চাকতাই-খাতুনগঞ্জে ফিরে আসুক পুরনো জৌলুস

| বৃহস্পতিবার , ৮ মে, ২০২৫ at ৭:০৪ পূর্বাহ্ণ

দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ইতিহাসে চাকতাইখাতুনগঞ্জ ঐতিহ্যবাহী দুটি নাম। এই দুটি নাম যেমন অনন্য, তেমনি ঐতিহাসিকও। চট্টগ্রামের এই দুই বাণিজ্যিক এলাকার অবস্থান কাছাকাছি। পাশাপাশি উচ্চারিত হয় নাম দুটি। চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় পাইকারী বাজার। চট্টগ্রাম নগরীসহ বিভিন্ন উপজেলা থেকে ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদের আনাগোনায় প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর এ দুটি বাজার। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে পণ্য এসে জমা হয় এই বাজারের আড়তগুলোতে। প্রায় দেড়শ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত এ বাজারগুলোর সাথে দেশের অর্থনীতির প্রবাহ সমৃদ্ধি ও উন্নতির বিষয় ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। এ বাজার দুটি মূলত দেশের সকল প্রকার খাদ্যনিত্যপণ্যসহ মানুষের মৌলিক চাহিদার অধিকাংশই যোগান দিয়ে থাকে। এই বাজারের উপর নির্ভর করে দেশের পণ্যদাম, পণ্য সরবরাহ ও বাজারজাতকরণ। এখান থেকেই তৈরি হয়েছে দেশের স্বনামধন্য শিল্পপতি, ব্যবসায়ী ও সমাজপতির। চট্টগ্রামসহ দেশে ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতৃত্বের বিশাল একটি অংশ এ খাতুনগঞ্জচাকতাই থেকেই উঠে এসেছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যিই যে চাকতাইখাতুনগঞ্জের সেই জৌলুস আর নেই। নানা রকম সংকটে জর্জরিত এ দুটি বাজার। গত ৬ মে দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত হয়েছে ‘ছোট হয়ে যাচ্ছে চাক্তাই খাতুনগঞ্জের বাজার’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন। এতে বলা হয়েছে, ঢাকাচট্টগ্রাম মহাসড়কে ওজন নিয়ন্ত্রণ স্কেল স্থাপন, ব্যবসায়ীদের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং নৌ পথে পণ্য পরিবহনে ধসসহ নানা কারণে ছোট হয়ে যাচ্ছে চাক্তাই খাতুনগঞ্জের বাজার। গত দেড় দশকে চাক্তাই খাতুনগঞ্জ থেকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সরিয়ে নিয়েছে অনেক শিল্পগ্রুপ। এছাড়া সমপ্রতি পাওনাদারদের টাকা মেরে উধাও হওয়ার ঘটনাতেও খাতুনগঞ্জের ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। অন্যদিকে এক সময় ভারি বৃষ্টিপাত ছাড়া শুধুমাত্র জোয়ারের পানিতেই চাক্তাই খাতুনগঞ্জের নিচু এলাকা পানিতে তলিয়ে যেতো। তবে বর্তমানে চাক্তাই ও রাজাখালী খালের কর্ণফুলী মোহনায় নির্মিত স্লুইচ গেটের সুফল পাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এখন আর আগের মতো জোয়ারের পানিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে না। তবে স্লুইচ গেটের প্রবেশ গেট ছোট হওয়ায় বড় নৌকা প্রবেশ করতে পারছে না চাক্তাই খালে। এতে নৌ বাণিজ্যে ধস নেমেছে।

খাতুনগঞ্জের প্রবীণ ব্যবসায়ীরা জানান, চাক্তাই খাতুনগঞ্জে আগের জৌলুস ফিরিয়ে আনতে হলে সড়ক প্রশস্ত করে যানজট কমাতে হবে। কারণ যানজটের কারণে বিভিন্ন ট্রাক কাভার্ডভ্যানের অতিরিক্ত ভাড়া গুনতে হয়। এছাড়া সড়কের পাশাপাশি নৌপথে পণ্য পরিবহন বাড়াতে হবে এবং ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের ওজন স্কেল প্রত্যাহার করতে হবে। কারণ এই ওজন স্কেল চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের আর কোনো মহাসড়কে ওজন স্কেল নেই। ঢাকাচট্টগ্রাম মহাসড়কের ব্যবসায়ীরা এই ওজন স্কেলের কারণে একটি ট্রাকে ১৩ টনের বেশি পণ্য পরিবহন করতে পারছে না।

