প্রতিবছর পবিত্র ঈদুল আজহা এলে আলোচনায় আসে চামড়া নিয়ে অবহেলার কথা। ন্যায্যমূল্য না পেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। কোরবানি সামর্থ্যবান লোকের জন্য ফরজ হলেও চামড়ার হিস্যা গরীব ও দুঃখী জনগণের। চামড়ার উপর নির্ভর করে চলে দেশের মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা। অথচ এবছর সহ গত ১০–১৫ বছরে দেশে কাঁচা চামড়ার ন্যায্য মূল্য পাওয়া যাচ্ছে না। কোন কোন বছর দাম না পেয়ে চামড়া ডাস্টবিনে ফেলে দিতে হয়েছে। প্রশ্ন হলো কেন দেশে পশু চামড়ার প্রতি এতো অবহেলা? অথচ চামড়া ও চামড়ার পণ্য রপ্তানি করে দেশে অর্থনৈতিক রিভুলেশন হতে পারতো। রপ্তানির ক্ষেত্রে পোশাকশিল্পকে পিছনে ফেলতে পারতো চামড়াশিল্প।
বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের কাঁচামাল তুলা, কাপড়, অন্যান্য এক্সেসরিজ বিদেশ থেকে এনে পোশাক তৈরি করে ফিনিস প্রোডাক্ট হিসাবে বিদেশে রপ্তানি করে। এতে দেশে মূল্য সংযোজিত হয়। কিন্তু চামড়া শিল্পের কাঁচামাল কাঁচা চামড়া দেশেই উৎপাদিত হয়, যার গুণগত মান বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় ভালো। আমদানি নির্ভর পোশাক খাত সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাতে পরিণত হয়েছে। ফলে বাংলাদেশ আজ পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বে দ্বিতীয় শীর্ষ দেশ। অথচ রাষ্ট্রীয় অবহেলা ও অদূরদর্শিতার কারণে দেশে উন্নত মানের কাঁচা চামড়ার বিপুল সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও চামড়াশিল্প বিকশিত হতে পারেনি। যা সত্যিই দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক।
বাংলাদেশ থেকে ২০২২–২৩ অর্থবছরে ৪,৬৯৯ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। যার জন্য ১,৫৯৯ কোটি ডলারের তুলা, সুতা, কাপড় ও অন্যান্য সরঞ্জামসহ কাঁচামাল আমদানি করতে হয়েছে। অন্যদিকে দেশে পর্যাপ্ত কাঁচামাল থাকার পরও চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি মাত্র ১২২ কোটি ডলার। অথচ এ সময় চামড়াজাত পণ্যের বৈশ্বিক বাজার ছিল প্রায় ৪৬৮ বিলিয়ন বা ৪৬,৮০০ কোটি ডলারের। অর্থাৎ চামড়ার বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশের হিস্যা মাত্র ০.২৬%।
জানা যায়, বিপুল সম্ভাবনা থাকার পরও দেশীয় চামড়াশিল্পের বিকাশ না হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হলো চামড়াশিল্পের কমপ্লায়েন্স (দূষণমুক্ত ও উন্নত কর্মপরিবেশ) অর্জন করতে না পারা। আর এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা সাভারের চামড়া শিল্পে স্থাপিত সিইটিপি‘র সক্ষমতা ও এর মান। এই সিইটিপি মানসম্পন্ন ও কার্যকর করা গেলে চামড়া শিল্পে সুদিন ফিরে আসবে। সিইটিপি‘টি তৈরি করেছিলো সরকারি প্রতিষ্ঠান বিসিক, তারা সেটি মানসম্পন্নভাবে তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে। সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করলেও কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে একটি মানসম্পন্ন ও কার্যকর ইটিপি তৈরি না করা সত্যিই বিষ্ময়কর।
