প্রকৃতপক্ষে ভারতে ব্রিটিশ শাসন ও পাশ্চাত্যের সাহিত্য সংস্কৃতি ও শিক্ষার আগমনের ফলে এ দেশের সমাজজীবনে ধীরে ধীরে যে পরিবর্তন সাধিত হয়েছে তার প্রভাবে আমাদের লোকসংস্কৃতিতে ঘটেছে রূপান্তর। সমাজ বদলের সঙ্গে সঙ্গে রুচিরও পরিবর্তন হয়েছে। সংস্কৃতির রূপান্তরের কারণে তখনকার অনেক লোকসম্পদও ক্রমে বিলুপ্ত হয়েছে। তার পরেও এখনো যা রয়েছে তার জন্য বাংলাদেশ তথা বৃহত্তর চট্টগ্রামবাসী গর্ব করতে পারে।
মাইজভাণ্ডারি গান, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান, গ্রাম চট্টলার জনমানুষের জীবন চিত্র সম্বলিত গান এখনো দেশ বিদেশের রসিক মনকে মোহিত করে।
ষাটের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস, বাষট্টির ছাত্র আন্দোলন, পঁয়ষট্টির পাক– ভারত যুদ্ধ, পাকিস্তানি শাসনামলে বাঙালি সংস্কৃতির উপর চরম আঘাত এসব কোন কিছুই সেই বাংলার গ্রামাঞ্চলের মানুষের আনন্দ উৎসব পরম বিনোদনের বৈশাখী মেলা উপলক্ষে আয়োজিত সকালে গরুর লড়াইও বিকালে বলি খেলা (ঢোলের বাজনার সাথে সাথে বলীদের অসাধারণ দেহ ভঙ্গীমার নৃত্য আহা চোখ, মন, প্রাণ জুড়িয়ে যায়) রাতের ভ্যারাইটি শো, যাত্রাভিনয়, নাটক, কবিগানের আসর, সার্কাস, নৃত্যানুষ্ঠানের আয়োজনে কোন প্রকার বিঘ্ন বা প্রভাব ফেলতে পারেনি, বরঞ্চ কখনো কখনো স্কুল কলেজের তহবিল সংগ্রহে এসব অনুষ্ঠানের আয়োজন আরো জৌলুসপূর্ণ ও উৎসবমূখর হয়ে ওঠেছে।
আমাদের কক্সবাজার, চকরিয়া, পেকুয়া অঞ্চলে এ বৈশাখী মেলার সব মনোরঞ্জক উপাদানকে স্থানীয় লোকজন বলে ‘টঅশা‘ যার অর্থ তামাশা। কারণ গান, বাজনা, নৃত্য, অভিনয়ের পাশাপাশি এখানে থাকতো হাস্যরসাত্মক বহু উপাদান। হাস্যরসাত্বক পেট ফাটানো কৌতুক, হাসির রম্য গল্প, বিবিধ চুটকি যা জনগণ মন ভরে উপভোগ করতো।
এ অনুষ্ঠানগুলি সুপ্রাচীন কাল থেকে এ দেশের গ্রামাঞ্চলের আকাশ বাতাসকে মুখরিত করে রাখতো।
এ সকল অনুষ্ঠান বিশেষত চট্টগ্রামের লোকজীবনে বিনোদনের এক অত্যন্ত আকর্ষণীয় মাধ্যম হিসেবে গত শতকের শেষার্ধের মাঝামাঝি পর্যন্ত বিরাজমান ছিল। সমাজের জমিদার, স্থানীয় বিত্তশালী ও প্রতিপত্তিশালীরা গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে এ সকল বিষয়ের আয়োজন করত এবং আপামর জনসাধারণ তা উপভোগ করত।
