চাচা হত্যার প্রতিশোধ নিতেই খুলনার কাউন্সিলর টিপুকে হত্যা

গ্রেপ্তার তিনজনের স্বীকারোক্তি । নিহত শহীদের ভাতিজা পাপ্পুই গুলি করে । ঋতুকে ব্যবহার করা হয় ‘টোপ’ হিসেবে । লাগেজে বাসের ট্যাগ থেকে ক্লু উদ্ধার

কক্সবাজার প্রতিনিধি | বৃহস্পতিবার , ১৬ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৮:০০ পূর্বাহ্ণ

খুলনার পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা শহীদুল ইসলাম ওরফে হুজি শহীদের হত্যার প্রতিশোধ নিতেই তার ভাতিজা শেখ শাহরিয়ার ইসলাম পাপ্পুর নেতৃত্বেই সংঘবদ্ধ চক্র কক্সবাজারে এসে খুলনা সিটি করপোরেশনের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সদ্য সাবেক কাউন্সিলর ও মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি গোলাম রব্বানী টিপুকে হত্যা করেছে।

পাপ্পুই তাকে গুলি করে। এছাড়া স্থানীয় আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্বও এই হত্যাকাণ্ডে ইন্ধন রয়েছে। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার বিধবা নারী ঋতুকে ‘টোপ’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। তার দেয়া তথ্যে ভিত্তিতেই সঠিক নিশানায় এনে বন্ধু গোলাম রসুলের সহযোগিতায় নিখুঁতভাবে হত্যা নিশ্চিত করেন পাপ্পু। হত্যাকাণ্ডে জড়িত তিনজনের স্বীকারোক্তিতে এসব তথ্য নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ। গতকাল বুধবার সকাল সাড়ে ১১টায় এক সংবাদ সম্মেলনে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. রহমত উল্লাহ এই তথ্য জানান।

পুলিশ সুপার জানান, ২০১৫ সালে খুন হন দৌলতপুরে জ্বালানি তেল ব্যবসায়ী ও পাটশ্রমিক ঠিকাদার শহীদুল ইসলাম ওরফে হুজি শহীদ। এই হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন নিহত কাউন্সিলর গোলাম রাব্বানি টিপু এবং তিনি হত্যা মামলার প্রধান আসামিও। হুজি শহীদের ভাতিজা শাহরিয়ার ইসলাম পাপ্পুর স্বীকারোক্তির উদ্ধৃতি দিয়ে পুলিশ সুপার জানান, হুজি শহীদ ও নিহত টিপু একই এলাকার বাসিন্দা। সে কারণে তাদের মধ্যে আধিপত্যের দ্বন্দ্ব ছিল। সে দ্বন্দ্বের জেরে গোলাম রাব্বানির নেতৃত্বে হুজি শহীদকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নিতে হুজি শহীদের পরিবারের পরিকল্পনায় টিপুকে হত্যা করা হয়েছে।

গত মঙ্গলবার বিকালে মৌলভীবাজার জেলার জুড়ি উপজেলার কাপনা পাহাড়ি চা বাগান থেকে গোলাম রাব্বানি টিপু হত্যাকাণ্ডে প্রধান অভিযুক্ত শেখ শাহরিয়ার ইসলাম পাপ্পুসহ (২৭) তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পাপ্পু খুলনা সিটি করপোরেশনের ৪নং ওয়ার্ড দৌলতপুর দেওয়ানা মোল্লাপাড়া এলাকার জামাল শেখের ছেলে। অন্য দু’জন হলেন, পাপ্পুর প্রতিবেশি মো. সেলিম আকনের মেয়ে ঋতু (২৪) এবং ৬ নং ওয়ার্ডের কেশবলাল সড়কের মধ্য কারিগরপাড়ার হায়দার সরদার অদুদের ছেলে ও পাপ্পুর বন্ধু মো. ছেলে গোলাম রসুল (২৫)। তিনজনকে কক্সবাজারে নিয়ে আসা হয়েছে।

