চাই জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বাস্তবায়ন

| বুধবার , ৬ অক্টোবর, ২০২১ at ৫:৪৭ পূর্বাহ্ণ

করোনাকালীন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে বেড়েছে আয় বৈষম্য। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে গত এক বছরে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে সাড়ে ১১ হাজার। অপরদিকে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জরিপে উঠে এসেছে নতুন করে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ দরিদ্র হওয়ার চিত্র। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আয় বৈষম্য মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এর কারণ হচ্ছে দুর্নীতির মাধ্যমে কালোটাকা অর্জন, হুন্ডির মাধ্যমে দেশ থেকে টাকা পাচারে কিছুটা প্রতিবন্ধকতা, প্রণোদনা প্যাকেজেরে টাকা ভিন্ন খাতে স্থানান্তর, করনীতিতে অসামঞ্জস্য, ধনীদের কাছ থেকে কম হারে কর আদায় ও বিনিয়োগ বন্ধ থাকা। এসব কারণে একশ্রেণির মানুষের বৈধ ও অবৈধ উপায়ে আয় বাড়ছে। তবে আয় কমেছে এমন মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। যা একটি দেশ ও সমাজের জন্য কাম্য নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরুর আগে গত বছরের মার্চ পর্যন্ত দেশে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক কোটিপতি আমানতকারীর হিসাব সংখ্যা ছিল ৮২ হাজার ৬২৫ জন। চলতি বছরের মার্চ শেষে তা বেড়ে হয়েছে ৯৪ হাজার ২৭২ জন। ফলে করোনার এক বছরে দেশে নতুন কোটিপতি আমানতকারী বেড়েছে ১১ হাজার ৬৪৭ জন। এর মধ্যে চলতি মাসের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) বেড়েছে ৩৮২ জন। অপরদিকে মহামারির আঘাতে দেশে নতুন করে ২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়েছে। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত নতুন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা হয়েছে ১৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ। যা আগের বছরের জুন পর্যন্ত ছিল ২১ দশমিক ২৪ শতাংশ। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) জরিপে এসব কথা বলা হয়েছে। জরিপে আরও বলা হয়েছে, মহামারি শুরু হওয়ার পর দেশের অর্থনীতিতে কোভিড-১৯ এর প্রভাব পড়েছে। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর প্রভাবটা অনেক বেশি। গবেষণায় দেখা গেছে, অতি ধনীদের তাদের হাতে এখন দেশের মোট আয়ের ৩৭.৮০ শতাংশ, যা লকডাউনের আগে ছিল ২৭.৮২ শতাংশ। এই কোভিড-১৯-এর লকডাউন আয় বৈষম্যও বাড়িয়েছে। যা মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে।
অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম তাঁর এক লেখায় লিখেছিলেন, স্বীকার করতেই হবে যে জিডিপি ও জিএনআই প্রবৃদ্ধি সহ নানাবিধ অর্থনৈতিক সূচক গত দুই দশক ধরে সন্দেহাতীতভাবে জানান্‌ দিয়ে চলেছে যে বাংলাদেশের অর্থনীতি অনুন্নয়ন ও পরনির্ভরতার ফাঁদ থেকে মুক্ত হয়ে টেকসই উন্নয়নের পথে যাত্রা করেছে, যেটাকে ১৯৬০ সালে ওয়াল্ট রস্টো একটি দেশের অর্থনীতির ‘টেকসই প্রবৃদ্ধির পানে উড়াল’ স্তর নামে অভিহিত করেছিলেন। কিন্তু মাথাপিছু জিডিপি যেহেতু একটি গড় সূচক তাই মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধির সাথে সাথে যদি দেশে আয়বন্টনে বৈষম্যও বাড়তে থাকে তাহলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির সুফল সমাজের উচ্চবিত্ত জনগোষ্ঠীর কাছে পুঞ্জীভূত হওয়ার প্রবণতা ক্রমশ শক্তিশালী হতে থাকে, যার ফলে নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ প্রবৃদ্ধির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত থেকে যায়। অতএব, আয়বৈষম্য ক্রমে বাড়তে থাকার প্রবণতাকে দেশের আসন্ন মহাবিপদ সংকেত বললে অত্যুক্তি হবে না। প্রবৃদ্ধির সুখবরের পাশাপাশি এই একটি মহাবিপদ যে এদেশের ১৯৭৫-পরবর্তী শাসকমহল তাদের ভ্রান্ত অর্থনৈতিক দর্শন ও উন্নয়ন কৌশলের মাধ্যমে ডেকে আনছে তার প্রতি যথাযথ গুরুত্ব প্রদানের জন্যে আমি গত সাড়ে তিন দশক ধরে সর্বশক্তি দিয়ে জাতির মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি। দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, আশির দশক থেকেই এদেশে আয় ও সম্পদ বৈষম্য ক্রমশ বাড়তে বাড়তে এখন বাংলাদেশ একটি ‘উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশে’ পরিণত হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
আসলে আয় বৈষম্য কমানোর জন্য সংশ্লিষ্টদের পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। অর্থনীতিবিদদের মতে, এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ উপায় হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ব্যাপক সংস্কার। সে প্রেক্ষিতে হতদরিদ্রদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতা বাড়ানোর পাশাপাশি মাথাপিছু বরাদ্দে ব্যাপক পরিবর্তন আনা দরকার। এর পাশাপাশি শহরাঞ্চলের দরিদ্র মানুষের জন্য নতুন নতুন কর্মসূচি ও জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির দ্রুত বাস্তবায়ন প্রয়োজন। তাঁরা বলেন, সার্বিকভাবে দারিদ্র্যের দুষ্ট চক্র থেকে বের হয়ে পিছিয়ে পড়া মানুষদের আত্মনির্ভর হওয়ার জন্য কর্মমুখী ও দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে করা কর্মসূচিগুলোর দিকে নজর দেওয়ার বিকল্প নেই। সর্বোপরি শিক্ষা ও দক্ষতা বৃদ্ধি কর্মসূচিতে সরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রেক্ষিতে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদে সমাজের সব শ্রেণির মানুষের অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধবিশ্বমানব বসতি দিবস