এবছরও কোরবানির পশুর চামড়ার ন্যায্য মূল্য পাওয়া গেল না। গত কয়েক বছর ধরে দেশের (একসময়ের প্রধান) রপ্তানীজাত পণ্য চামড়ার অবস্থা সঙ্গীন। অথচ চামড়া হলো দেশের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় রপ্তানি খাত। কারণ চামড়া দিয়ে তৈরী পণ্যের মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পুরোটাই দেশের জিডিপিতে যোগ হয়। তারপরও যুগ যুগ ধরে এই খাতটি অবহেলিত। একটু তদারক ও নজরদারি করলে এখাতের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ২ কোটি পশু জবাই করা হয়। যার মধ্যে ১ কোটির বেশি পশু জবাই করা হয় কোরবানি ঈদের সময়। অতীতে ট্যানারীগুলো কোরবানির সময় চামড়া সংগ্রহের জন্য জোর প্রস্তুতি গ্রহণ করতো। সরকারও কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহের উপর বিশেষ নজর রাখতো। ব্যাংক গুলো চামড়া সংগ্রহের জন্য কোটি কোটি টাকা লোন দিতো। তখন চামড়া সংগ্রহের জন্য মৌসুমি ব্যবসায়ীরা পাড়া মহল্লায় একধরনের প্রতিযোগিতা করতো। এতে সাধারণ মানুষ বিশেষ করে গরীব দুঃখী ও নিম্ন আয়ের মানুষ চামড়া বিক্রি থেকে ভাল অংকের টাকা পেত। কারণ চামড়া বিক্রির টাকার একমাত্র হকদার হচ্ছে গরীব মানুষ ও এতিম, যারা কোরবানি করতে পারে না। কিন্তু বিশ্বে চামড়ার দাম কমে যাওয়া, চাহিদার চেয়ে চামড়ার যোগান বেড়ে যাওয়া ও পুঁজি সংকটে ট্যানারী মালিকেরা চামড়া সংগ্রহ করতে চায় না। ফলে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা গত ৫-৬ বছর যাবত চামড়া সংগ্রহ করতে মাঠে নামে না। দাম ও ক্রেতা না থাকায় কয়েক বছর ধরে মানুষ কোরবানি পশুর চামড়া রাস্তাঘাট ও ডাস্টবিনে ফেলে দেয়। তবে এ বছর কিছু মাদ্রাসা এই জাতীয় সম্পদটি রক্ষায় এগিয়ে এসেছে। তারা চামড়া সংগ্রহ করে নিজেরা প্রক্রিয়াজাত করার ব্যবস্থা করায় অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়। তবে এ বছরও চামড়ার কোনো ক্রেতা ছিলো না। অনেকে স্বপ্রণোদিত হয়ে বিভিন্ন মাদ্রাসায় চামড়া পৌঁছে দেওয়ায় মূল্যবান এই দেশীয় সম্পদটি (কাঁচামাল) পচনের হাত হতে রক্ষা পেয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, কয়েক বছর ধরে কেন এমন হলো? চামড়ার কি কোনো চাহিদা নেই? সরকারের কি চামড়া শিল্প রক্ষার জন্য কিছুই করার নেই? দেশে প্রায় সব পণ্যের দামই এখন বাড়তির দিকে। শুধু চামড়ার দাম কম। এবিষয়ে জানতে চাইলে আড়তদারেরা বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার দাম কম। ট্যানারি মালিকেরা তাই ন্যায্য দাম দিতে চান না। তা ছাড়া ট্যানারি মালিকদের কাছে বিপুল অঙ্কের টাকা বকেয়া থাকায় আড়তদারেরা পুঁজি সংকটে রয়েছেন। অন্যদিকে ট্যানারি মালিক ও চামড়াজাত পণ্যের ব্যবসায়ীদের যুক্তি হচ্ছে, হেমায়েতপুরের চামড়াশিল্প নগরীর সিইটিপি মানসম্পন্ন না হওয়ায় ও পরিবেশ দূষণ বন্ধ না হওয়ায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন(ইইউ) ও যুক্তরাষ্ট্রের ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশি চামড়া কিনছে না। ফলে বাংলাদেশি চামড়ার মূল ক্রেতা এখন চীন। তারা দাম দেয় কম। অন্যদিকে হাজারীবাগের ট্যানারিগুলোর নিজস্ব কারখানার জায়গা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ রেড জোন ঘোষণা করে রাখায় সেসব জায়গা বিক্রি করা যাচ্ছে না। ফলে ট্যানারীগুলো ব্যাংক ঋণ শোধ করতে পারছে না। সে কারণে নগদ অর্থের সংকটে রয়েছে ট্যানারি মালিকেরা। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, সাভারের চামড়া শিল্প নগরের মানসম্পন্ন একটি সিইটিপির অভাবে চামড়ার দাম ও ক্রেতা পাওয়া যায় না। তাই বাধ্য হয়ে চায়নার কাছে ওয়েট ব্লু চামড়া বিক্রি করতে হয় মা.ড.১.২৫-১.৫০/বর্গফুট। মানসম্পন্ন ইটিপি হলে তা বিক্রি করা যেত মা.ড.২.৫-৫/বর্গফুট। অর্থাৎ শুধুমাত্র মান সম্পন্ন ইটিপির অভাবে আমরা অর্ধেকেরও কম দামে চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছি। অথচ স্থাপিত ইটিপিটি তৈরীর জন্য বিসিক হাজার কোটি টাকার উপর খরচ করেছে। তারপরও এটি মানসম্পন্ন ও পর্যাপ্ত ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন হয়নি। সরকারও এটি নিয়ে আর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। যদি সরকার নতুন একটি ইটিপি তৈরী করে তবে হয়ত কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ হবে কিন্তু দেশের লাভ হবে তার কয়েকগুণ এবং তা বিদেশী মুদ্রায়। যা দেশের বর্তমান ডলার সংকটে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতো।একটি পরিসংখ্যান দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। বড় আকারের একটি গরুর চামড়া ৩৫ থেকে ৪০ বর্গফুট, মাঝারি আকারের চামড়ায় ২১ থেকে ৩০ এবং ছোট আকারের চামড়ায় ১৬ থেকে ২০ বর্গফুটের হয়। যদি এভারেজে ৩০ বর্গফুট ও হয়, তবে ২ কোটি গরুতে চামড়া হবে ৬০ কোটি বর্গফুট। বর্তমানে দাম পাওয়া যায় ৯০ কোটি মা.ডলার। যা প্রায় ৯,০০০ কোটি টাকা। মান সম্পন্ন ইটিপি করতে পারলে এই অংক গিয়ে দাঁড়াবে প্রায় ১৮,০০০-৩০,০০০ কোটি টাকায়। এই সহজ হিসাবটি কেন কর্তাব্যক্তিদের মাথায় আসে না তা বোধগম্য নয়। মনে রাখতে হবে, দেশে এখনো ৩য় বৃহত্তম রপ্তানি আয়ের উৎস হলো চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য। ২০২১-২২ অর্থ বছরে এখাত হতে আয় হয় ১২৫ কোটি মার্কিন ডলার। প্রথম দুইটি হলো তৈরী পোশাক ও হোম টেক্সটাইল পণ্য। তবে উদ্যোগ নিলে চামড়া খাতটি প্রথম বা দ্বিতীয় স্থানে চলে আসবে।
গত রোজার সময় আমি আমার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে জুতা/সেন্ডেল কিনতে কয়েকটি ব্যান্ড শপে গিয়েছিলাম। দেখলাম শপগুলো বিদেশের জুতায় সয়লাব। বড় বড় ব্র্যান্ডে জুতা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের শোরুমেও বিদেশের জুতার ছড়াছড়ি। তারা দেশীয় পণ্যের চেয়ে বিদেশী পণ্য এনে বাজার জাত করাকে লাভজনক মনে করছে। অন্যদিকে চামড়ার জুতা সেন্ডেলের অত্যধিক (আগের বছরের দ্বিগুণ) দাম শুনে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। একজোড়া সেন্ডেলের দাম ২,৫০০- ৫,০০০ টাকা। একজোড় শ্যুয়ের দাম ৪,০০০- ১০,০০০ টাকা। দাম বেশি কেন, তার জবাবে দোকানীরা জানান কাঁচামালের দাম বেশি এবং শ্রমিক মজুরি বৃদ্ধি পাওয়ায় দাম বেড়েছে। অথচ দুই মাস পর দেখা গেল কাঁচা চামড়ার কোনো ক্রেতা ও দাম নেই। ফেলে দেওয়ার মত অবস্থা। তাহলে বিষয়টি কী দাঁড়ালো? সমগ্র বাজারটি এক শ্রেণির ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের দখলে, যারা দেশে পণ্য উৎপাদন না করে বিদেশি পণ্য বাজারজাত করছে। অত্যধিক লোভে পণ্যের দাম অযথা বাড়াচ্ছে। খবর নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে ৩০ বর্গফুটের একটি চামড়া প্রসেস করতে খরচ হয় ৩০০ টাকা। একটি চামড়া দিয়ে জুতা তৈরী হয় ১২ জোড়া। আর একজোড়া জুতা তৈরীর মোট খরচের ৪০% খরচ হলো চামড়ার। তাহলে বাজারের বর্তমান অবস্থায় একটি কাঁচা চামড়ার দাম হওয়ার কথা কম পক্ষে দশ হাজার টাকা। অথচ সেই চামড়ার কোনো দাম নেই! এতে সাধারণ জনগণ তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এরপরেও সরকার এর বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তাহলে প্রশ্ন হলো জনগণ যাবে কোথায়? অথচ চামড়াজাত পণ্যের ক্ষেত্রে আমরা সহজেই স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারি। সেটা না হওয়ায় গত অর্থ বছরে আমরা প্রায় ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য আমদানি করেছি। (বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের ৫৯ তম বৃহৎ চামড়াজাত পণ্য আমদানিকারক দেশ)। একদিকে আমরা ওয়েট ব্লু চামড়া রপ্তানি করছি, আবার অন্য দিকে চামড়ার তৈরী পণ্য আমদানি করছি। তাহলে প্রশ্ন হলো, সেই রপ্তানিকৃত চামড়া দিয়ে কেন আমরা চামড়াজাত পণ্য তৈরী করতে পারছি না? অথচ দেশে চামড়াজাত পণ্যের বিশাল মার্কেট রয়েছে। তাই সরকারকে চামড়ার বিষয়ে কঠিন পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনে চামড়াজাত পণ্য আমদানি পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে হবে। কারণ দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে দৃঢ় ও কঠিন পদক্ষেপ নেওয়া ছাড়া চামড়া শিল্পকে রক্ষা করা যাবে না।
লেখক: কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক।