চাটগাঁইয়া গানের ‘রসিক তেলকাজলা’ আবদুল গফুর হালী

নাসির উদ্দিন হায়দার | শুক্রবার , ৩ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৭:০৬ পূর্বাহ্ণ

জিলা চট্টগ্রাম রে বারউলিয়ার স্থান

এই জিলাতে জন্ম কত আউলিয়া মস্তান রে।

শাহ বদর জ্বালাই বাতি

ধাইয়া গেল দানব জাতি

চাটি দিয়া আবাদ করে

চাটগাঁ হল নাম রে ॥

তিনি আছেন পূণ্যভূমির মাটিজলহাওয়ায়, আছেন মাঝির সাম্পান বাওয়ায়, কর্ণফুলীশঙ্খের স্রোতধারায়। অঘ্রাণের ভরা ক্ষেতে চাষির কণ্ঠে, শঙ্খের বাঁকা জলে মাঝির কণ্ঠে শোনা যায় তাঁর গান

তুঁই যাইবা সোনাদিয়া বন্ধু মাছ মারিবল্লাই

তোঁয়ারে ছাড়া হাইল্যা ঘরত কেনে থাইক্কম আঁই॥’

এখনো নিশিথে বিরহী নারীর বিলাপ হয়ে বাজে-‘ও শ্যাম রেঙ্গুম নঅ যাইওরে/হনে হাইব রেঙ্গুমর কামাই রে।’

কথা আর সুরের এই জাদুকরের নাম আবদুল গফুর হালীতিনি চাটগাঁইয়া গানের অন্যতম প্রধান রূপকার। বস্তুত, গফুর হালী হলেন চট্টগ্রামের আঞ্চলিক, মাইজভাণ্ডারী গানে নবযুগের স্রষ্টা। তিনি ‘চট্টগ্রামের স্বতন্ত্র সংগীতধারা ‘মোহছেন আউলিয়ার গানের’ জনক এবং চট্টগ্রামের ভাষায় লেখা আঞ্চলিক নাটকের পথিকৃৎ রচয়িতা।

এখনো নাগরিক মনকে উদাস করে গফুর হালীর সেই গান,

মনের বাগানে ফুটিল ফুলরে

রসিক ভ্রমর আইল না

ফুলের মধু খাইল না’॥

এখনো সব মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যায় শেফালী ঘোষের গাওয়া গফুর হালী রচিত সেই চিরসবুজ গান

রসিক তেলকাজলা

ওই লাল কুর্তাওয়ালা

দিল বড় জ্বালা রে পাঞ্জাবিওয়ালা॥’

২০১৬ সালের ২১ ডিসেম্বর চাটগাঁইয়া সংগীতের বরপুত্র আবদুল গফুর হালী চিরবিদায় নিয়েছেন। বড় দুঃখের বিষয়, এখনো চাটগাঁইয়া গানের এই কিংবদন্তীর রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো মূল্যায়ন হলো না। শেফালী ঘোষ ও শ্যামসুন্দর বৈষ্ণবের পর একুশে পদক পাওয়ার মতো একজন গুণী সংগীতজ্ঞ গফুর হালী। অতীতে একুশে পদকের জন্য কয়েকবার তাঁর নাম আলোচনায় এলেও বারবার বঞ্চিত হয়েছেন। আমাদের আশা, সরকার গফুর হালীকে একুশে পদকে ভূষিত করে চট্টগ্রামবাসীকে সম্মানিত করবে।

গাইতে গাইতে গায়েন : আবদুল গফুর হালী বলতেন, তিনি গাইতে গাইতে গায়েন, তাঁর যা কিছু সৃষ্টিগান, তা সবই মাইজভাণ্ডারের দান। সেই মাইজভাণ্ডারী ও মরমী গানে আবদুল গফুর হালী গড়েছেন ‘অলৌকিক ভালোবাসার এক অপরূপ শিল্প’। খ্যাতিমান শিল্পী কল্যাণী ঘোষের গাওয়া গফুর হালীর সেই মাইজভাণ্ডারী গান ‘দেখে যারে মাইজভাণ্ডারে হইতেছে নুরের খেলা’ কিংবা মোহছেন আউলিয়ার গান ‘চলরে জিয়ারতে আউলিয়া দরবার/মোহছেন আউলিয়া বাবার বটতলী মাজার’শিমুল শীলের কণ্ঠে আলোড়ন তুলে সারা বাংলায়। ‌‌‌ মোহছেন আউলিয়ার গানএর প্রধানতম স্রষ্টা কিন্তু গফুর হালীই।

