চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে ব্যবসায় সংকট

পাওনাদারদের ৩শ কোটি টাকা না দিয়ে ছয় ব্যবসায়ীদের গা ঢাকা । এক মাসের মধ্যেই এসব ঘটনা

হাসান আকবর | বুধবার , ৩১ জুলাই, ২০২৪ at ৬:১২ পূর্বাহ্ণ

পাওনাদারদের ৩শ কোটির বেশি টাকা না দিয়ে মাসখানেকের মধ্যে গা ঢাকা দিয়েছেন ৬ জন ব্যবসায়ী। এসব ঘটনা খাতুনগঞ্জে প্রভাব ফেলেছে। বাকিতে পণ্য বিক্রি অনেকটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কেউ কাউকে আর বিশ্বাস করছেন না। বড় পার্টি কিংবা ছোট পার্টি বলে কথা নেই, ঘনিষ্ঠ না হলে নগদ টাকা বুঝে নেওয়া ছাড়া পণ্য সরবরাহ করা হচ্ছে না। এর ফলে চাক্তাইখাতুনগঞ্জে ব্যবসায় সংকট সৃষ্টি হয়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতি দেশের পাইকারি বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও সংকট তৈরি করবে বলে আশঙ্কা ব্যবসায়ীদের।

প্রতিদিন শত শত কোটি টাকার পণ্যের লেনদেনের মাধ্যমে দেশের প্রধান পাইকারি বাজার চাক্তাইখাতুনগঞ্জের ব্যবসা চলে। শুধু পণ্যের লেনদেন নয়, বন্দরে জাহাজ পৌঁছার আগে আমদানিকৃত পণ্য ফরোওয়ার্ডে বিক্রি হয় এই বাজারে। যুগ যুগ ধরে চাক্তাইখাতুনগঞ্জে বিশ্বাস ছিল বড় ভিত্তি। কিন্তু বছর বছর নানা প্রতারণায় সেই বিশ্বাস ভেঙে যাচ্ছে। পাওনাদারদের কয়েকশ কোটি টাকা মেরে দিয়ে নব্বইয়ের দশকের শুরুতে সুশীল রাজঘরিয়া গা ঢাকা দেন। এরপর অনেক ব্যবসায়ী একই পথ ধরেন। কেউ কেউ ফিরে এসে পাওনাদারদের সাথে আপসরফা করেছেন। কেউ আদালতে মামলা টেনে পাওনাদারদের অর্থ পরিশোধ করেছেন। তবে চাক্তাইখাতুনগঞ্জে মেরে দেওয়া অর্থের সিংহভাগই আর পাওয়া যায়নি। এভাবে গত প্রায় ত্রিশ বছরে ব্যবসায়ীরা ব্যবসায়ীদের কয়েক হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে গা ঢাকা দিয়েছেন। প্রতারক ব্যবসায়ীদের হাতে মোটা অংকের অর্থ হারিয়ে অনেক ব্যবসায়ী ব্যবসা থেকে ছিটকে পড়েছেন।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মাঝে কিছুদিন সবকিছু ঠিক ছিল। তবে গত মাসখানেক ধরে একের পর এক ব্যবসায়ীর কোটি কোটি টাকা নিয়ে গা ঢাকা দেওয়ার ঘটনায় আতংক ছড়িয়ে পড়ে। ৪ জুন নুর ট্রেডিং নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক নাজিম উদ্দিন পাওনাদারদের ৮৫ কোটি টাকা পরিশোধ না করে গা ঢাকা দেন। কেউ কেউ বলেছেন, তিনি বিদেশ পাড়ি জমিয়েছেন। গতকাল পর্যন্ত পাওনাদারদের পক্ষে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তার দোকান ওই সময় থেকে তালাবদ্ধ রয়েছে। নাজিম এলাচ, পামওয়েলসহ বিভিন্ন পণ্যের বড় ব্যবসায়ী ছিলেন।

এর কয়েকদিনের মধ্যে গা ঢাকা দেন এস কে ট্রেডিংয়ের মালিক মোহাম্মদ কফিল উদ্দীন। গম, মসলা এবং তেলের ব্যবসায়ী কফিল উদ্দীনের কাছে পাওনাদারদের প্রায় ৬৫ কোটি টাকা আটকা পড়েছে। তারও নাগাল পাচ্ছেন না পাওনাদাররা।