যুদ্ধ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রভৃতির কারণে সেবার বৈশাখী মেলা না বসার শঙ্কা থাকলেও বাবার (দক্ষিণ চট্টগ্রাম তথা কক্সবাজারের বৃহত্তর চকরিয়ায় আমার বাবার নামে ‘রাজামিয়ার বলিখেলা’ বসত আড়ম্বরপূর্ণভাবে। প্রতিবছর মানুষ যে জন্য আশা ও আগ্রহ নিয়ে মন বেঁধে অপেক্ষায় থাকতো) এত বছরের ঐতিহ্যবাহী মেলা, বলিখেলা অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিলেন বাবা পাক–ভারত যুদ্ধ থামার পর পহেলা ও দোসরা বৈশাখ। সঙ্গে ঐতিহ্যগতভাবে চাচারাও ঘোষণা দিলেন রাতের ভ্যারাইটি শো ও নাট্যানুষ্ঠানের।
শহর থেকে আসবে কণ্ঠশিল্পী, নৃত্যশিল্পী, নায়িকা, ঘোষক ঘোষিকা, অভিনয় শিল্পী, মাইক মিউজিশিয়ান, হ্যাজাক লাইট সহ স্টেজ সাজানোর সামগ্রী, রূপকার বা মেকাপ ম্যান।
সে এক সাজ সাজ রব! চতুর্দিকে ঢোল পিটিয়ে সংবাদ প্রচার করা হতো যা বরাবরের মত প্রতি বছর হয়।
বিরাট প্যান্ডেল করা হল। একপাশে টিকেট কাউন্টার অন্য পাশে গ্রীণ রুম। পুরুষ মহিলা আলাদা আলাদা বসার ব্যবস্থা। গণ্যমান্য ব্যক্তিদের জন্য সোফা চেয়ার, অন্য সবাই খড় বিছিয়ে মাটিতে।
আমরা সন্ধ্যার আগে আগেই খেয়ে ধেয়ে ছুটে এলাম সামনে বসার জন্য। বিশাল স্টেজ কালো পর্দায় ঢাকা। মিউজিক বাজতে শুরু করেছে হারমোনিয়াম, বাঁশী, ঢোল, তবলার সুরধ্বনি। এখনই শুরু হবে বুঝি। মাইকে বার বার টিকেট সংগ্রহ করার ঘোষণা আসছে।
শহর থেকে এসেছে নামী দামি শিল্পীরা, সুমধুর গান, রুমঝুম নাচ, মন ভোলানো অভিনয়।
অনুষ্ঠান জমে উঠেছে প্যান্ডেলে ঠাঁই নেই। ঘোষণা আসল কিছুক্ষণের মধ্যে শুরু হবে আজকের নাটক ‘সিরাজউদদৌলা’। এখন আসছে আজকের প্রধান আকর্ষণ চট্টগ্রামের সেরা নৃত্যশিল্পী, সবার মনমাতানো শিল্পী আলম আরা (বর্তমানে চট্টগ্রাম বেতার ও টেলিভিশনের তবলাবাদক আরজুর মা সে তখন কোলের ছোট্ট দুধের বাচা)।
প্রথমেই শুরু হল মিউজিকের সাথে কোমর দুলিয়ে নাচ। নাচ থামিয়ে ধরলেন গান।
‘চান মুখে মধুর হাসি ও ভাই
চান মুখে মধুর হাসি
দেবাইল্যা বানাইলরে মোরে
সাম্পানর মাঝি।’
এ কী গান! কী কথা! কী সুর। পুরো প্যান্ডেলের লোকজন তো অবাক! গানের স্থায়ী গেয়ে আবার কোমর দুলিয়ে নাচ।
পরের অন্তরা,
‘কুতুবদিয়ার দক্ষিণ পারদ্দি সাম্পান ওয়ালার ঘর
লাল বরটাগান দিয়েরে তুলি সাম্পানর উয়র
বাহার মারি যারগই রে সাম্পান
ন মানের উজান ভাটি অ ভাই
ন মানের উজান ভাটি।’
আবার মুখটা গেয়ে নাচ। সারা প্যান্ডেলময় টালমাটাল অবস্থা!
