিল কৌতূহল। দিঘিতে ভাসতে থাকা ড্রামের ভেতর কী রয়েছে সেটাতেই সবার আগ্রহ। স্থানীয়রা খবর দিলেন পুলিশে। পুলিশ গিয়ে ড্রামটি টেনে তোলে। সিমেন্ট দিয়ে ঢালাই করা ড্রামটি কাটা হলো। বের হলো অর্ধগলিত একটি লাশ। খবর বের হলো লাশটি যুবলীগ কর্মী ইমরানুল করিম ইমনের। তাকে হত্যা করে লাশ ড্রামে ভরে সিমেন্ট দিয়ে ঢালাই করে ফেলে দেন তারই বন্ধু আরেক যুবলীগ কর্মী অমিত মুহুরী।

চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় কুমিল্লার একটি মাদক নিরাময় কেন্দ্র থেকে অমিত মুহুরীকে গ্রেপ্তার করা হয়। হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে বেশ পাল্টে তিনি আত্মগোপনের চেষ্টা করেছিলেন। একপর্যায়ে আদালতে তোলা হলে খুনের দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দেন তিনি। পাঠানো হয় কারাগারে।

গল্প এখানেই শেষ হতে পারত। কিন্তু হয়নি। অস্ত্র মামলায় আগে থেকেই কারাগারে থাকা রিপন নাথ নামের অপর এক আসামি ২০২০ সালের ২৫ জুলাই রাতে ইট দিয়ে মাথায় আঘাত করে কারা কক্ষে খুন করেন অমিত মুহুরীকে। ইমরানুল খুনের প্রায় তিন বছর পর অমিত মুহুরী খুনের ওই রাতও কৌতূহল ছিল কারাগারজুড়ে। এমনকি চট্টগ্রামজুড়েও।

রানির দিঘির পাড় এবং কারাগারে ঘটে যাওয়া চাঞ্চল্যকর এ দুই ঘটনায় দায়ের হওয়া দুটি মামলাই ঝুলে রয়েছে। দুই মামলায় চার্জ গঠন হলেও শুরু হয়নি সাক্ষ্যগ্রহণ কার্যক্রম। সাক্ষী হাজির করতে বারবার প্রসেস ইস্যু করা সত্ত্বেও সাক্ষী হাজির না হওয়ায় সাক্ষ্যগ্রহণ সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা। তারা বলছেন, সাক্ষী হাজির করা আমাদের কাজ না, পুলিশের কাজ। পুলিশ যদি সাক্ষী হাজির করে তাহলে আদালত সাক্ষ্য রেকর্ড করবেন।

জেলা পিপি শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী আজাদীকে বলেন, সাক্ষীর প্রতি প্রসেস ইস্যু করবেন আদালত। সেই অনুযায়ী পুলিশ সাক্ষীকে আদালতে হাজির করবে। সেটাই নিয়ম। আদালত প্রসেস ইস্যু করার পরও পুলিশ সাক্ষী হাজির না করাটা দুঃখজনক।

তিনি বলেন, ইমরানুল হত্যা ও অমিত মুহুরী হত্যা দুটোই গুরুত্বপূর্ণ মামলা। এ মামলা দ্রুত শেষ করা প্রয়োজন। এজন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে আন্তরিক হয়ে কাজ করতে হবে। একজন আরেকজনকে দোষারোপ না করে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। মামলার বাদী, রাষ্ট্রপক্ষ, আদালত, এমনকি প্রশাসন, সব পক্ষকে মনোযোগী হতে হবে। অনেক সময় দেখা যায় সাক্ষীর কাছে সমন পৌঁছায় না। এসব বিষয় দেখতে হবে।

