চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে (চসিক) কর্মরত অস্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্থায়ী করার পক্ষে মতামত দিয়ে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে স্থায়ীকরণের আইনগত দিক খতিয়ে দেখতে গঠিত কমিটি। এতে ‘আদালতের রায়’ এবং ‘মানবিক ও সামাজিক’ প্রেক্ষাপট বিবেচনায় স্থায়ী করতে তিন দফা সুপারিশ করা হয়। কোন প্রক্রিয়ায় স্থায়ী করা যাবে তা-ও তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে। একই সঙ্গে স্থায়ীকরণের আইনগত বিষয়ে আটটি পর্যবেক্ষণও রয়েছে।
জানা গেছে, চসিকে অস্থায়ীভাবে কর্মরত আছেন ৬ হাজার ৩৩ জন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ এবং মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার পর অস্থায়ীদের স্থায়ী করার উদ্যোগ নেয় সংস্থাটি। এর অংশ হিসেবে গত ১৮ অক্টোবর চসিকের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামকে আহ্বায়ক এবং ভারপ্রাপ্ত প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবুল হাশেমকে সদস্য সচিব করে সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। স্থায়ীকরণের বিষয়ে কর্পোরেশন কর্মচারী চাকরি বিধিমালা-২০১৯ এবং স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন ২০০৯-এর আলোকে কমিটিকে সাত কর্মদিবসের মধ্যে সুস্পষ্টভাবে মতামত দিতে নির্দেশনা দেয়া হয়। কমিটি গতকাল প্রতিবেদন জমা দেয়।
কমিটির আহ্বায়ক রফিকুল ইসলাম আজাদীকে বলেন, তিন দফা সুপারিশ করেছি। ন্যায়সঙ্গতভাবে যেটা হওয়া দরকার সেভাবেই সুপারিশগুলো করা হয়েছে।
তিন দফা সুপারিশ : প্রথম সুপারিশ হচ্ছে, চসিকের সর্বশেষ অনুমোদিত শূন্য পদের বিপরীতে বর্তমানে অস্থায়ীভাবে কর্মরতদের মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণ ও সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় প্রধানের সুপারিশের ভিত্তিতে স্থায়ী করা যায়। এক্ষেত্রে অস্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে যোগদানের তারিখের ভিত্তিতে এবং বিভাগীয় প্রধান কর্তৃক চাকরি সন্তোষজনক মর্মে সুপারিশ বিবেচনায় অগ্রাধিকার বিবেচনা করা যায়।
এছাড়া অস্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে যারা চাকরি বিধিমালা অনুযায়ী ইতোমধ্যে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে অস্থায়ীভাবে কর্মরত আছেন তাদের শূন্য পদের বিপরীতে নথিতে প্রশাসনিক অনুমোদনের মাধ্যমে অগ্রাধিকার ভিত্তিতেও স্থায়ী করার জন্য দ্বিতীয় সুপারিশ করা হয়।
তৃতীয় সুপারিশ হচ্ছে, অস্থায়ীভাবে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে স্থায়ীকরণের জন্য যারা ইতোমধ্যে হাই কোর্টের আশ্রয় গ্রহণ করেছেন তাদেরকে স্থায়ীকরণের বিষয়ে হাই কোর্টের নির্দেশনা অনুসরণ করা যায়। তবে যারা হাই কোর্টের মামলা প্রত্যাহার করবে তাদেরকে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ১ ও ২ নম্বর
সুপারিশের ভিত্তিতে স্থায়ী করা যাবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন কর্মচারী চাকরি বিধিমালা-২০১৯ এবং স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন ২০০৯-এর আলোকে অস্থায়ী কর্মরতদের বয়স উত্তীর্ণের কারণে স্থায়ীকরণের সুযোগ নেই। তবে ইতোমধ্যে চসিকে নিয়োজিত কিছু সংখ্যক অস্থায়ী কর্মরতদের পক্ষে আদালতের রায় এবং অন্যান্য কিছু প্রাসঙ্গিক ঘটনাবলী পর্যালোচনা করে মানবিক দিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এনে স্থায়ীকরণে সুপারিশ করা হয়।
পর্যালোচনা : প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, অস্থায়ী ও দৈনিক ভিত্তিতে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিকগণ দীর্ঘ বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছে। নির্দিষ্ট সময় পর তাদেরকে চাকরি বা দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি না দেওয়ায় তাদের মধ্যে স্থায়ী হওয়ার একটা প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সময় অস্থায়ী কর্মচারীদের আন্দোলন প্রশমন করতে গিয়ে স্থায়ী করার আদেশ দিয়েছেন।