হত্যার নিখুঁত মিশন : শাহরিয়ার ইসলাম পাপ্পু পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তিতে জানান, গোলাম রাব্বানী টিপুকে হত্যা করার জন্য দীর্ঘদিন আগে পরিকল্পনা করেছেন তিনি। এর অংশ হিসেবে গ্রেপ্তার নারী ঋতুকে টোপ হিসেবে ব্যবহারের পরিকল্পনা করে। ঋতুর স্বামী ক্রসফায়ারে মারা যায়। স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে গোলাম রাব্বানীর টিপুর সাথে ঋতুর সখ্যতা গড়ে উঠে। এই সুযোগটি গ্রহণ করে হুজি শহীদের ভাতিজা পাপ্পু। পূর্ব পরিকল্পনা মতো টিপুর অবস্থান কক্সবাজারে নিশ্চিত হয়ে তার সাথে সময় কাটাতে কক্সবাজারে আসার প্রস্তাব দেন ঋতু। সে মতে, ৭ জানুয়ারি খুলনা থেকে ইমপেরিয়াল পরিবহনের বাসে করে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হয় পাপ্পু, তার বন্ধু গোলাম রসুল ও ঋতু। কক্সবাজারে পৌঁছে গোলাম রাব্বানি টিপুর সাথে যোগ দেন ঋতু এবং পাপ্পু ও গোলাম রসুল ওঁৎপেতে থাকে। টিপুর সাথে আগে থেকেই ছিলেন খুলনা সিটি করপোরেশেরন ১৬নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ হাসান ইফতেখার ওরফে চালু। স্বীকারোক্তিতে পাপ্পু জানান, ঋতুর কাছ থেকে টিপুর অবস্থান সম্পর্কে সার্বক্ষণিক তথ্য নেন তারা। ৮ জানুয়ারি সন্ধ্যার পর সৈকতের সুগন্ধা এলাকার হোটেল সীগালের সামনে গোলাম রাব্বানি নির্জন স্থানে অবস্থান নিলে ঋতুর দেয়া তথ্য মতো মোটরসাইকেল নিয়ে দ্রুত সেখানে যান পাপ্পু ও তার বন্ধু গোলাম রসুল। পৌঁছেই সীগালের সামনে ফুটপাতে হাঁটা অবস্থায় টিপুকে মাথায় গুলি করেন পাপ্পু। গুলি করার পর চোখের পলকে তারা ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।

পুলিশ সুপার জানান, খুনের পর ব্যবহৃত অস্ত্রটি তাদের বুকিং করা হোটেল কক্স কুইন রিসোটে ২০৮ নং কক্ষের চিলেকোঠায় রেখে তারা পালিয়ে যান। গ্রেপ্তারের পর তাদের স্বীকারোক্তি মতে ওই স্থান থেকে অস্ত্রটি ও চারটি গুলি উদ্ধার করে পুলিশ। এর আগে ঘটনাস্থল থেকে খোসাটি উদ্ধার হয়। এই হত্যাকাণ্ড ঘটাতে ওই তিনজন কক্সবাজারের স্থানীয় লোকজনের সহযোগিতা নিয়েছেএমন তথ্যও নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ। তবে স্থানীয় কে বা কারা সহযোগি ছিল এবং কি রকম সহযোগিতা করেছে সে সম্পর্কে অনুসন্ধান করছে পুলিশ।