২০১৭ সালের ১৩ আগস্ট নগরীর কোতোয়ালী থানার এনায়েত বাজার রানির দিঘি থেকে সিমেন্ট ঢালাই করা ড্রামের ভেতর থেকে ইমরানুল করিম ইমনের লাশ উদ্ধার করা হয়। তদন্তে নেমে ইমনের বন্ধু অমিতকে পুলিশ খুঁজতে শুরু করে। কিন্তু হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে পালিয়ে কুমিল্লায় চলে যান অমিত। সেখানে তিনি একটি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি হন। চুল দাড়ি কেটে বেশ পাল্টে ফেলেন। পুলিশের কাছে থাকা ছবির সঙ্গে পুরোপুরি মেলানো না গেলেও গলার বাঁ পাশে ও ডান হাতে আঁকা উল্কির কারণে তদন্তকারীরা তাকে চিনে ফেলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। কুমিল্লার আদর মাদক নিরাময় কেন্দ্র থেকে গ্রেপ্তার হন অমিত। আদালতে পাঠানো হলে তিনি ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। এতে তিনি বলেছেন, তার স্ত্রীকে প্রায়ই উত্ত্যক্ত করতো ইমন। এ কারণেই তাকে হত্যা করা হয়েছে।

এ ঘটনায় শিশির ও শফি নামে দুজন গ্রেপ্তার পরবর্তী আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেছিলেন, ইমরানুলের লাশ উদ্ধারের কয়েকদিন আগে ৯ আগস্ট নন্দনকান ৩ নম্বর গলির হরিশদত্ত লেইনে বেঙ্গল হোল্ডিংসের ষষ্ঠ তলায় অমিতের বাসায় ইমনকে হত্যা করা হয়। পরে ড্রামে ভরে চুন, এসিড দিয়ে সিমেন্ট ঢালাই করে ড্রামটি ফেলে দেওয়া হয় দিঘির পানিতে। শিশির তার জবানবন্দিতে দাবি করেছিলেন, অমিত নিজে ইমনকে খুন করে। তবে অমিত বলেছেন, ইমনের গলায় ছুরি চালিয়েছিল শিশির। আর সে নিজে মারধর করেছে। তখন পুলিশ জানিয়েছিল, ইমরানুল খুনে বেশ কয়েকজন জড়িত। নিজেকে যুবলীগ নেতা পরিচয় দেওয়া অমিত কেন্দ্রীয় যুবলীগ নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী বাবরের অনুসারী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সিআরবিতে রেলের দরপত্র নিয়ে জোড়া খুনেরও অন্যতম আসামি অমিত। সিআরবির জোড়া খুন ও ইমন খুনসহ অমিতের বিরুদ্ধে মোট ১৩টি মামলা আছে বলে পুলিশ জানায়।

আদালত সূত্র জানায়, ইমরানুলের ড্রাম ভর্তি লাশ উদ্ধারের ঘটনায় কোতোয়ালী থানার তৎকালীন এসআই মো. শামসুল ইসলাম ৩০২/২০১/৩৪ ধারায় একটি মামলা দায়ের করেন। তদন্ত শেষে অমিত মুহুরীসহ ৯ জনকে আসামি করে ২০১৯ সালের ২১ মার্চ চার্জশিট দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মো. হারুনুর রশিদ। বাকি আট আসামি হলেন মো. ইমাম হোসেন মজুমদার প্রকাশ শিশির, মো. শফিকুর রহমান প্রকাশ শফি, মো. সিয়াম চৌধুরী, অমিত মুহুরীর স্ত্রী চৈতী, রাজীব কান্তি চৌধুরী, জিতু প্রকাশ জিতু মুহুরী, রাকেশ মিত্র ও আশিক প্রকাশ জোবাইদুল আলম। এর মধ্যে মো. ইমাম হোসেন মজুমদার প্রকাশ শিশির ও শফিকুর রহমান প্রকাশ শফি জামিনে আছেন। বাকিরা পলাতক।

আদালত সূত্র জানায়, এ মামলায় পুলিশের দেওয়া চার্জশিট আমলে নিয়ে অমিত মুহুরী বাদে আটজনের বিরুদ্ধে ২০২২ সালের ৫ এপ্রিল চার্জগঠন করেন বিচারক। কারাগারে খুন হওয়ায় অমিত মুহুরীকে ২০২০ সালের ৫ আগস্ট মামলা থেকে বাদ দেওয়া হয়। মামলাটির বিচারকাজ চলছে চট্টগ্রামের ৫ম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ নারগিস আক্তারের আদালতে।