দ্বিতীয় অন্তরা,
‘রে ও সাম্পানওয়ালা ভাই
আই ত গরীবর মাইয়া অংগে পইসা নাই
পার গরি দ অ মাঝি ভাই
কুলে যাই জানে বাঁচি ।।’
সে এক অবিস্মরণীয় অবস্থা। কারণ এ গান আগে কেউ শোনেনি। পর দিন থেকে লোকের মুখে মুখে এ গান বাজতে লাগল।
আজ বুঝি, সাম্পানের মাঝির ভালোবাসায় বিবাগী হয়ে কোন এক অবলা নারী গৃহ ত্যাগ করেছে, হয়েছে মাঝির চাঁদের মুখের মধুর হাসিতে দেওয়ানা।
চট্টগ্রামের বিশিষ্ট গায়ক মোহাম্মদ নাসিরের রেকর্ড করা গানটি বাজলে এক সময় যে কোন চট্টগ্রামীকে উদাস হতে দেখেছি। এ এক প্রেম ও বিরহ মিশ্রিত গান। যা প্রথম মানের চট্টগ্রামের আঞ্চলিক লোক সংগীতের নিদর্শন।
আজ অবধি জনপ্রিয়তায় ও গ্রহণযোগ্যতায় গ্রামে গঞ্জে, সর্ব সাধারণের কাছে, সজ্জন সমাজ, সুশীল সমাজ, বিদ্ধৎ সমাজ, চট্টগ্রামের সর্ব স্তরের মানুষের কাছে এ গানের একটুও ছেদ পড়েনি। সকল প্রকার অনুষ্ঠানে এ গান অবলীলাক্রমে গাওয়া যায়। যে গানের প্রতিটি শব্দে, লাইনে, পদে মোহনীয় এক আবেগ জড়িয়ে আছে।
ড. আবুল কাশেম শিল্প সাহিত্য বিষয়ক পত্রিকা কালধারা’র চট্টগ্রামের সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চা‘ , চতুর্দশ সংখ্যা, ভাদ্র ১৪১৩, সেপ্টেম্বর ২০০৬, পৃঃ ৫৩ এ চট্টগ্রামের লোকসংগীত‘ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ‘এ সমস্ত গানে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ চট্টগ্রামী জীবন ও সমাজের বৈচিত্র্যপূর্ণ ছবি ধরা পড়েছে। চট্টগ্রামের প্রকৃতি, জীবনজীবিকা, প্রবাসী স্বামীর বিরহে কাতর রমণীর বিলাপ, শ্বশুর বাড়ির স্নেহবঞ্চিত বধুর বেদনাসহ নানা বিষয় প্রতিপাদ্য হয়েছে। গানগুলো এ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা, জীবনের নানা অবস্থা, সমস্যা, প্রেম বিরহ, আধ্যাত্মিক চিন্তা ভাবনা, ধর্মীয় ভাবনা যাবতীয় অবস্থার পরিচয় বহন করে।’
আমরা আমাদের অনুসন্ধানে, গবেষণায়, আলোচনায়, শিল্পী মোঃ নাসিরের পরিবারের জীবিত পুত্র কণ্যা সহ চট্টগ্রামের সংগীতানুরাগীদের সাথে আলাপকালে, বেতারের রেকর্ড থেকে জানতে পারি এ গানের গীতিকার/রচয়িতা হল– আহমুদুল হক সিদ্দিকী, সুর ও শিল্পী– মোঃ নাসির। ১৯৩২ সালে কলকাতায় জগন্ময় মিত্রের তত্ত্বাবধানে এইচএমবি থেকে প্রথমবারের মত দুটি মাইজভাণ্ডারি গান রেকর্ড করে অসম্ভব সাফল্যের পর ১৯৩৪ সালে এ গান রেকর্ড করা হয়। এটি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের গীতিকার প্রথম রেকর্ডকৃত গান। (তথ্য সূত্র উইকিপিডিয়া নিউজ জি ,ডেস্ক, গুগল নিউজ)