এদিকে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) এক গবেষণা অনুসারে, চামড়া শিল্পে কমপ্লায়েন্স অর্জন করতে না পারার উল্লেখযোগ্য কারণ হলো, সাভারের চামড়াশিল্প নগরীতে কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগারের (সিইটিপি) সক্ষমতার অভাব। কমপ্লায়েন্স সম্পর্কে ট্যানারিমালিকদের যথাযথ ধারণা না থাকা। কঠিন বর্জ্যের অব্যবস্থাপনা ও ট্যানারির অভ্যন্তরীণ পরিবেশের মান উন্নত না হওয়া। এসব কারণে চামড়াশিল্পের মানসনদ প্রদানকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ (এলডব্লিউজি) থেকে স্বীকৃতি পাচ্ছে না সাভারের ট্যানারিগুলো। ফলে দেশে প্রক্রিয়াজাত চামড়া ইউরোপের বদলে চীনের বাজারে কম দামে রপ্তানি করতে হচ্ছে।
দেশের চামড়াশিল্প কমপ্লায়েন্সের ক্ষেত্রে এত পিছিয়ে আছে যে, বাংলাদেশে এলডব্লিউজি সনদপ্রাপ্ত ট্যানারির সংখ্যা মাত্র ৬। অথচ ভারতে ১৩৯, চীনে ১০৩, ইতালিতে ৬৮, ব্রাজিলে ৬০, তাইওয়ানে ২৪, স্পেনে ১৭, দক্ষিণ কোরিয়া ১৬, তুরস্কে ১৬ ও ভিয়েতনামে ১৪টি।
জানা যায়, দেশীয় কাঁচা চামড়ার পর্যাপ্ত জোগান থাকা সত্ত্বেও রপ্তানিমুখী দেশীয় চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনকারী কারখানাগুলো বছরে প্রায় ১,০০০ কোটি টাকার এলডব্লিউজি সনদপ্রাপ্ত ফিনিশড চামড়া আমদানি করে, যা কারখানাগুলোর প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে। কারণ বিশ্বের বড় ব্র্যান্ডগুলোর কাছ থেকে চামড়াজাত পণ্যের অর্ডার নিলে তারা এলডব্লিউজি সনদ থাকা প্রতিষ্ঠানের চামড়া দিয়ে পণ্য বানানোর শর্ত দিয়ে থাকে। পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে একদিকে কাঁচা চামড়ার উপযুক্ত মূল্য না পেয়ে বঞ্চিত হচ্ছেন চামড়া ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে এতিমখানা, মাদ্রাসা ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষেরা, আর অন্যদিকে দেশীয় চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানিকে বিদেশ থেকে এলডব্লিউজি সনদপ্রাপ্ত চামড়া আমদানি করতে হচ্ছে।
চামড়াশিল্পের দূষণের সমস্যা দীর্ঘদিনের। হাজারী বাগে থাকাকালে ট্যানারিগুলো প্রতিদিন প্রায় ২১,৬০০ ঘনমিটার তরল বর্জ্য পরিশোধন না করেই সরাসরি বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলত। বুড়িগঙ্গা নদীর দূষণ কমাতে শিল্প মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এবং বিসিকের তত্ত্বাবধানে সাভারের হেমায়েতপুরে ১,০৭৯ কোটি টাকা ব্যয়ে গড়ে তোলা হয় চামড়া শিল্পনগর। যার মধ্যে ৫৪৭ কোটি টাকা ব্যয় করা হয় কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) নির্মাণে। ২০১৭ সালে রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে ট্যানারিগুলো সাভারের চামড়াশিল্প নগরে সরিয়ে নেওয়া হলেও এ শিল্প দূষণমুক্ত হয়নি। বিপুল অর্থ ব্যয়ে দুই বছরের বদলে নয় বছরে নির্মিত সিইটিপি চামড়াশিল্পের সব ধরনের বর্জ্য পূর্ণমাত্রায় পরিশোধনে সক্ষম নয়।