অন্যদিকে অন্যান্য অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা সেখানে ১৬ থেকে ১৭ টন পর্যন্ত পণ্য পরিবহন করছে একই পরিবহন ভাড়ায়। যা ভোগ্যপণ্যের দামেও প্রভাব পড়ছে। এছাড়া এক সময় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আমদানিকারকরা চাক্তাইখাতুনগঞ্জে পণ্য গুদামজাত করে সারা দেশে সরবরাহ দিতেন। এখন সেই সব আমদানিকারকরা লাইটার জাহাজে করে নারায়ণগঞ্জের নিতাইগঞ্জ কিংবা যশোরের নওয়াপড়ায় পণ্য আনলোড করছেন, শুধুমাত্র সড়কপথে পরিবহন ভাড়া বেড়ে যাওয়ায়।

খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ এসোসিয়েশনের সাম্প্রতিক এক সভায় ঢাকাচট্টগ্রাম মহাসড়কে স্থাপিত ওজন স্কেল প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন। গত ১২ মার্চ আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, ‘খাতুনগঞ্জ শুধু চট্টগ্রাম নয় বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রাণকেন্দ্র। তবে এটি ঠিক নানা কারণে খাতুনগঞ্জের আগের মতো জৌলুস নেই। এক সময় এই খাতুনগঞ্জ থেকে সারাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে পণ্য পরিবহন করা হতো। খাতুনগঞ্জে ব্যবসায়ীরা আবার বৈষম্যের শিকারও হয়েছে। বিশেষ করে ঢাকাচট্টগ্রাম মহাসড়কে ওজন নিয়ন্ত্রণ স্কেলের কারণে এখানকার ব্যবসায়ীরা ট্রাকে ১৩ টনের বেশি পণ্য পরিবহন করতে পারছেন না। অথচ ঢাকাচট্টগ্রাম মহাসড়ক ছাড়াও দেশের আর কোনো মহাসড়কে ওজন নিয়ন্ত্রণ স্কেল নেই।’

চাক্তাই খাতুনগঞ্জ আড়ত সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, চট্টগ্রামের চাক্তাই খাতুনগঞ্জে বিশেষ করে ছোলা, মশুর ডাল, সাদা মটর এবং গম জাতীয় পণ্যগুলো আনলোড হয়ে গুদামজাত করা হতো। এরপর সরবরাহ হতো সারাদেশে। কিন্তু এখন ঢাকাচট্টগ্রাম মহাসড়কে ওজন স্কেলের কারণে চাক্তাই খাতুনগঞ্জের ব্যবসা চলে যাচ্ছে নারায়ণগঞ্জে। আমদানিকারকরা এখন আর চট্টগ্রামে পণ্য আনলোড করতে চান না। সরকারের সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মহাসড়কের সুরক্ষার জন্য ওজন নিয়ন্ত্রণ আইন করা হয়েছে। তাহলে শুধুমাত্র ঢাকাচট্টগ্রাম মহাসড়কের জন্য কেন এই আইন? দেশে তো মহাসড়ক আরো আছে। মহাসড়ক যদি ওজনের চাপে নষ্ট হয়ে যায় তাহলে সরকারের উচিত আধুনিক নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করে সড়কের উন্নয়ন করা। ওজন নিয়ন্ত্রণের কারণে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

নগর পরিকল্পনাবিদরা বলেন, চাকতাইবদরখালীসহ বিভিন্ন খাল দখলমুক্ত করা, পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করা, ময়লাআবর্জনাবর্জ্য ফেলে খাল ভরাট প্রতিরোধ করা দরকার। মনে রাখতে হবে, চাকতাই খাতুনগঞ্জের অর্থনৈতিক ক্ষতির বিরূপ প্রভাব পড়ছে আঞ্চলিক ও জাতীয় অর্থনীতিতেও। নানা সমস্যার মধ্যেও চাকতাইখাতুনগঞ্জ ব্যবসায়ীদের মূল ভরসার জায়গা। আমরা চাই, ঐতিহ্যবাহী এই দুই বাজারে পুরনো জৌলুস ফিরে আসুক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকৌতুক কণিকা
পরবর্তী নিবন্ধ৭৮৬