চামড়া রফতানির ক্ষেত্রে এক সময় বেশ নাম ছিল বাংলাদেশের। এখাতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করত আমাদের এই বাংলাদেশ। কিন্তু বর্তমানে আগের সেই সুদিন আর নেই। চামড়াশিল্পে দিন দিন যেন ধস নামছে। গত ১০ নভেম্বর দৈনিক আজাদীতে ‘চট্টগ্রামে ছিল ২২টি ট্যানারি বন্ধ হয়ে গেছে ২১টি/ এ খাতে ত্রিশ বছরে হয়নি কোনো বিনিয়োগ, চামড়া শিল্পে সংকট’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়েছে, ‘গ্রিন কমপ্লায়েন্স বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক চাপ, পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের বিধিবিধান বাস্তবায়ন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবসহ নানা সংকটে চট্টগ্রামের ২২টি ট্যানারির ২১টিই বন্ধ হয়ে গেছে। চট্টগ্রামে কোরবানিসহ বছর জুড়ে চামড়ার যে যোগান তাতে অন্তত চল্লিশটি ট্যানারি চলতে পারে। অথচ বর্তমানে কেবলমাত্র একটি ট্যানারি চালু রয়েছে। গত ত্রিশ বছরেরও বেশি সময়ে চট্টগ্রামে নতুন কোনো ট্যানারি গড়ে উঠেনি, হয়নি বিনিয়োগও। বিপুল সম্ভাবনার ট্যানারি খাতে চট্টগ্রামের দুরবস্থা চামড়া শিল্পে সংকট সৃষ্টি করেছে। সূত্র জানিয়েছে, একসময়কার রপ্তানি বাণিজ্যে শীর্ষে থাকা চামড়া শিল্পে চট্টগ্রামের অবস্থান ছিল বেশ তুঙ্গে। তৎকালীন পাকিস্তানের বহু ব্যবসায়ী শিল্পপতি চট্টগ্রামে ট্যানারি শিল্প গড়ে তুলেছিলেন। সস্তা শ্রম এবং বন্দর সুবিধাসহ নানা সুবিধা কাজে লাগিয়ে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে বিদেশে রপ্তানি করতেন। ট্যানারি শিল্পের প্রায় পুরো নিয়ন্ত্রণই ছিল পাকিস্তানী ব্যবসায়ীদের হাতে। ট্যানারি শিল্পের স্বর্ণযুগে চট্টগ্রামে বাংলাদেশী মালিকানাধীন মন্টি ট্যানারি নামের একটি মাত্র ট্যানারি ছিল। বাকি সব ট্যানারি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে। মন্টি ট্যানারি পরবর্তীতে এইচআরসি ট্যানারি নামেও কিছুদিন ব্যবসা করেছিল’। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘চট্টগ্রাম থেকে কোটি কোটি টাকার চামড়া এবং চামড়াজাত পণ্য বিদেশে রপ্তানি হয়। কিন্তু এক পর্যায়ে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা নানা প্রতিকূলতার মুখে পড়ে। একে একে বন্ধ হতে থাকে ট্যানারি। শুরুতে মেট্রোপলিটন লেদার চট্টগ্রাম থেকে ব্যবসা গুটিয়ে ঢাকায় চলে যায়। বাকিগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র রিফ লেদার চট্টগ্রামে থাকলেও বাকি কোনোটিই আর চলে না। এরমধ্যে অনেকগুলোর অস্তিত্বই বিলীন হয়ে গেছে। মদিনা ট্যানারি কিছুদিন আগ পর্যন্ত চলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি।’
চট্টগ্রামে ২২টির মধ্যে ২১টি ট্যানারি বন্ধ হয়ে গেছে। এটি দুর্ভাগ্যের বিষয়। বহুদিন ধরে ট্যানারি শিল্পে বিনিয়োগ বন্ধ রয়েছে। নতুন বিনিয়োগ আসছেই না। ফলে এই সেক্টরে দুর্দিন লেগে রয়েছে। এ সংকটের নিরসন হওয়া জরুরি। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের উচিত এ সমস্যার সমাধানে দ্রুত এগিয়ে আসা। বিশেষজ্ঞরা বলেন, চামড়া রফতানির জন্য বাইরের দিকে না তাকিয়ে দেশে কীভাবে প্রক্রিয়াজাত করা যায় এবং চামড়াজাত পণ্য উৎপাদন করা যায়, তা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের ভাবতে হবে। প্রয়োজনে যেসব দেশ চামড়াজাত পণ্য উৎপাদন করে, তাদের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে আমাদের দেশে শিল্প–কারখানা স্থাপন করা যেতে পারে। এতে করে দেশের মানুষের চাহিদাও মিটবে এবং চামড়াজাত দ্রব্য রফতানি করে আরও বেশি মুনাফা অর্জন করা যাবে।
সম্প্রতি ‘চামড়া শিল্পের টেকসই উন্নয়নে করণীয়’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা বলেছেন, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) ভুলের মাশুল গুনতেই কারখানা স্থানান্তর করতে হয়েছে। এরপরও সম্ভব হয়নি চামড়া শিল্পের বাজার সমপ্রসারণ। বিপুল বিনিয়োগেও সাভারে চামড়া শিল্পনগরী সফলতা পাচ্ছে না। সম্ভাবনা সত্ত্বেও বেশ পিছিয়ে রয়েছে দেশের চামড়া শিল্প। তাঁরা বলেন, চামড়া খাত অনেক চ্যালেঞ্জের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এরপরেও শিল্প খাতে চামড়ার অবদান ২ শতাংশ। এ ছাড়া রপ্তানি আয়ের ৩.৮ শতাংশ আসে চামড়া শিল্প থেকে। অপরদিকে জিডিপিতে এই শিল্পের অবদান ০.৬০ শতাংশ।
চামড়া শিল্পের সম্ভাবনা উল্লেখ করে তাঁরা বলেন, বিশ্বে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের বাজারের প্রায় ৩ শতাংশ বাংলাদেশের দখলে। এর মধ্যে ২ শতাংশ গরু ও ৪ শতাংশ ছাগল। ২০৩০ সাল নাগাদ ১২.৩০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া মূল্য সংযোজন কর ৮০ শতাংশের বেশি হবে। জিডিপিতে চামড়া খাতের অবদান বাড়বে। প্রায় ৩৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পাবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, চামড়া খাতের নানা ব্যর্থতার কারণে কাঁচামাল থাকা সত্ত্বেও বিশ্ববাজারে শক্ত অবস্থান নিতে পারছে না বাংলাদেশ। সরকারকে এ বিষয়ে ভাবতে হবে। বাড়াতে হবে বিনিয়োগ।