নজরুল বিদ্রোহী কবিতা রচনা করেছিলেন বাইশ বছর বয়সে। সুকান্ত নবজাতকের জন্য স্থান ছেড়ে দিয়ে ইতিহাস হয়ে গিয়েছেন মাত্র একুশ বছরে। ততদিনে পৃথিবীর নানান ভাষায় তাঁর কবিতা অনূদিত হয়েছে, নানান দেশে সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ যুবক কবির জীবনী ছাপা হয়েছে। ক্ষুদিরাম দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন উনিশ বছর বয়সে। হেসে হেসে ফাঁসির দড়ি গলায় পরেছেন তিনি- ভারতবাসী সবই দেখেছে। অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা দেশের জন্য আত্মাহুতি দিয়েছিলেন একুশে। একুশ বাইশেই এ পি জে আবদুল কালাম আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন নিয়ে সীমানা ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। শহীদ রুমী বিশ্বসেরা বিদ্যাপীঠে যাবার ছাড়পত্র হাতে পেয়েও দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছিল, উনিশ বছরে। কুড়ি বছর বয়সটাই বুঝি এমন। কুড়ির কাছাকাছি সময়টাতেই বোধ করি স্বপ্ন ভর করে যুবকদের ওপর। যে স্বপ্ন প্রাণশক্তি যোগায় সমাজটাকে বদলে দিতে, নতুন দিনের আলো ফোটাতে। আমাদের যুবকদের কাছে সব-ই কী অজানা?
কত কাজ আমাদের তরুণ যুবাদের! সব ফেলে, সব ভুলে মেতে আছে ওরা মাদক, প্রতারণা, খুন, ধর্ষণের মহোৎসবে। সতের কোটি জনতা চেয়ে চেয়ে দেখছে। সুসজ্জিত বসার ঘরের আরাম কেদারায় উপবেশন করে একটু খানি ছি ছি, কী লজ্জা! – ওইটুকুই। আবার সবাই ফিরে যায় যে যার কর্মে, পালন করে যে যার ধর্ম। এত সহিষ্ণুতা কেমন করে পেল এ-জাতি! একটি ফুলকে বাঁচাবে বলে প্রাণ দিয়েছিল লক্ষ মুক্তিসেনা। এখন লক্ষ ফুল ঝরে যায়, কেউ দেখেনা। দেখলেও কেউ গভীরভাবে ভাবেনা। সমাজটাকে বাঁচানোর পথ খোঁজেনা।
শতাধিক বছরের পুরোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সিলেটের এমসি কলেজ। যুগে যুগে কত সোনা ফলেছে ঐতিহ্যবাহী এই প্রতিষ্ঠানে! বিশ্ববিদ্যালয়ে নবাগত শিক্ষার্থীদের মাঝে এমসি কলেজের ছাত্রদের আলাদা কদর, বিশেষ সম্মান। আগামীতে এমসি কলেজ থেকে আগত ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে কলেজের পরিচয় দিতে গিয়ে কী আত্মগ্লানিতেইনা ভুগবে! কারণ অপকর্মের জন্য কলেজের পবিত্র অঙ্গনকেই ব্যবহার করা হয়েছে। কেউ তাদের থামাতে পারেনি। নির্বিঘ্নে, নির্ভয়ে পৃথিবীর তাবৎ আইনকানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পৌরুষের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে- তারা কতটা মহাশক্তিধর, দোর্দণ্ড প্রতাপশালী। তাদের হাতে তাৎক্ষনিক হাতকড়া পড়লেও গেল এক মাসে তাদের দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছে আরও শত তরুণ-যুবা। থেমে নেই বাবা চাচা দাদার বয়সীরা। শিক্ষক, আইন শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মী, এমনকি ধর্মগুরুরাও নাম লিখিয়ে চলেছে সমাজবিরোধীদের তালিকায়।
আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দক্ষতার সঙ্গে তাদের কাজ করে যাচ্ছে। একই সঙ্গে প্রতিবাদকারী যুবকদের ওপর চড়াও হওয়ার খবরও আসছে, যা অপরাধ দমনে তাদের ভূমিকা ও অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। তবে আজকের এই নিবন্ধ কেবলই ধিক্কার, নিন্দা বা সমালোচনা করার জন্য নয়। আইন তার পথে চলুক, বিচারকার্জ সমাধা হোক বিধানমতো। অতঃপর কী? অভিযুক্ত যুবকেরা কিছুদিন হাজতে-কারাগারে বন্দী থেকে, কয়েকদফা কারাগার- আদালত ভ্রমণ পরিভ্রমণ শেষ করে, আবার একদিন মুক্ত আকাশের নিচে ফিরে আসবে। তখন কী বদলে যাবে ওরা? সংশোধন বা পরিশুদ্ধ হওয়ার কোন প্রশিক্ষণ কী দেওয়া হয় আমাদের কারাগারে?
ইতোমধ্যে মৃত্যুদণ্ডের বিধান হয়েছে। কিন্তু কতজনকেই বা ফাঁসির দড়িতে ঝোলানো যাবে? দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়ায় দুর্ধর্ষ অপরাধীকে বাঁচাতে দাঁড়িয়ে যাবেন আইনের পোশাক পরা নামিদামী আইনজীবীগণ। সততা নৈতিকতার ওপর ভর করে নয়, আইন চলে সাক্ষ্য প্রমাণ সাপেক্ষে। সত্যকে মিথ্যা, মিথ্যাকে সত্য, দিনকে রাত, রাতকে দিনে পরিণত করায় আইনজ্ঞদের জুড়ি নেই। তাঁদেরও তো বাঁচতে হবে, পরিবার পরিজন নিয়ে। সমাজ থেকে যাবতীয় অপরাধ নির্মূল হয়ে গেলে আইন-আদালত, কোর্ট-কাছারি, থানা-হাজতকে কেন্দ্র করে জীবন ও জীবিকা যাদের, তারা যে পথে বসবে। দণ্ডিতের সাথে দণ্ডদাতা কাঁদবেন- তেমন বিচার কী দেখবে আমাদের সমাজ ?
যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে সে প্রশ্ন রেখে ফিরে চলুন নিজের কাছে। কারণ এখন সময় আত্মজিজ্ঞাসার, আত্মসমালোচনার, আত্মশুদ্ধির। কেন আমাদের শিক্ষিত যুবকদের বড় একটা অংশ জাগতিক যাবতীয় দায়দায়িত্ব ভুলে দানবিক উল্লাসে মেতে উঠেছে? বাবা মা, পরিবার, সমাজ, শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং রাজনৈতিক বলয় কেউ এর দায় এড়াতে পারেনা। ওদের মানুষ করার জন্য এত আয়োজন! কত স্বপ্ন ওদের নিয়ে! ওরাই যদি বিপথে গেল, আলো ফেলে অন্ধকারে হারিয়ে গেল তবে আগামী দিনগুলো আমাদের কেমন যাবে! জাতিকে পথ দেখাবে কারা! আমাদের নিশ্চয় কোথাও না কোথাও ভুল হচ্ছে। কেউ তো অপরাধী হয়ে জন্মায়না। সমাজের রীতিনীতির কোন না কোন ফাঁকফোকর ওদেরকে ভুল বার্তা দেয়, যা অপরাধে উৎসাহিত করে। মনোবিদগণ এ বিষয়ে নিশ্চয় সঠিক কোন দিকনির্দেশনা বাতলে দিতে পারবেন।
আজকাল বাবা-মা ও শিক্ষকরা কেবল পরীক্ষায় উচ্চ নম্বর পাওয়া নিয়ে যতটা ব্যতিব্যস্ত রাখেন সন্তান ও শিক্ষার্থীদের, তার কানাকড়িও ব্যয় করেননা সন্তানকে নৈতিকতা শেখানোর জন্য। আগেকার দিনে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় দিয়ে হাতেখড়ি হত শিশুদের, যাতে নৈতিক শিক্ষার ভিত রচিত হত। সেকেলে বলে আমরা তা বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছি কয়েক দশক আগে। ধর্মের কথাতো বলতেই মানা। ধর্ম কর্ম ত্যাগ করে জাতে ওঠার প্রক্রিয়ার সূচনাও বেশ অনেক কাল হল। ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা ভুলে ধর্মকে কেবলই পোশাকি আচরণবিধিতে বেঁধে রেখে অধর্ম ও অশুভের জয়োল্লাস চলছে সমাজজুড়ে। আজকাল অসুস্থ অশোভন প্রতিযোগিতামূলক সমাজে সন্তানের আবদার বায়না মেটাতে গিয়ে আমরা নিজেরাই নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে বসে থাকি। সততা, ন্যায়পরায়ণতা, ধার্মিকতার চর্চা করে পিছিয়ে পড়তে রাজি নই কেউ। কবিগুরুর সেই কথাগুলো মনে পড়ে গেল-
“অধর্মের মধু মাখা বিষফল তুলি
আনন্দে নাচিছে পুত্র স্নেহমোহে ভুলি
সেই ফল দিওনা তারে ভোগ করিবারে
কেড়ে লও ফেলে দাও, কাঁদাও তাহারে”।
অনেকদিন আগে আমার সাদাসিধে মা তাঁর নোটখাতায় টুকে রেখেছিলেন ওপরের পঙক্তিগুলো শুধুমাত্র আমাকে দেখানোর জন্য, যেন আমি তা ছড়িয়ে দেই আমার সন্তান ও শিক্ষার্থীদের মাঝে। আমার মায়ের খাতায় এরকম অনেক কবিতার পঙক্তি, নীতিকথা, মনীষীদের উক্তি লেখা আছে। আমাদের ভাইবোনদের জন্য তুলে রাখা সব। আধুনিকতার পাঠ নেওয়া আমাদের প্রজন্মের বাবা মায়েদের সময় নেই এতসব নীতিকথা ধর্মকথায় কান দেবার। গাঁও গেরামে যেসব বাবা মায়ের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই তাঁরাও যুগের ভাও বুঝে গিয়েছেন। তাঁরা জানেন- সোজা পথে গেলে উন্নতি আসবেনা। যে কারণে পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনের মতো ছোটখাটো অপরাধে গা করেননা তাঁরা, বরং প্রশ্রয়ই দেন। পরিণামে ধীরে ধীরে বড় অপরাধের হাতেখড়ি হয়ে যায়। বড় বড় পাশ দিয়ে বের হয় সোনার ছেলেরা। শিক্ষার আলো, সৌন্দর্য, শক্তি- কিছুই তাদের অন্তরে প্রবেশ করেনা। সবার ভাবখানা এমন- এইসব আলো, সৌন্দর্য, শক্তি দিয়ে কাজই বা কী? ওপরে ওঠার জন্য এসবের কোন প্রয়োজন আছে কী ?
বইয়ের পোকা এক চতুর্দশী কিছুদিন আগে কথা প্রসঙ্গে ভদ্রলোকের সংজ্ঞা বলছিল নিজের মতো করে ইংরেজিতে- ্তুএবহঃষবসবহ ধৎব ঃযড়ংব যিড় ধপঃ হরপবষু ধহফ ংযড় িৎবংঢ়বপঃ ঃড় ড়িসবহ্থ । সহজ বাংলায় অর্থ করলে দাঁড়ায়- ভদ্রলোক তারাই যারা সদাচরণ করে এবং মেয়েজাতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে। মেয়েজাতি বলতে ঘরে বাইরের সকল নারীকেই বোঝানো হয়। সেই কিশোরীর ভাবনাকে সত্য বলে মেনে নিলে আমাদের সমাজে কেতাদুরস্ত পরিচ্ছদ পরিহিত কত শতাংশ পুরুষ প্রকৃত ভদ্রলোক সমপ্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হবেন, তা পরিমাপ করা বেশ কঠিনই হবে । পাহাড় থেকে সমতলে প্রতিদিন লাঞ্ছিত হচ্ছে মেয়েরা। শিশু, কিশোরী, নববধূ, সন্তানের মা, এমনকি প্রতিবন্ধী কাউকে ছাড় দেয়না ধর্ষকেরা। কতজন পুরুষ পথে নেমেছেন ? প্রতিবাদ করেছেন? মহামারী চলছে বলে রাজনৈতিক জনসভা, উৎসব আয়োজন, আনন্দ ভ্রমণ- কোন কিছুইতো থেমে নেই দেশজুড়ে। অপরাধী আমার দলের নয়- বলে হাত ঝেড়ে, গা বাঁচিয়ে চলেছেন জননেতাদের অনেকে। হাতে গোনা কিছু যুবক নেমেছে পথে, পুলিশের লাঠির বাড়ি হজম করেও । তাদের সাধুবাদ জানাতে হয়, স্রোতের বিপরীতে মেরুদণ্ড সোজা করে চলার জন্য। ওরাই সূর্যোদয়ের গান শোনাবে আমাদের, সেই প্রত্যাশায় বাঁচতে সাধ হয়।
নন্দিতা রায় ও শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় পরিচালিত টালিউডের ছায়াছবি ‘মুক্তধারা’ দেখছিলাম কয়েকদিন আগে। সত্য গল্পকে উপজীব্য করে নির্মিত ভাবনার ঘরে নাড়া দেয়ার মতো এক দুর্দান্ত চলচ্চিত্র। দুর্ধর্ষ অপরাধীদের পরিশুদ্ধ নাগরিকে উত্তরণের এক অভূতপূর্ব পরিক্রমা। সিনেমা মাত্র নয়; এ-এক জীবনদর্শন। কারাগারকে সংশোধনাগারে রূপান্তরিত করার অভিনব পথ বের করেন কারাপ্রধান, যেখানে সম্বল কেবল ভালোবাসা; মায়া-মমতা, সম্মান। পাপকে ঘৃণা কর, পাপীকে নয়- ছেলেবেলা থেকে শেখা হলেও আমাদের সমাজে তার প্রতিফলন দেখা যায়না। ‘দশ ফুট বাই দশ ফুটের একটা কুঠুরিতে বন্দী হয়ে থাকা আত্মাকে মুক্ত করতে একটা মুক্তধারা লাগে’- ‘মুক্তধারা’ চলচ্চিত্রের এই অমোঘ বাক্যটি পথ দেখাতে পারে পথহারা পথিকদের পথে আনার সংগ্রামে। সে সংগ্রামে হাত মেলাতে হবে সকলকে। পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম এবং জনপ্রতিনিধিগণের সম্মিলনে এই সমাজে মুক্তি আসতে পারে, ঠিক যেমন করে রবিঠাকুর বলেছিলেন- “এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়”।