গম ও পামওয়েলের বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আইয়ান ট্রেডিং। এই প্রতিষ্ঠানের মালিক মোহাম্মদ সরোয়ারের কাছে ব্যবসায়ীদের পাওনা প্রায় ৮০ কোটি টাকা। ঈদুল আজহার কয়েকদিন পর থেকে সরোয়ারের খবর নেই। তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও তালা ঝুলছে।

কে এম এন্টারপ্রাইজের আবু তৈয়ব দেশের মসলা বাজারের বড় ব্যবসায়ী। বিভিন্ন ব্যবসায়ীর ৩৫ কোটি টাকা নিয়ে তিনি গা ঢাকা দিয়েছেন। গত কয়েকদিন ধরে পাওনাদাররা সকালসন্ধ্যা খোঁজ করলেও তার নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না। কে এম এন্টারপ্রাইজেও তালা ঝুলছে।

জোহাদিয়া ট্রেডিং নামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক মোহাম্মদ ফোরকান চিনি ও মসলা খাতের বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। তার কাছে ব্যবসায়ীদের পাওনা ১১ কোটি টাকা। তারও হদিশ মিলছে না। দোকান বন্ধ।

চাক্তাইখাতুনগঞ্জের বড় ব্যবসায়ী হিসেবে খ্যাত ভাই ভাই এন্টারপ্রাইজের সেলিম। তেল, চিনি ও মসলার ব্যবসায়ী তিনি। অনেক ব্যবসায়ীর সাথে তার লেনদেন। তার কাছে ব্যবসায়ীদের পাওনা অন্তত ৪৫ কোটি টাকা। তারও কোনো খোঁজ নেই গত কয়েকদিন ধরে। পাওনাদাররা খুঁজেও তার নাগাল পাচ্ছেন না।

চাক্তাই ও খাতুনগঞ্জের একাধিক ব্যবসায়ী বলছেন, এক মাসের মধ্যে এতগুলো ব্যবসায়ীর কোটি কোটি টাকা না দিয়ে গা ঢাকা দেওয়ার ঘটনা অতীতে ঘটেনি। আমাদের ব্যবসাবাণিজ্য মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে চাচ্ছেন না। এতে করে পাইকারি বাজারের চলমান ধারায় ছন্দপতন ঘটেছে। নগদ টাকা নিয়ে ব্যবসা করা অনেকের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।

বাকিতে পণ্য বিক্রি বন্ধ করে দেওয়ায় সংকটে পড়েছেন ব্রোকাররা। বিশেষ করে ছোটখাটো ব্রোকারদের মধ্যে যারা দুয়েক কোটি টাকার পণ্য একজন থেকে বাকিতে কিনে অন্যজনের কাছে বিক্রি করতেন তাদের ব্যবসা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এদের কাছে বিভিন্নজনের টাকা আটকে গেছে। তাদের টাকাও আটকে রয়েছে কারো কারো কাছে। এই অবস্থায় লেনদেন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ব্রোকারদের অনেকে কেটে পড়ছেন। চাক্তাইখাতুনগঞ্জের ১০/১২ জন ছোটখাটো ব্যবসায়ী ও ব্রোকার ইতোমধ্যে গা ঢাকা দিয়েছেন। সবকিছু মিলে চাক্তাইখাতুনগঞ্জে সংকট দেখা দিয়েছে। এই সংকটের উত্তরণ না ঘটলে তা দেশের সার্বিক বাজার পরিস্থিতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের কয়েকজন গতকাল আজাদীকে বলেন, আমাদের সর্বস্ব শেষ। আমরা তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। বিশ্বাসভিত্তিক ব্যবসা হওয়ায় আমাদের কাছে পর্যাপ্ত প্রমাণও নেই। কিছু কিছু চেক রয়েছে। এসব চেক দিয়ে চেক প্রতারণার মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছি।

এ বিষয়ে খাতুনগঞ্জ ট্রেড এসোসিয়েশনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আবুল বশর গতকাল আজাদীকে বলেন, কয়েকজন ব্যবসায়ী পাওনাদারদের টাকা পরিশোধ না করে গা ঢাকা দিয়েছেন বলে শুনেছি। তবে ব্যক্তিগত কিছু ঝামেলার কারণে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত খোঁজখবর নিতে পারিনি।

কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এস এম ওবায়েদুল হক বলেন, আমাদের কাছে কেউ কোনো অভিযোগ নিয়ে আসেননি। এলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকৌতুক কণিকা
পরবর্তী নিবন্ধকাল থেকে চলবে স্বল্প দূরত্বের ট্রেন