১৯৫৫/৫৬ সাল থেকে ২০১৬, দীর্ঘ ৬০ বছরের সাধনায় আবদুল গফুর হালী প্রায় আড়াই হাজার গান লিখেছেন, এর মধ্যে মাইজভাণ্ডারী, মরমী ও পীর আউলিয়ার গানের সংখ্যা প্রায় দেড় সহস্রাধিক। আর চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের সংখ্যা সহস্রাধিক।

গফুর হালীর সংগীতজীবনের বড় কীর্তি হলো আস্কর আলী পণ্ডিত, কবিয়াল রমেশ শীল, খায়েরজ্জামা পণ্ডিতসহ চাটগাঁইয়া গানের মহত্তম রূপকারদের কাব্য ও গান প্রচার। এতে করে সুধী সমাজের কাছে এসব শিল্পীর সংগীতপ্রতিভা উন্মোচিত হয়, বিশেষ করে আস্কর আলীর গান ও কাব্য প্রচারে গফুর হালীর অবদান তার উত্তরসূরীরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন।

আবদুল গফুর হালীর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৫টি। ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম গীতিকাব্য ‘তত্ত্ববিধি’, ৮৯ সালে ‘জ্ঞানজ্যোতি’। এরপর সুফী মিজান ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ২০১২ সালে মাইজভাণ্ডারী গান নিয়ে প্রকাশিত হয় গীতিকাব্য ‘সুরের বন্ধন’ (সম্পাদনা : নাসির উদ্দিন হায়দার)। ২০১৪ সালে সুফী মিজান ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে আঞ্চলিক গান নিয়ে মোহাম্মদ আলী হোসেনের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘শিকড়’। এরপর ২০১৫ সালে নাসির উদ্দিন হায়দারের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে ‘আবদুল গফুর হালীর চাটগাঁইয়া নাটকসমগ্র’। ২০১৬ সালে প্রকাশিত হয়েছে মোহাম্মদ মহসিন সম্পাদিত ‘দিওয়ানে মাইজভাণ্ডারী’ বইটি। তিনটি গীতিকাব্যে স্বরলিপিসহ ৩০০ গান স্থান পেয়েছে। সবগুলো বই প্রকাশে আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন পিএইচপি ফ্যামিলির পরিচালক মোহাম্মদ আনোয়ারুল হক।

আবদুল গফুর হালীর গান দেশ ছাড়িয়ে বিশ্বের নানা প্রান্তের সাহিত্যিক ও গবেষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ২০০৪ সালে জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. হান্স হার্দার আবদুল গফুর হালীর জীবন ও কর্ম নিয়ে ‘ডার ফেরুখটে স্প্রিখট’ (পাগলা গফুর বলে) নামে একটি গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। সেই গ্রন্থে গফুর হালীর ৭৬টি মাইজভাণ্ডারী ও মরমী গান জার্মান ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ড. হান্স হার্দার আবুল গফুর হালীর এসব গানকে ‘পূর্ব বাংলার মরমী গান’ বলে সংজ্ঞায়িত করেছেন। হালী সম্পর্কে তিনি লেখেন, ‘আবদুল গফুর হালীর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ ডিগ্রি বা উপাধি না থাকলেও নিজের চেষ্টায় তিনি অসাধারণ জ্ঞানের অধিকারী হতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি নিজেকে শুধু বাংলা সাহিত্যের দিকে সরাসরি ধাবিত করেননি। তাঁর সাহিত্য ও দর্শন সাধনাকে চট্টগ্রামের একটি ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলেন আর তা সেই উৎসবে ক্রমাগত যাতায়াতের মাধ্যমে। প্রায় প্রতিদিনই তিনি মাইজভাণ্ডারী গান রচনা করেন। ভালোবাসার এক অলৌকিক শিল্প তাঁকে টালমাটাল করে তোলে। ঐশ্বরিক এক শক্তি তাঁর নিজস্ব দর্শনকে পরিচালিত করে থাকে।’

বিশ্বখ্যাত সামাজিক নৃবিজ্ঞানী পিটার বার্টুসি আবদুল গফুর হালী সম্পর্কে বলেছেন ‘“Best known maijbhandary composer।’ (সূত্র -Peter J. Bertocci, “Sufi Movement in Bangladesh: The Maijbhandary Tariqa and its Followers”, Contribution to Indian Sociology, Vol. 40, No. 1, 2006, page: 16.)

প্রসঙ্গত, আমেরিকার আটলান্টা এমোরি ইউনিভার্সিটির ভিজিটিং প্রফেসর ড. বেঞ্জামিন ক্রাকাউর অবদুল গফুর হালীর গান নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে গফুর হালীর বাড়িতে আসেন, সেখানে হালীর জীবনদর্শন ও গান আত্মস্থ করেন।

১৯৩২ সালে কলকতার এইচএমভি থেকে জগন্ময় মিত্রের তত্ত্বাবধানে শিল্পী মোহাম্মদ নাসিরের কণ্ঠে প্রথম মাইজভাণ্ডারী গানের রেকর্ড বের হয়। এই রেকর্ডের মাধ্যমে মাইজভাণ্ডারী গান প্রথম বাণিজ্যিক পরিমণ্ডলে প্রবেশ করে। রমেশ শীল ও মোহাম্মদ নাসিরের পর আবদুল গফুর হালী হলেন মাইজভাণ্ডারী গানে নবযুগের স্রষ্টা। গফুর হালী রচিত চিরসবুজ আঞ্চলিক গান হলো ‘ও শাম রেঙ্গুম নঅ যাইওরে’, ‘দিল বড় জ্বালারে পাঞ্জাবিওয়ালা’, ‘মনের বাগানে ফুটিল ফুলরে’, ‘ঢোল বাজের আর মাইক বাজের’, ‘সোনাবন্ধু তুই আমারে করলিরে দিওয়ানা’, ‘বাইন দুয়ার দি ন আইস্য তুই নিশির কালে’, ‘রিকশা চালাও রসিক বন্ধুরে’, ‘ন মাতাই ন বুলাই গেলিরে বন্ধুয়া’, ‘তিন কুইন্যা পানর কিলি’, ‘হারলাই পরান কাঁদে’, ‘তুঁই মুখ কেয়া কইয্য কালা’সহ অসংখ্য গান।

আঞ্চলিক গানের কিংবদন্তী জুটি শেফালী ঘোষ ও শ্যামসুন্দর বৈষ্ণবের অনেক কালজয়ী গানের স্রষ্টা আবদুল গফুর হালী। শ্যামশেফালীর কণ্ঠে গফুর হালী রচিত দ্বৈত গান ‘নঅ যাইও নঅ যাইও/ আঁরে ফেলাই বাপর বাড়িত নঅ যাইও’, ‘বন্ধু আঁর দুয়ারদি যঅ আঁর লয় কথা কেয়া ন হঅ’, ‘তুঁই যাইবা সোনাদিয়া বন্ধু মাছ মারিবল্লাই’, ‘কালিয়া বলে হরতাল গাড়ি ঘোড়া বন’, ‘লাক্কা ওঁনির তরকারি বেশি অইয়ে ঝাল’সহ অনেক গান এখনো মানুষের মুখে মুখে ফেরে।

অন্যদিকে, গফুর হালী রচিত মাইজভাণ্ডারী গান ‘দেখে যারে মাইজভাণ্ডারে হইতেছে নুরের খেলা’, ‘দুই কূলের সোলতান’, ‘আর কতকাল খেলবি খেলা’, ‘নতুন ঘরে যাব আমার/এই ঘরে আর মন বসে না’, ‘নাচ মন তালে তালে মাওলার জিকিরে’, ‘তোরা ভালমন্দ যা খুশি কর’, ‘কোন সাধনে তারে পাওয়া যায়’, ‘আমি আমারে বেইচা দিছি মাইজভাণ্ডারে যাই রে/আমার কিছু নাই’সহ অসংখ্য গান মাইজভাণ্ডারী র্দশন ও আধ্যাত্ম সাধনার অনুপম অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে, পাশাপাশি এসব গান বাংলার আপামর জনসাধারণের সাংস্কৃতিক ক্ষুধা নিবারণ করছে। এছাড়াও, ‘শহীদের মা কাঁদেল্যে বটগাছ তলে বই/বেয়াগ্‌গুনর পোয়া ফিরি আইলো/আঁর পোয়া কই’সহ অনেক দেশাত্মবোধক গানের স্রষ্টা আবদুল গফুর হালী।

মাইজভাণ্ডারী গান দিয়ে গফুর হালীর সংগীতজীবন শুরু হলেও শ্যামসুন্দর বৈষ্ণবের সাথে বন্ধুত্ব তার সংগীতজীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়, তিনি আঞ্চলিক গান লেখা শুরু করেন। পাশাপাশি বেতারের তালিকাভুক্ত গীতিকার ও শিল্পী হিসাবে আবির্ভূত হন। ৬০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে বেতারের আঞ্চলিক পরিচালক (আরডি) আশরাফুজ্জামানের তাগাদায় গফুর হালী শ্যামশেফালীর জন্য প্রথম দ্বৈত আঞ্চলিক গান লিখেন। সেটি ছিল

ন যাইও ন যাইও

আঁরে ফেলাই বাপের বাড়িত ন যাইও (ছেলে),

ন গইজ্য ন গইজ্য

বাপর বাড়িত যাইতাম মানা ন গইজ্য (মেয়ে)।’

বেতারে প্রচারের পর আলোড়ন তুলল এই গানটি। শ্যামসুন্দর বৈঞ্চব ও শেফালী ঘোষের নাম ছড়িয়ে পড়ল হাটেমাঠে। এর আগে মলয় ঘোষ দস্তিদারের ‘নাইয়র গেলে বাবোর বাড়ি আইস্য তারাতারি’সহ দুইএকটা দ্বৈত আঞ্চলিক গান গেয়েছিলেন শ্যামশেফালী। কিন্তু ‘নাইয়র’ গানটির দারুণ জনপ্রিয়তা আঞ্চলিক গানে নতুন ধারা সৃষ্টি করল। প্রতিষ্ঠিত হলো নতুন জুটি শ্যামসুন্দর বৈঞ্চব ও শেফালী ঘোষ। এই একটি গান গফুরের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেলেন তিনিও।

আবদুল গফুরের জন্ম ১৯২৮ সাল, মতান্তরে ১৯২৯ সালের ৬ আগস্ট পটিয়ার রশিদাবাদে। বাবা, আব্দুস সোবহান, মা গুলতাজ খাতুন। লেখাপড়া করেছেন রশিদাবাদ প্রাথমিক বিদ্যালয় ও জোয়ারা বিশ্বম্বর চৌধুরী উচ্চবিদ্যালয়ে। গফুর হালীর ভাষায় তিনি ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে খুব ভালো ফল করলেও উচ্চবিদ্যালয়ে মনোযোগ দিয়ে পড়তে পারেননি, কেবল স্কুলে যাওয়াআসা করেছেন।

রশিদাবাদের পাশেই সাধকশিল্পী আস্কর আলী পণ্ডিতের গ্রাম, নাম হলো শোভনদণ্ডী। আস্কর আলীর গান শুনে বড় হয়েছেন গফুর। ছোটবেলায় তাঁর আধ্যাত্মিক ও মরমী গান গফুরের মনে গভীর প্রভাব ফেলে। তরুণ বয়সে প্রতিবেশীর পাল্লায় পড়ে একদিন আচমকা হাজির হলেন ফটিকছড়ির মাইজভাণ্ডার দরবারে, গানের টানে। সেখানে রমেশ শীল, বজলুল করিম মন্দকীনি, মৌলানা হাদীর মাইজভাণ্ডারীর গান তাঁর মনোজগত বদলে দেয়। লাল পোশাক পরা লোকজন যখন মাইজভাণ্ডারে ঢোল বাজিয়ে নেচে নেচে গাইতেন তখন গফুর আর স্থির থাকতে পারতেন না। তাঁদের সঙ্গে নাচতেন, গলা মেলাতেন। একদিন মাইজভাণ্ডারের ভক্তদের অনুরোধে গাইতে হলো আবদুল গফুরকে।

সেটা ১৯৫৫৫৬ সালের কথা।

গফুর হালী বলেছিলেন-‘মনে হলো আমি যেন আমাকে হারিয়ে ফেললাম মাইজভাণ্ডারের প্রেমবাজারে। অনেকটা পাগলের বেশে গ্রামে ফিরলাম। একটা শব্দই শুধু শুনি আকাশেবাতাসে, কে যেন আমায় বলছে, ‘লেখ লেখ।’ অবশেষে লিখতে বসলাম, গান বাঁধলাম

আর কত কাল খেলবি খেলা

মরণ কি তোর হবে না

আইল কত গেল কত

কোথায় তাঁদের ঠিকানা।

শুরু হলো আবদুল গফুরের গান লেখা ও সুর করা।একটা সময় পীর সৈয়দ শফিউল বশর মাইজভাণ্ডারী আবদুল গফুরকে ‘হালী’ উপাধি দেন।

আবদুল গফুর হালী একজন মহান মুক্তিযুদ্ধের কণ্ঠসৈনিকও। ’৭০ এর নির্বাচনের সময় চট্টগ্রামের লালদীঘি মাঠ ও পটিয়ার রাহাত আলী উচ্চবিদ্যালয় মাঠে বঙ্গবন্ধুর জনসভায় গান গেয়ে বঙ্গবন্ধুর স্নেহাশীষ পেয়েছেন গফুর হালী। সেদিন তিনি গেয়েছিলেন, ‘নৌকা চলে নৌকা চলে/নৌকা চলে হেলেদুলে/এই নৌকা চালায় মুজিবে।’ গফুর হালী সরাসরি রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেননি, তবে ক্যাম্পে গিয়ে গান গেয়ে উদ্দীপ্ত করতেন মুক্তিযোদ্ধাদের। মুক্তিযোদ্ধারা হালীর একটি গান খুব পছন্দ করতেন, সেটি হলো

তোর লয় আঁর লয় ন অইব অভাই

আঁই বাঙালী তুই পাঠান

তোর দেশে আর আঁর দেশে

দুই হাজার মাইল ব্যবধান।’

গফুর হালীর ‘মনের মানুষ’ : পিএইচপি গ্রুপের চেয়ারম্যান সুফী মোহাম্মদ মিজানুর রহমান ও তার পরিবারের বিরল ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন আবদুল গফুর হালী। বলা যায়, গত দুই দশক ধরে শিল্পী গফুর হালীকে লালনপালন এবং তার সৃষ্টির পরিচর্যা করেছেন সুফী মিজান ও তার সন্তানরা। মৃত্যুশয্যায় বসে এই প্রবন্ধের লেখককে সেই কথাই বলে গিয়েছেন গফুর হালী-‘সুফী মিজান না থাকলে আবদুল গফুর হালীর অস্তিত্বও থাকত না। পিএইচপি আমার জন্য আল্লাহর রহমতস্বরূপ।’

প্রসঙ্গত, সুফী মিজান ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ও পিএইচপি ফ্যামিলির পরিচালক আনোয়ারুল হকের পৃষ্ঠপোষকতায় আবদুল গফুর হালীর ৩০০ গানের স্বরলিপিসহ তিনটি গীতিকাব্য ও একটি নাটকসমগ্র প্রকাশিত হয়েছে। পাশাপাশি চট্টগ্রামে প্রথম কপিরাইট সনদ পেয়েছে গফুর হালীর ৩০০ গান ও ছয়টি আঞ্চলিক নাটক। ২০২১ সালের ২৩ জানুয়ারি ঢাকার জাতীয় গ্রন্থাগারস্থ কপিরাইট অফিসের সাবেক রেজিস্ট্রার জাফর রাজা চৌধুরী আবদুল গফুর হালী রিসার্চ সেন্টারের ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মহসিনের হাতে কপিরাইট সনদ হস্তান্তর করেন। এটি চাটগাঁইয়া গানের ইতিহাসে বিরল ঘটনা। ২০১০ সালে সুবর্ণ রেখা পিকচারেরএর ব্যনারে চলচ্চিত্রকার শৈবাল চৌধূরী তাঁকে নিয়ে প্রথম প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন ‘মেঠো পথের গান’। এছাড়া সুফী মিজান ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় পংকজ চৌধুরী রনি নির্মাণ করেন দুটি চলচ্চিত্র। ‘কোন সাধনে তারে পাওয়া যায়’ আবদুল গফুর হালীর জীবন ও গান নিয়ে নির্মিত প্রামাণ্য চলচ্চিত্র । আরেকটি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় রচিত গীতিনাট্য ‘গুলবাহার’। এটিকে চলচ্চিত্রে রূপায়িত করেন পংকজ চৌধুরী রনি। আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন পিএইচ ফ্যামিলির পরিচালক মোহাম্মদ আনোয়ারুল হক।

অন্তিম মুহূর্তে একজন ব্যক্তিকেই কেবল দেখতে চেয়েছিলেন গফুর হালীআর সেইজন হলেন তার ‘ভাবজগতের ভাই’ সুফী মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। জীবনের শেষ কথাটিও সুফী মিজানকেই বলে গেছেন গফুর হালীসেটা তাসওয়াফ জগতের কথা, তাই এখানে উল্লেখের বিষয় নয়।

গফুর হালী ছিলেন দিব্যজ্ঞানী। সংগীতজীবনের শুরু থেকেই তিনি মৃত্যুর আরাধনা করেছেন। তাঁর প্রথম গানটিই ছিল ‘আর কতকাল খেলবি খেলা/মরণ কি তোর হবে না’। পরিণত বয়সেও স্রষ্টার সান্নিধ্য কামনা করেছেন গানে গানে-‘নতুন ঘরে যাব আমার/এই ঘরে আর মন বসে না/ঘরখানা অতি পুরানা।’ শেষবেলায় হৃদয়ের গভীরতম সত্যকে উপলব্ধি করেছেন, মরার আগে মরতে চেয়েছেন, লিখেছেন-‘নাইয়রী নাইয়র হলো শেষ, এইবার চল আপন দেশ।’

গত ২১ ডিসেম্বর ছিল বরেণ্য সংগীতজ্ঞ আবদুল গফুর হালীর তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। বড় দুঃখের বিষয়, এখনো চাটগাঁইয়া গানের এই কিংবদন্তীর রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো মূল্যায়ন হলো না। শেফালী ঘোষ ও শ্যামসুন্দর বৈষ্ণবের পর একুশে পদক পাওয়ার মতো একজন গুণী সংগীতজ্ঞ গফুর হালী। অতীতে একুশে পদকের জন্য কয়েকবার তাঁর নাম আলোচনায় এলেও বারবার বঞ্চিত হয়েছেন। আমাদের আশা, সরকার গফুর হালীকে একুশে পদকে ভূষিত করে চট্টগ্রামবাসীকে সম্মানিত করবে।

লেখক: চাটগাঁইয়া গানের গবেষক ও সাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধযাত্রা
পরবর্তী নিবন্ধআঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম চট্টগ্রামের শীতবস্ত্র বিতরণ