প্রতিশোধের নেশা থেকে টিপুকে হত্যা : ঘাতক পাপ্পুর চাচা ‘পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টি নেতা হুজি শহীদ বেশ প্রভাবশালী ছিলেন। একই ওয়ার্ডে তার কারণে গোলাম রাব্বানি টিপুর সাথে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয় হুজি শহীদের। এর জের ধরে টিপুর নেতৃত্বে হুজি শহীদকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এমন নির্মম হত্যা মানতে পারেনি তার পরিবার। বিশেষ করে ভাতিজা পাপ্পু প্রতিশোধ নিতে বেশ তৎপর ছিলেন। তারই অংশ হিসেবে দীর্ঘ পরিকল্পনার ভিত্তিতে কক্সবাজারে এসে টিপুকে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে হত্যা করেছে। এই হত্যাকাণ্ডে ঋতুকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করেছেন এবং বন্ধু গোলাম রসুলকে সহযোগি হিসেবে ব্যবহার করে পাপ্পু। যদিও পাপ্পু ও গোলাম রসুল নিহত হুজি শহীদের পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির আদর্শে লালিত নয় বলে পুলিশকে জানিয়েছেন। এছাড়া স্থানীয় আধিপত্যকে কেন্দ্র করে টিপুর অন্যান্য শত্রু ও প্রতিপক্ষরাও এই হত্যাকাণ্ডে ইন্ধন ও সহযোগিতা করেছে তথ্য পাওয়া গেছে। এসব বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য পেতে আটক তিনজনের রিমান্ড চাইবে পুলিশ। রিমান্ডে আরো নিখুঁত ও বিস্তারিত তথ্য পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে জানান পুলিশ সুপার।

যেভাবে উদ্ধার হয় ক্লু : ঘটনার ক্লু সম্পর্কে পুলিশ সুপার বলেন, এই হত্যাকাণ্ডটি অনেকটা ক্লুলেস ছিল। যার কারণে রহস্য উদঘাটনে হিমশিম খেতে হয় পুলিশকে। এর মধ্যে ঋতুর কক্ষে পাওয়া যায় তার লাগেজ। সেই লাগেজে গায়ে পাওয়া যায় বাসের ট্যাগযুক্ত একটি স্টিকার। সেই স্টিকারের সূত্র ধরেই ইমপেরিয়াল বাস কাউন্টারসহ কিছু সূত্র ব্যবহার করে সোর্স সৃষ্টি করে পুলিশ। সেই সোর্সের মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডের মোটিভ সম্পর্কে ধারণা পায়। এক পর্যায়ে পাপ্পু, ঋতু ও গোলাম রসুল এই হত্যাকাণ্ড ঘটায় বলে নিশ্চিত হয় পুলিশ। তারপর তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে মৌলভীবাজার জেলা জুড়ি উপজেলার পাহাড়ি চা বাগান এলাকা থেকে তাদের তিনজনকে একসাথে গ্রেপ্তার করা হয়। কক্সবাজার সদর থানা পুলিশের এই দলে নেতৃত্ব দেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) পেয়ার আহমেদ।

গোলাম রাব্বানী টিপু হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় শেখ হাসান ইফতেখার ওরফে চালু ও কক্সবাজারে শহরের টেকপাড়ার বাসিন্দা মেজবাউল হক ভুট্টো নামের দুইজন আটক হয়ে কারাগারে রয়েছেন। তাদের সাথে এই হত্যাকাণ্ডের কোনো যোগসূত্রের তথ্য এখনো হাতে পায়নি পুলিশ।

এ বিষয়ে পুলিশ সুপার মো. রহমত উল্লাহ বলেন, তাদের এখনো রিমান্ডে আনা হয়নি। এছাড়া তাদের সম্পর্কে বিশদ কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এই হত্যাকাণ্ডে তাদের সম্পৃক্ততা নিয়ে গভীর অনুসন্ধান করছে পুলিশ।

ঘটনার পরদিনই নিহত টিপুর ভগ্নিপতি ইউনুছ আলী শেখ বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে কক্সবাজার সদর থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মৌলভীবাজার থেকে গ্রেপ্তার পাপ্পু, গোলাম রসুল ও ঋতুকে এই হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

উল্লেখ্য যে, গত ৮ জানুয়ারি রাত সোয়া ৮টার দিকে কক্সবাজার শহরের সৈকত এলাকাস্থ হোটেল সীগালের সামনে ফুটপাতে হাঁটা অবস্থায় গোলাম রাব্বানী টিপুকে মাথায় গুলি করা হয়। পথচারীদের সহযোগিতায় আবদু সালাম নামের এক ইজিবাইক চালক টিপুকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকৌতুক কণিকা
পরবর্তী নিবন্ধচটপটির দোকান ও রেস্তোরাঁর বিপরীতে ২৩৪ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ : অনুসন্ধানে দুদক