বেশ কয়েক বছর ধরে কাঁচা চামড়ার কদর অনেকাংশে কমে গেছে। বলা যেতে পারে, ২০১৭ সালের পর থেকে এই দৈন্য দশা চলছে। চট্টগ্রামসহ সারা দেশেই কাঁচা চামড়া নিয়ে বিপাকে পড়েন কোরবানিদাতারা। তবে এবার কাঁচা চামড়ার কদর কিছুটা বাড়বে বলে মনে করেছিলেন ব্যবসায়ীরা। তবে মৌসুমী ব্যবসায়ী ও ফড়িয়ারা বলছেন, এবারও গতবারের মতোই চামড়ার দাম কম। খুব একটা বাড়েনি। এমনকি কোরবানিদাতারাও আগের চেয়ে বেশি দামে চামড়া বিক্রি করতে পারেননি।
উল্লেখ্য, ঈদ সামনে রেখে কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। ঢাকায় গরুর চামড়ার দাম গতবারের চেয়ে ৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৩ টাকা বেড়েছে। ট্যানারি ব্যবসায়ীদের এবার ঢাকায় লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া কিনতে হবে ৫৫ থেকে ৬০ টাকায়; গত বছর এই দাম ছিল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। ঢাকার বাইরে (চট্টগ্রামে) লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম হবে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা, গতবছর যা ৪৭ থেকে ৫২ টাকা ছিল।
আড়তদার সমিতির সভাপতি মো. মুসলিম উদ্দিন বলেন, এ বছর গরমের তীব্রতা আগের বছরগুলোর চেয়ে বেশি, যেটা চামড়া সংগ্রহের জন্য অনুকূলে নয়। চামড়া রেখে দিলে খুব তাড়াতাড়ি সেগুলো নষ্ট হয়ে যাবে। তাই মৌসুমী ব্যবসায়ীদের কাছে অনুরোধ থাকবে চামড়া সংগ্রহ করার পর যাতে দ্রুত আড়তে নিয়ে আসে অথবা লবণ দিয়ে স্থানীয়ভাবে মজুদ করে রাখা হয়।
তিনি মৌসুমী ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্যে বলেন, সরকারের বেঁধে দেওয়া দামটি সংরক্ষণের পরের দাম, যা অনেক কোরবানিদাতা কিংবা মৌসুমী ব্যবসায়ীরা বোঝেন না। তারা মনে করেন সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে আড়তদাররা চামড়া কিনবেন মৌসুমী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। তাই তাদেরকে বেশি দামে চামড়া ক্রয় না করার অনুরোধ জানান তিনি।
বিবিসি বাংলায় ‘চামড়া শিল্পে পরিবর্তন আসবে কবে?’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে সম্প্রতি। সেখানে বলা হয়েছে, সর্বশেষ ২০১৩ সালে কোরবানির পশুর চামড়ার দাম বেশি ছিল। সেবার গরুর প্রতি বর্গফুট চামড়ার দাম ছিল ৮৫–৯০ টাকা। এরপর থেকে বিভিন্ন কারণে চামড়ার দাম ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে। ২০১৭ সালের পর থেকে কাঁচা চামড়ার কদর কমেছে। গত বছরও একই দশা ছিল। রাজধানীসহ সারা দেশেই কাঁচা চামড়া নিয়ে বিপাকে পড়েন কোরবানিদাতারা। ২০১৯ সালে কোরবানির পশুর চামড়ার দামে বড় ধরনের ধস নামে। ন্যূনতম দাম না পেয়ে দেশের অনেক অঞ্চলে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়া সড়কে ফেলে দেয় এবং কেউবা মাটিতে পুঁতে ফেলে। প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের হিসেব মতে, এবারের ঈদুল আজহায় সারাদেশে প্রায় ১ কোটি ৪ লাখের বেশি পশু জবাই হয়েছে। এর মধ্যে ৪৮ লাখ ৫০ হাজারের মতো গরু–মহিষ এবং বাকিগুলো খাসি, বকরি, ভেড়া সহ অন্যান্য পশু। গত বছর ঈদুল আজহায় ১ কোটি ১০ লাখ পশু কোরবানি হয়েছিল। সরকার লবণযুক্ত চামড়ার দাম বাড়ানোর ফলে কিছুটা লাভবান হবেন পোস্তার ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মি. খান বিবিসি বাংলাকে বলেন, “গত বছর আমরা চামড়া কিনেছি ১ লাখ ১৮ হাজার পিস। এবার আমাদের ১ লাখের পিসের বেশি কেনা যাবে না বলেই মনে হচ্ছে”। কোরবানির পশুর এই চামড়া অনেকেই দাতব্য প্রতিষ্ঠান, মাদ্রাসা কিংবা এতিমখানায় দান করেন। এই চামড়ার টাকা দিয়ে এতিম শিশুদের ভরণ পোষণও চলে। চামড়া সঠিক দামে বিক্রি করতে না পারলে দুশ্চিন্তায় পড়েন বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠানও।
এদিকে, শিল্প মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জাকিয়া সুলতানা বলেছেন, দেশে চামড়ার সুষ্ঠু ও পরিবেশবান্ধব সংরক্ষণের জন্য চট্টগ্রামে একটি ও ঢাকায় একটি সিইটিপি নির্মাণ করা হবে। গত ১৮ জুন ঢাকার সাভারের হেমায়েতপুরের বিসিক চামড়া শিল্পনগরী পরিদর্শনের সময় সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন তিনি।
সিনিয়র শিল্প সচিব বলেন, দেশে প্রতি বছর ঈদুল আজহায় কমপক্ষে এক কোটি পশু কোরবানি হয়ে থাকে। তাছাড়া সারাবছর আরও এক কোটি পশুর চাহিদা রয়েছে। এ কারণে এসব সিইটিপি নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এবারের পবিত্র ঈদুল আযহায় চামড়া সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা অনেক বেশি পরিবেশবান্ধব হয়েছে উল্লেখ করেন জাকিয়া সুলতানা। পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে সারাদেশ থেকে আগত চামড়া সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা ও চামড়া শিল্প সংক্রান্ত টাস্কফোর্স কমিটির নির্দেশনা যথাযথভাবে প্রতিপালিত হচ্ছে কি না তা সরেজমিনে তদারকির তার এ পরিদর্শন বলে জানান। বলেন, অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এবার চামড়া সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা অনেক বেশি পরিবেশবান্ধব হয়েছে। চামড়া শিল্পখাতের উন্নয়নে সুপারিশ প্রদান ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের লক্ষ্যে গঠিত টাস্কফোর্স’ এবং শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নিবিড় মনিটরিং ও তদারকির কারণে এটি সম্ভব হয়েছে।
চামড়া শিল্পখাতের উন্নয়নে সরকারের পদক্ষেপগুলো প্রশংসাযোগ্য। তবে এ খাতে নিয়মিত তদারকি অব্যাহত রাখতে হবে।