এ বিষয়ে বিডার প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক সিইটিপির তরল বর্জ্য পরীক্ষা করে নির্গত তরল বর্জ্যের অনেকগুলো প্যারামিটার পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা ২০২৩–এর নির্ধারিত মানমাত্রার চেয়ে বেশি পাওয়া গেছে। প্যারামিটারগুলো হলো সিওডি, টিডিএস, বিওডি, ক্রোমিয়াম, ডিও, টিএসএস ইত্যাদি। তাছাড়া সিইটিপির দৈনিক পরিশোধনের ক্ষমতা ২৫,০০০ ঘনমিটার বলা হলেও ২০১৯ সালে এলডব্লিউজি কর্তৃক চালানো এক পরীক্ষায় প্রকৃত পরিশোধনের ক্ষমতা পাওয়া যায় মাত্র ১৪,০০০ ঘনমিটার। অথচ চামড়াশিল্প নগরীতে অবস্থিত ট্যানারিগুলোর উৎপাদনক্ষমতা দৈনিক সর্বোচ্চ ৭৬৬ টন ওয়েট ব্লু এবং ১৪২ টন ক্রাস্ট/ফিনিশড লেদার। সে হিসাবে পানি (মান অনুযায়ী) ব্যবহৃত হলে দৈনিক প্রায় ২২,০০০ ঘনমিটার তরল বর্জ্য উৎপাদন হওয়ার কথা। তা ছাড়া পবিত্র ঈদুল আজহার পরবর্তী ৩ মাসে দৈনিক ৪০,০০০ ঘনমিটার তরল বর্জ্য উৎপাদিত হয়। তখন সিইটিপির সক্ষমতার অতিরিক্ত তরল বর্জ্য সারফেস ড্রেনের মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী ধলেশ্বরী নদীতে ফেলা হয়। কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াকরণে ব্যবহৃত বিষাক্ত ভারী ধাতু ক্রোমিয়াম পরিশোধনের জন্য যে কমন ক্রোমিয়াম রিকভারি ইউনিট স্থাপন করা হয়েছে সেটাও কার্যকর নয়।
এ ছাড়া সাভারের চামড়াশিল্প নগরে দৈনিক ২০০ মেট্রিক টন কঠিন বর্জ্য বের হয়। কিন্তু কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য স্লাজ পাওয়ার জেনারেশন সিস্টেম (এসপিজিএস) না থাকায় উৎপাদিত কঠিন বর্জ্য অস্বাস্থ্যকর ও অনিরাপদভাবে ৬ একর আয়তনের একটি ডাম্পিং জোনে গর্ত করে জমা করা হয়। ফলস্বরূপ চামড়াশিল্পের কারণে বুড়িগঙ্গার বদলে সাভারের ধলেশ্বরী নদী দূষিত হচ্ছে এবং চামড়াশিল্প পরিবেশবান্ধব সার্টিফিকেট এলডব্লিউজি পাচ্ছে না। তবে এলডব্লিউজি সনদ না পাওয়ার ক্ষেত্রে ট্যানারিমালিকদের দায়ও রয়েছে। কিন্তু ট্যানারি শিল্প নগরীর সমস্যাগুলো সমাধান করলে ট্যানারি মালিকদেরকে চাপ সৃষ্টি করে সেগুলো করতে বাধ্য করা যাবে।
বর্তমান সরকার বিদেশী বিনিয়োগ আনার জন্য একাট্টা হয়ে চেষ্টা করছে। যদিও এখনো উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ আসেনি। বিদেশি বিনিয়োগের পাশাপাশি সরকার চামড়া শিল্পের কমপ্লায়েন্সের সমস্যা সামাধানের জন্য জরুরি ভিত্তিতে সঠিক মানসম্পন্ন একটি ইটিপি নির্মাণ করতে পারে। এতে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের চামড়ার দাম এক লাফে দ্বিগুণ হয়ে যাবে। অন্যদিকে যেহেতু কোরবানির চামড়ার বেশিরভাগ সংগ্রাহক হলো দেশের মাদ্রাসাগুলো। তাই মাদ্রাসার লোকজনকে চামড়ার প্রাথমিক প্রক্রিয়াজাত করার প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারে। প্রয়োজনে মাদ্রাসাগুলোকে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার প্রধান উপকরণ লবণ বিনামূল্যে সরবরাহের ব্যবস্থা করতে পারে। আর মাদ্রাসাগুলো প্রাথমিকভাবে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে পারলেও কাঁচা চামড়া রপ্তানির ব্যবস্থা করলে, চামড়ার ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। অন্যদিকে মানসম্পন্ন ইটিপি স্থাপনের প্রেক্ষিতে ট্যানারিগুলো এলডব্লিওজি সনদপত্র পেয়ে গেলে এই শিল্পে বিদেশী বিনিয়োগের বিশাল সুযোগ সৃষ্টি হবে। আর এতে দেশের চামড়া শিল্পে বিপ্লব সাধিত হবে–এটি নিশ্চিত!
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট