সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প আজন্ম লালিত সংস্কৃতিকে গ্রাস করতে চাইছে। এই অপশক্তি এদেশের কোনো একটি পক্ষের ছায়ায় বেড়ে উঠছে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। দেশে জঙ্গিবাদের জন্ম হচ্ছে, কেউ না কেউ ক্ষেত্রটা তৈরি করছে বলেই। এসময় চাই শুদ্ধ সংস্কৃতি, মুক্তবুদ্ধি চর্চাকারীদের দায়িত্ব অনেক বেশি। শুধুমাত্র আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কিংবা রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিরোধ গড়ে তুললে হবে না। মানুষকে সচেতন করে তোলার কাজটা সমন্বিত ভাবে করতে হবে। যদি সে চেষ্টা সফল হয়, তবেই এ দেশ জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস মুক্ত অসামপ্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী একটি দেশে পরিণত হবে, যে দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিশিষ্ট নাট্যজন, বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সভাপতি আসাদুজ্জামান নূর এমপি গতকাল সন্ধ্যায় নগরীর শিল্পকলা একাডেমির মুক্তমঞ্চে প্রমা আবৃত্তি সংগঠনের ৩৩ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত তিন দিন ব্যাপী আবৃত্তি উৎসবের উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথা বলেন। তিনি বলেন, গত ৩৩ বছর ধরে প্রমা এ কাজটি করে চলেছে নিষ্ঠার সাথে, সাহসিকতার সাথে। উৎসবের উদ্বোধন করেন সমাজবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. অনুপম সেন।
‘তূর্য নিনাদ বাজাও কণ্ঠে, জাগাও সত্তা শুদ্ধপ্রাণ’ এ স্লোগানকে সামনে রেখে প্রমা
আবৃত্তি সংগঠনের ৩৩ বছরপূর্তি উপলক্ষে তিন দিনব্যাপী আবৃত্তি উৎসব গতকাল থেকে শুরু হয়েছে। সংগঠনের সভাপতি আবৃত্তিশিল্পী রাশেদ হাসানের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ পালের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক আহকামউল্লাহ, প্রফেসর ডা. এ কিউ এম সিরাজুল ইসলাম, সাংস্কৃতিক সংগঠক ও রাজনীতিবিদ মফিজুর রহমান, বাংলাদেশ টেলিভিশন, চট্টগ্রাম কেন্দ্রের জিএম মাহফুজা আক্তার, নারী নেত্রী নূরজাহান খান, কবি ও সাংবাদিক ওমর কায়সার প্রমুখ।
আসাদুজ্জামান নূর বলেন, যারা কবিতা পড়েন, হৃদয় গভীরে কবিতা অনুভব করেন, কবিতায় বিশ্বাস রাখেন, তারা জীবনে কখনো অন্যায় করতে পারেন না। তারা যেখানেই যান না কেন, তাদের হৃদয়ে নিত্য বাজে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হকের দর্শন। মানুষের মঙ্গল কামনা-ই তাদের ব্রত হয়ে পড়ে। প্রমা আবৃত্তি সংগঠন দীর্ঘ ৩৩ বছর ধরে এ কাজটি করে চলেছে।
আসাদুজ্জামান নূর বলেছেন, আমাদের সমাজের অভ্যন্তরে বসবাস করেই অনেকে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে। তবে আশার কথা এই দেশের মানুষ জঙ্গিবাদকে প্রত্যাখ্যান করছে। এটি কিন্তু কম বড় কথা নয়। এটাই বাংলাদেশ।
তিনি বলেন, যে ছেলেমেয়েরা গান, কবিতা, নাটক, আবৃত্তি করে, তারা কখনোই সন্ত্রাসী বা জঙ্গি হতে পারে না। শিশুদের যদি ছোটবেলা থেকেই সংস্কৃতিচর্চার মধ্য দিয়ে গড়ে তোলা যায়, তাহলে সে অসামপ্রদায়িক চেতনা নিয়ে বড় হবে। তার মধ্যে ধর্ম, বর্ণ, গোত্রের ভেদটা আর থাকবে না। অস্ত্র নয়, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তন করতে হবে। তিনি প্রমাসহ সকল সাংস্কৃতিক সংগঠনকে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক চেতনা বিকাশে সহায়তা করার আহ্বান জানান।
সমাজবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. অনুপম সেন বলেন, আবৃত্তি সব শাস্ত্র থেকে বড় শাস্ত্র। সংস্কৃতির মহৎতম অর্জন কবিতা। বাংলা কবিতা মানুষকে জাগিয়েছে। প্রমা আবৃত্তি সংগঠনের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আমি যুক্ত আছি। এ সংগঠনটি প্রতিবছর শহীদ জননী জাহানারা ইমামের মৃত্যুবার্ষিকী, দেশের প্রথাবিরোধী ও বহুমাত্রিক লেখক হুমায়ূন আজাদ, কবি শামসুর রাহমান স্মরণে নানা অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করে থাকে। দেশকে এগিয়ে নিতে প্রমা শত বর্ষব্যাপী জেগে থাকুক মানুষের অন্তরে। তিনি বলেন, ব্যক্তি কিংবা জাতির ঐশ্বর্যতা, ইতিহাস আবৃত্তির মাধ্যমে বিকশিত হয়। এদেশের কবিরা জনগণকে জাগানোর ক্ষেত্রে অসাধারণ কিছু সৃষ্টি করে গেছেন। তা জনগণের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন আবৃত্তিকারগণ। শিল্প, সমাজ ও দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা নিয়ে আবৃত্তি সংগঠন প্রমা কাজ করছে ৩৩ বছর ধরে। দেশের যেকোনো সংকটময় মুহূর্তে প্রমার শিল্পীরা জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে নিয়োজিত থেকে কাজ করে চলেছে। আগামীতেও প্রমা তার পথচলা অব্যাহত রাখবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
সভাপতির বক্তব্যে রাশেদ হাসান বলেন, রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে দ্বৈতসত্তা আছে। সংবিধানে সামপ্রদায়িকতা রেখে অসামপ্রদায়িক রাষ্ট্র গঠন করা যায় না। আপোষকামিতরার জায়গা থেকে যদি এক হই, তবে সেই ঐক্য টিকবে না। আমাদের মুখে ও মনে, চিন্তা ও চেতনায় মিল থাকতে হবে। প্রমা গত ৩৩ বছর ধরে সেই চর্চাই করে যাচ্ছে। আগামীতেও সেই পথ থেকে বিচ্যুত হবে না।