এছাড়া সাথে নিয়োগ পাওয়া অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আনুকূল্যে অথবা ক্ষেত্রবিশেষে আদালতের আশ্রয় গ্রহণ করে স্থায়ী হয়েছেন। ফলে একই যোগ্যতাসম্পন্ন ও একই সাথে বা আগে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েও বেশিরভাগ অস্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারী সর্বসাকুল্য বেতন কিংবা দৈনিক ভিত্তিতে বেতন নিয়ে চাকরি করে যাচ্ছেন। সত্যিকার অর্থে তারা বঞ্চনার শিকার হয়েছেন।
অতীতে কর্পোরেশনের অস্থায়ীদের করা মামলার রায়, সিদ্ধান্ত এবং বিভিন্ন যুক্তির প্রসঙ্গ এনে বলা হয়, কতিপয় অস্থায়ী কর্মচারী আদালতের রায়ের সিদ্ধান্ত মোতাবেক এবং প্রশাসনিক আদেশ মোতাবেক স্থায়ী বা নিয়মিত হওয়ায় অন্যদেরও একই রকম প্রতিকার পাবার যৌক্তিক প্রত্যাশা ও অধিকার রয়েছে। সে অধিকার ও কর্পোরেশনে দীর্ঘ সময় ধরে তাদের নিরবচ্ছিন্নভাবে যথাযথভাবে চাকরির ইতিহাস বিবেচনায় স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন, ২০০৯ এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন কর্মচারী চাকরি বিধিমালা, ২০১৯ অনুযায়ী অনুমোদিত পদের আবশ্যকীয় যোগ্যতা থাকা সাপেক্ষে শূন্য পদে অস্থায়ী কর্মচারীদের স্থায়ীকরণ বা নিয়মিতকরণ করা যেতে পারে।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, সংস্থাটিতে অনুমোদিত জনবল কাঠামো অনুযায়ী পদ আছে ৪ হাজার ২২৬টি। কিন্তু কর্মরত আছেন ৮ হাজার ৮০৩ জন। এর মধ্যে স্থায়ী আছেন ২ হাজার ৭৭০ জন। অস্থায়ী আছেন ৬ হাজার ৩৩ জন। এদিকে অনুমোদিত জনবল কাঠামোর বিপরীতে বর্তমানে শূন্য পদ আছে এক হাজার ৪৫৭টি। প্রসঙ্গত, সংস্থাটির ১৯৮৮ সালে অনুমোদিত সাংগঠনিক কাঠামোতে ৩ হাজার ১৮০টি পদ আছে। এছাড়া ২০১৯ সালে আরো ১০৪৬টি পদ সৃজন করা হয়।
জানা গেছে, স্থায়ীদের মধ্যে অনেকে গত ২০-২৫ বছরের অধিক সময় ধরে কর্মরত আছেন। কারো অবসরে যাওয়ার সময় হয়েছে। কিন্তু এদের স্থায়ী না করে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ১৩ পদে ৬০ জন নিয়োগে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। তখন স্থায়ীকরণের মাধ্যমে শূন্যপদ পূরণের দাবিতে আন্দোলন করেন অস্থায়ীরা। পরে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিটি স্থগিত করে চসিক।
জানা গেছে, চাকরি স্থায়ীকরণের দাবিতে ২০২১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর পৌনে চার ঘণ্টা অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন অস্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ওই সময় মেয়র স্থায়ীকরণের আশ্বাস দিলে কর্মসূচি প্রত্যাহার করা হয়। পরে ৫ ডিসেম্বর সিটি মেয়রকে স্মারকলিপি প্রদান, ৮ ডিসেম্বর নগর ভবনের সামনে মানববন্ধন করা হয়। সর্বশেষ ১১ অক্টোবর অবস্থান কর্মসূচি করার কথা ছিল। তবে চসিকের ঊর্ধ্বতন কর্র্তৃপক্ষের আশ্বাসে কর্মসূচি পালন করেননি অস্থায়ীরা।
সর্বশেষ ১৯ এপ্রিল একনেক সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চসিকের অস্থায়ীদের বিষয়ে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, তাদেরকে আইন-কানুনের আওতায় এনে সুযোগ দিয়ে রেগুলাইজ (নিয়মিত) করার একটা ব্যবস্থা করতে হবে। এর প্রেক্ষিতে ২৪ এপ্রিল স্থানীয় সরকার বিভাগে একটি বৈঠক হয়। এতে অস্থায়ীদের স্থায়ী বা নিয়মিতকরণের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়। পরে ২৬ মে স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে চিঠি দিয়ে সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণে সিটি কর্পোরেশনকে নির্দেশনা দেয়া হয়। এর প্রেক্ষিতে কমিটি গঠন করা হয়।