চট্টগ্রামের কালজয়ী লোকসংগীতশিল্পী মোঃ নাসিরের পর অনেকে এ গান রেকর্ড করেছে, অনেক কোম্পানি ক্যাসেট বের করেছে, বিভিন্ন মিডিয়া ও টিভিতে অনেক শিল্পী গাইছে। কিন্তু এটা কী অবজ্ঞা, হীনম্মন্যতা, অজ্ঞানতা নাকি চৌর্যবৃত্তি নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ–ই এ গানের গীতিকার বা রচয়িতা, সুরকার ও মূল শিল্পীর নাম কোথাও উল্লেখ করেনি শ্রদ্ধার সাথে। এটা শিল্পীর গুণের অংশ নয়।
যেমন আঞ্চলিক গানের সম্রাজ্ঞী খ্যাত শেফালী ঘোষের গাওয়া এ গানের গীতিকার ও সুরকারের নাম আছে আব্দুল গফুর হালি যা আমাদের বিশিষ্ট তালাবাদ্যকার অভিজিত্ চক্রবর্তী র সংগীতায়োজনে বংগ বিডি কর্তৃক প্রকাশিত।
সোলসের ক্যাসেট ‘মানুষ মাটির কাছাকাছি’ ভলিউম– ৩ এ তপন চৌধুরীর গাওয়া এ গানর গীতিকারের নাম দিয়েছে শহীদ মাহমুদ জংগী ও সুরকার– আইয়ুব বাচ্চু।
রবি চৌধুরী, অর্ণব ও পান্থ কানাই গীতিকার, সুরকার ও মূল শিল্পী কারো নামোল্লেখ না করে বাংলার ফোক নামে চালিয়ে দিয়েছে।
বেলী আফরোজ গীতিকার, সুরকার, মূল শিল্পী কারো নামোল্লেখ করেনি। বুল বুল আকতার, হেমন্তী রক্ষিত, সন্দীপন দে, সেলিম নিজামী কথাও সুর – মোঃ নাসির উল্লেখ করলেও মূল গায়কের নাম বলে নি। সেলিম চৌধুরী বাংলার ট্র্যাডিশনাল ফোক বলে চালিয়ে দিয়েছেন। শেখ দীনা বৈষ্ণবী নামে একজন শৌখিন শিল্পী শুধু আহমুদুল হক সিদ্দিকীর রচনা এ গান বলে গেয়েছে।
এ রকম ‘গান কবি বাংলাদেশের থিয়েট্রিক্যাল ফোক ব্যান্ড’ বেসুরো গায়েন সুরো বায়েনের দল, এম জেড নুর, লালন শিল্পী আরো অনেকে গীতিকার, সুরকার, মূল শিল্পীর নাম না জেনে, উল্টাপাটা কথায়, সুরে বিকৃতিতে গেয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।
আমাদের কন্ঠ শিল্পীদের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি গানের গীতিকার বা রচয়িতা, সুরকার, মূল শিল্পী খবর নিন। পরিবেশনার আগে সম্মানের সাথে তাদের নাম প্রকাশ করুণ ঘোষণা দিন। নিজের সম্মান ও ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে এর বড়ই প্রয়োজন। না জানলে জানা লোকদের কাছ থেকে জেনে নিন। বাংলা ফোক, ট্র্যাডিশনাল ফোক বা সংগ্রহ বলে রচয়িতা, সুরকার, গায়কের পরিশ্রমকে অবজ্ঞা বা হেয় করবেন না। এতে নিজের অবমাননা হয়। এখনই এ প্রথা চালু করা প্রয়োজন।
লেখক: প্রাবন্ধিক, লোক সংগীত শিল্পী ও গবেষক।