এ মামলায় মোট ৩১ জন সাক্ষী রয়েছেন উল্লেখ করে আদালতটির বেঞ্চ সহকারী ফরিদ আহমেদ আজাদীকে বলেন, বেশ কয়েকবার প্রসেস ইস্যু করেছি। কিন্তু সাক্ষী হাজির হয়নি। আগামী ১০ সেপ্টেম্বর ধার্য তারিখ রয়েছে। সেদিন যাতে হাজির থাকে সে জন্য আবারও প্রসেস ইস্যু করা হবে।

এদিকে কারাগারে অমিত মুহুরী খুনের ঘটনায় তৎকালীন জেলার নাশির আহমেদ বাদী হয়ে রিপন নাথের বিরুদ্ধে ৩০২ ধারায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। ২৮ বছর বয়সী রিপন নাথকে ঘটনার দিন বিকালে ওই কক্ষে নেওয়া হয়েছিল। একটি অস্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে ২০১৯ সালের এপ্রিল থেকে কারাগারে ছিলেন রিপন। সীতাকুণ্ড উপজেলার মৃত নারায়ণ চন্দ্র নাথের ছেলে রিপন এক সময় পাহাড়তলীর সাগরিকা এলাকার অর্গানিক জিন্স নামের একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। অশোভন আচরণের জন্য তাকে ওই কারখানা থেকে ছাঁটাই করা হয়। পরে ছুরি হাতে ওই কারখানায় ঢুকে বেশ কিছু কর্মীকে জিম্মি করার অভিযোগে রিপনকে গ্রেপ্তার করে পাহাড়তলী থানা পুলিশ।

আদালত সূত্র জানায়, অমিত মুহুরী খুনের মামলা তদন্ত শেষে রিপন নাথের (বর্তমানে কুমিল্লা কারাগারে আছেন) বিরুদ্ধে ২০২০ সালের ২৫ জুলাই চার্জশিট দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা ও নগর গোয়েন্দা পুলিশের তৎকালীন পরিদর্শক মো. আজিজ আহমেদ। এরপর ২০২২ সালের ৩০ জানুয়ারি তার বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন চট্টগ্রামের ৪র্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ শরীফুল আলম ভূঁঞা। তবে বর্তমানে মামলাটির বিচার কাজ চলছে ৭ম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে।

অমিত মুহুরী হত্যা মামলায় মোট ২৮ জন সাক্ষী রয়েছে উল্লেখ করে ৭ম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বেঞ্চ সহকারী অনিরুদ্ধ দত্ত আজাদীকে বলেন, সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য বাদী ও মামলা সংশ্লিষ্ট একজন ডাক্তারকে হাজির করার জন্য বেশ কয়েকবার প্রসেস ইস্যু করা হয়েছে। কিন্তু সাক্ষী আদালতে আসেননি। তাই চার্জগঠন হলেও সাক্ষ্যগ্রহণ এখনও হয়নি। আগামী ২৪ জুলাই মামলার ধার্য দিন রয়েছে। সেদিন সাক্ষী হাজির না হলে ফের প্রসেস ইস্যু করা হবে। কারাগারে খুন হওয়া অমিত মুহুরী কোতোয়ালী থানার নন্দনকানন গোলাপ সিং লেইনের অরুন মুহুরীর ছেলে। তার গ্রামের বাড়ী রাউজানে।

৫ম ও ৭ম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের এপিপি উত্তম কুমার দত্ত এবং মো. পেয়ার হোসেন পিয়ারু আজাদীকে বলেন, সাক্ষীকে আদালত কক্ষে হাজির করা পুলিশের কাজ। আদালত থেকে নিয়ম অনুযায়ী প্রসেস ইস্যু করা হয়েছে। সাক্ষী হাজির হলে আদালত সাক্ষ্য রেকর্ড করবেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধগিনেস রেকর্ডে আশিক
পরবর্তী নিবন্ধ৪৭ মাস পর সর্বোচ্চ রেমিটেন্স এলো জুনে